হুশহুশ করে কানের পাশ দিয়ে হাওয়া কেটে সরে যাচ্ছে দিনগুলো। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটছে মানুষ। হাঁপাচ্ছে, পড়ছে, উঠছে — ফের ছুটছে। কিছু জন পড়ে আর উঠতে পারছে না, কিন্তু দৌড় বজায় রাখার খাতিরে দ্রুত গড়াতে গড়াতে এগোচ্ছে — পথে চড়াই এলে যে উল্টো দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে, সেটা জেনেও। কিংবা, না জেনে। জানি না।
আমি দৌড়োতে চাই না। চাইনি কোনোদিন। কিন্তু তাতে কি? ক্ষিপ্র, ধাবমান পৃথিবী, অনিচ্ছুক আমাকে ধাক্কা দিয়ে, ঠেলে, জুতে দিতে চাইছে তীব্র গতিমান জনস্রোতের সঙ্গে, মিশিয়ে দিতে চাইছে তেলে আর জলে। আর আমি পৃথিবীর হাত ছাড়িয়ে দুদন্ড বসে জিরোতে চাইছি কোথাও, যেমনটি সবসময়ই চাই।
মনখারাপ। মনখারাপ। মনখারাপ। মন ভালো থাকলেই বরং আমার বেশি করে মনখারাপ হয়। মনটা খারাপ থাকলে অনেকটা ভাল থাকি।
তেমনই ভাল ছিলাম আজ সারাদিন। পুরোনো জায়গায় ট্রান্সফারের যে অর্ডার আসেনি, হয়ত কখনোই আসবে না আর, তারই অপেক্ষায় সমস্ত দিন হেলথ পোর্টালের দুয়ার খুলে বসে রইলাম। প্রত্যাশামতোই অর্ডার এলো না আজও। অজান্তেই মান্যতা দিয়ে গেল আমার মনখারাপ-কে।
আমি আবার ভারী মন নিয়ে, কোল জোড়া প্রতীক্ষা নিয়ে পা ছড়িয়ে বসলাম। আসবে নিশ্চয় অর্ডার, কাল না হোক পরশু, পরশু না হোক তরশু — কোনো না কোনোদিন তো আসবে ঠিকই। তাড়া কিসের?
এই অপেক্ষা করতে করতেই মনে পড়ে গেল তিরিশ বছর আগে রিলিজ করা একটা সিনেমার কথা। What’s eating Gilbert Grape?
আমেরিকার আইওয়া অঞ্চলের তস্য মফস্বলের এক সামান্য মুদিখানার কর্মচারী গিলবার্ট গ্রেপের গল্প।
পঁচিশ বছরের সাধারণ যুবক গিলবার্ট তার দুটি কিশোরী ছোট বোন, একটি মানসিকভাবে বিকল তরুণ ভাই আর মায়ের দায়িত্ব সামলায় এই আধা গঞ্জ শহরের একটা পুরনো দোতলা কাঠের বাড়িতে থেকে।
অনেক বছর আগে তাদের বাবা আত্মহত্যা করেছিলেন ঐ বাড়িরই দোতলার ছোট্ট ঘরটিতে। সেই থেকে মা নিজেকে বন্দী করেছেন জীর্ণ সোফায় -‐- খাওয়াদাওয়া আর টিভি দেখা ছাড়া অন্য কিচ্ছু করেন না, সংসার সামলায় দুই মেয়ে। অবসাদগ্রস্ত মায়ের রোগ অপরিসীম স্থূলতা, তার জন্য পড়শিদের হাসিঠাট্টার শিকার হয় পরিবারটি।
গিলবার্ট প্রেম করে বিবাহিতা প্রতিবেশিনীর সঙ্গে — যে প্রেমের কোনো পরিণতি নেই।
তাদের নিস্তরঙ্গ জীবনে প্রথম ঢেউ ওঠে, যখন শহুরে মাল্টিন্যাশনাল রিটেল দোকানগুলি তাদের পণ্যের পসরা সাজিয়ে আসতে শুরু করে সেই গঞ্জশহরে, সামান্য মুদিখানার ব্যবসা লাটে ওঠবার উপক্রম করে।
তাদের মফস্বল শহরটি ছিল বড় হাইওয়ের ধারে, তাই পর্যটকদের গাড়ির আনাগোনা লেগেই থাকত সেই পথে। এমনই একটি খারাপ হয়ে যাওয়া গাড়ির যাত্রিণী এক বুড়ি ঠাকুমা আর তার নাতনি বেকির সঙ্গে আলাপ হয় গিলবার্ট আর তার ভাইটির। যতদিন তারা গাঁয়ে থাকে, তারই মধ্যে আনাগোনা আর নানা ঘটনাবলীর ঘাত প্রতিঘাতে মেয়েটির সঙ্গে মনের বাঁধনে জড়িয়ে যায় গিলবার্ট আর তার বিকারগ্রস্ত ভাই আর্নি। গিলবার্ট জড়ায় ভালবাসায়, আর আর্নি কারোর উপর নিশ্চিন্তে, নিঃশর্তে নির্ভর করতে শেখে — নিজের মা ও দাদার পরে এই প্রথম।
এর পর শান্ত শহরতলির সহজ জীবনে ঘটতে থাকে নানা জটিল ঘটনা।
গিলবার্টের বিবাহিতা প্রেমিকার স্বামীর অপমৃত্যু হয় জলে ডুবে। মহিলা সবকিছু বিক্রিটিক্রি করে এলাকা ছেড়ে পাড়ি দেয় দূরশহরে। এদিকে আর্নির অস্বাভাবিক আচরণ দিনে দিনে বাড়তে বাড়তে শেষে একদিন মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। এলাকার জলের ট্যাঙ্কের মাথায় চড়ে বসার জন্য স্থানীয় পুলিশ গ্রেফতার করে তাকে। সেই শুনে তাদের স্বেচ্ছানির্বাসিত অসুস্থ মা থানায় যান তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসার জন্য — নিজের চেহারা ও জীবনযাপনের জন্য প্রতিবেশীদের হাসির খোরাক হ’ন প্রত্যাশামতোই।
বাড়ি ফিরে সব জেনে গিলবার্ট সামলাতে পারে না নিজেকে, অসুস্থ ভাইয়ের গায়ে হাত তোলে — তারপর অনুশোচনায়, আত্মগ্লানিতে যেন মরে যায় তার জন্য। সেই অশান্ত সময়ে আর্নিকে সামলে রাখে বেকি। আর মাকে সামলে রাখে গিলবার্টের দুই বোন।
গিলবার্ট বাড়ি ফেরে। বেকির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয় মায়ের। নিজের অসহিষ্ণুতার জন্য ক্ষমা চায় পরিবারের কাছে, মায়ের কাছে, আর্নির কাছে। মা ক্ষমা করে দেন। তারপর, চোদ্দ বছরে যা করেননি, তাই করেন। ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ওঠেন, যে ঘরে আত্মহত্যা করেছিলেন স্বামী — সেই ঘরে ঢোকেন। ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়েন খাটে।
অনেক পরে আর্নির ডাকাডাকিতে যখন মা আর ওঠেন না, সকলে বোঝে, বাবার কাছেই চলে গিয়েছেন তিনি।
শেষকৃত্য করা প্রয়োজন। কিন্তু ঐ স্থূলকায় শরীরকে নিচে একতলায় নামিয়ে আনা সম্ভব হয় না পরিবারের পক্ষে।
পুলিশ আসে। তারাও বিফল হয়। পরের দিন ক্রেন এনে নামানো হবে দেহ —- এই বলে তারা চলে যায়।
ভাইবোনেরা মনশ্চক্ষে মায়ের মৃতদেহের হেনস্থা দেখে, প্রতিবেশীদের টিটকিরি কল্পনা করে আর সারারাত জল্পনার পরে নেয় তাদের জীবনের কঠিনতম সিদ্ধান্ত — একসঙ্গে।
তারা সমস্ত আসবাবপত্র বাড়ির বাইরের মাঠে এনে জড়ো করে। তারপর মায়ের দেহ আর বাবার স্মৃতি সুদ্ধ জ্বালিয়ে দেয় গোটা বাড়িটা।
এর পরে এক বোন রাঁধুনির চাকরি নিয়ে চলে যায় অন্য শহরে। অন্য বোন পড়াশোনা শেষ করতে আরেক শহরে পাড়ি দেয়। মফস্বলের হাইওয়ের ধারে হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে থাকে গিলবার্ট আর আর্নি। বেকি আর তার ঠাকুমার ক্যারাভান ততদিনে মেরামত হয়ে গিয়েছে। তাদের গন্তব্যে যাওয়ার পথে তারা গাড়িতে তুলে নেয় দুই ভাইকে। সামনের অনিশ্চিতের দিকে তাকিয়ে গিলবার্ট শান্তভাবে তার ভাইকে বলে — We can go anywhere.
আজ চিরন্তন মনখারাপের আবহে কেন এই তিরিশ বছরের পুরোনো সিনেমার অবতারণা?
গিলবার্টের জুতোয় সে-ই কোনকাল থেকে আমার পা গলানো রয়েছে। ওর নিঃসঙ্গ বিপন্নতার শরিক কবেই তো হয়ে গিয়েছি নিজেরই অজান্তে।
এখন ইচ্ছে করে আমার আশপাশের পৃথিবীটাও ছোটা থামিয়ে একটু হাঁটুক — যেদিকে দু’চোখ যায়, সেদিকে চলে যাবার মতো ছন্নছাড়া রোমান্টিকতা আসুক মানুষের মনে একটু। ক্ষণস্থায়ী হলেও আসুক — ফিনিশিংএ পৌঁছতে খুব দেরি বোধহয় হবে না তাতে।
চৌদিকে এত আলো, আনন্দ উদযাপন, জীবনটাই রঙিন পসরা হয়ে গিয়েছে, সেই রঙ্গমঞ্চে নিরানন্দের মলিন বেখাপ্পা আলখাল্লা দুলিয়ে আমার প্রবেশ কেউই ভাল চোখে দেখবেন না জানি। আড়ালে আড়ালে, হয়ত বা প্রকাশ্যেই আমার মানসিক স্বাস্থ্য আর অসামাজিকতা নিয়ে কানাকানি হবে, নিন্দামন্দ করবেন চেনা আধচেনা আত্মীয়বন্ধু, প্রতিবেশীরা।
আমার আয়নাতে সবাই নিজেকে দেখবেন এমন মূর্খ দুরাশা আমার নেই। ডিপ্রেশন মহামারী হতে চলেছে আগামী দশকে, শহরের থেকে বেশি মফস্বলী গ্রামাঞ্চলে — দেশি, বিদেশি বিভিন্ন সমীক্ষায় উঠে আসছে এমন তথ্য — নির্বোধ পন্ডিতম্মন্যের মতো সেসব মনে করিয়ে দিয়েও আমার কোনো লাভ নেই।
শুধু বলি, আনন্দের মতো দুঃখিত হবার অধিকারও গণতন্ত্রে স্বীকৃত। কেউ ঝলমলে যাপনের ছবি এঁকে বেড়াতেই পারেন সর্বক্ষণ, তাতে যদি আমি আপত্তি জানাই, আমার কান কেটে নেওয়া উচিৎ। সেই রকম আমি যদি অবসাদবশে কিছু এলোমেলো কথা লিখে ফেলি, ভাল না লাগলে (না লাগার সম্ভাবনা ১০০%) এড়িয়ে যাবেন দয়া করে — বিচার করতে বসলে একটু অগণতান্ত্রিক হবে। গিলবার্টের একটি মানসিক প্রতিবন্ধী ভাই ছিল, সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়াল ছাড়া আমার সত্যিই কেউ নেই আর।
Rahul, তোর কাছে কৃতজ্ঞ — বারো বছর আগে এই ছবিটার কথা বলেছিলি আমায়। দেখেছি আরো বছর চারেক পরে। আলাপ হয়েছে আমার প্রিয়তম দুই নক্ষত্রের অভিনয়ের সঙ্গে। জনি ডেপ এবং লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও।
ধন্যবাদটা পাওনাই ছিল তোর। 😊