আমাদের বুড়ো ডাক্তার শূন্য খুপরিতে বসে আছেন। নিয়নের আলো ওনার নিটোল টাকে পড়ে পিছলে যাচ্ছে। বাইরে ওনার পিসিমা থুড়ি সুন্দরী রিসেপশনিস্ট চোখ বন্ধ করে একটি জনসন বাড দিয়ে কান খোঁচাচ্ছেন। এমন সময় বাইরে প্রচুর চিৎকার শোনা গেল – “আছে আছে হাতুড়ে এখনও আছে…”
আমাদের বুড়ো ডাক্তার রোগীর সঙ্গে হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের মতো করে সব জিজ্ঞেস করেন – চোখের পাতা টেনে দ্যাখেন- বুকে আঙ্গুল বসিয়ে টরেটক্কা করেন এবং হাতুড়ি ঠুকে ঠুকে রোগীর হাঁটু টাঁটু খুলে নেওয়ার চেষ্টা করেন, তাই লোকে ওনাকে হাতুড়ে বলে ।
এক রোগীকে (এখানে লিঙ্গভেদ বা বয়সের বিবরণ দেওয়া হবে না – পাঠক নিজেকেই এই জায়গায় বসাতে পারেন ) নিয়ে বাড়ির লোকজন উত্তেজিত হয়ে হাত পা নেড়ে বলতে থাকলেন–“ হাতুড়েদা৷ গতকাল সন্ধেবেলা রোগীর ঘাড়ে ব্যথা হয় – হাতপা তাজ্ঝিম মাজ্ঝিম করতে থাকে, তখন আমরা সবাই মিলে পাশের দোকানে গিয়ে প্রেশার মাপাই…”
দ্বিতীয়জন খেই ধরেন–“দোকানে প্রেশার মাপে একশো ষাঠ নব্বুই – ওনার তো এমনিতেই লো প্রেশারের ওষুধ চলে… (আমাদের বুড্ঢা খাবি খান – এটা ওনার ফান্ডার বাইরে)
তৃতীয় ধারাবিবরণী শুরু হয়– “তাপ্পর ওনাকে নিয়ে পাশের দোকানে যাই… (বক্তা চোখ কপাল ছাড়িয়ে সিঁথির ভেতরে সেঁধিয়ে বলতে থাকেন), ওমাগো…. তখন পেশার বেড়ে দুশো বাই একশো, ব্যস সোজা হাসপাতাল–সোজা আইসিইউতে – ওখানে স্যালাইন ট্যালাইন চালিয়ে রেখেছিল…(স্যালাইন শুনে হাতুড়েদা হাতে চ্যানেলটা দেখে নিজের চোখও টাকের টংএ চড়িয়ে ফ্যালেন), তারপর বড়ো ডাক্তার সাহেব বললেন যে ওনাকে এখন ক’দিন অবজারভেটরিতে রাখতে হবে, তাই আমরা চলে এলাম…হাতুড়েদা, আমরা গরীব মানুষ।”
এরপর সবাই সমস্বরে চ্যাঁচাতে থাকে–“হাতুড়েদা, ইদিকে দেখুন রোগী চোখ উল্টে দিচ্ছে কির’ম হাঁসফাঁস করছে, ওমাগো এই বুঝি গেলো…”
ডাক্তার বাড়ির একজন আর সঙ্গের একজনকে রেখে বাকিদের ঠেলে খুপরি থেকে বার করে ক্যাঁচকোঁচ শব্দে দরজা বন্ধ করে হাঁফ ছাড়েন।
“কি মশয় (বুড়ো নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকেই মশয় বলেন,) এবার আপনাকে দেখা যাক, কি বলেন?”
রোগী গোলগোল চোখে ডাক্তারের মুখপানে চেয়ে থাকেন।
ডাক্তার ঐ সঙ্গের দুজনকে বলেন– “আপনাদের মধ্যে কেউ নাড়ি মানে পালস দেখতে পারেন?”
সমঝদার সঙ্গী বলেন–“হ্যাঁ পারি।”
ডাক্তার ইতিমধ্যে দেখেছেন রোগীর নিশ্বাস প্রশ্বাসের হার কমে স্বাভাবিক হয়ে গেছে এবং দেখেও একটু স্বাভাবিক লাগছে। ডাক্তার ঘোষণা করেন–“আপনি মশয় এখনই মরছেন না।”
সমঝদার জানান উনি নাড়ি পেয়েছেন। ডাক্তার চমৎকার রকমের খুশি হয়ে ওঠেন। এবার উঠে রোগীর হাতে যন্ত্রের ফিতে বাঁধতে শুরু করেন–“মশয়, গতকাল আপনি ধান্যকুড়ির মোড়ে কার সঙ্গে কপাকপ ফুচকা সাঁটাচ্ছিলেন?”
রোগী পরম বিষ্ময়ে আঁৎকে ওঠেন–“ আমি …. আমি?”
ডাক্তার একটা মিচকেপটাশের মতোন হাসি দিয়ে বলেন–“আপনি …… আপনি নন ?” বলছেনও বটে, ফুসফুস করে ফিতেয় পাম্প করে করে হাওয়াও ভরছেন ।
“আজ্ঞে, আমি সারা জীবনেও ফুচকা খাইনা।”
ইতিমধ্যে সমঝদার মশয় বললেন–“হাতুড়েদা, আর আমি পালস পাচ্ছি না।”
ডাক্তার হাওয়া ছাড়তে ছাড়তে ( কোনও খারাপ অর্থে ধরা চলবে না ) বলেন–“কতোয় আবার নাড়ি পান সেটা যন্ত্রে দেখে বলুন” আর রোগীকে বলেন “কী মুশকিল আমার তো মনে হলো ওটা আপনিই বটে …. একই ড্রেস …”
রোগী বলেন “ কাল আমি গোবরডাঙায় ছিলাম…
আমার বলে গ্যাসের ব্যামো… হুঃ ধান্যকুড়িতে ফুচকা…হাঃ”
সমঝদার বলেন–“একশো বাইশ হাতুড়েদা,… এটাই কি ওপরের প্রেশার ? কিন্তু কিন্তু কিন্তু … একটু আগেই যে বড়ো ডাক্তারবাবু বললেন…….”
সব সুস্থির হলে রোগী বললেন–“হাতুড়েদা, এটা কি ব্যাপার হলো .. যদি টুকুসখানি বুঝিয়ে বলেন..”
ডাক্তার একটু নাক খুঁটে নিয়ে বলতে আরম্ভ করেন–“আমাদের শরীরের প্রয়োজন অনুযায়ী রক্তচাপ ঠিক রাখে এই সব ধমনী আর শিরা গুলো – হৃদপিণ্ড একটা নির্দিষ্ট চাপে বা শক্তিতে রক্তটাকে ধমনী দিয়ে পাঠাচ্ছে ; এবার বলুন তো ধমনী যদি রবারের হতো তাইলে রক্তের চাপে ওগুলো বেলুনের মতো ফুলে উঠতো, আবার যদি লোহার হতো তাহলে হাত পা নাড়তে পারতাম না, আরও ম্যালা ঝামেলি হতো – তাই না?”
সক্কলে সম্মতিসূচক মুন্ডু নাড়ে ।
বকবক্তা ডাক্তার বকবকানি চালিয়ে যান– “এগুলো পেশী দিয়ে তৈরি, মানে মাসল দিয়ে।”
একজন বাড়ির লোক সামান্য প্রতিবাদ জানান–“মাশুল? এই সব শিরাগুলো?” বলে নিজের বাইসেপ্সে হাত বোলান।
হাতুড়ে বলতে থাকেন– “এরা চেপে ধরলে হৃদপিণ্ডকে বেশী জোরে পাম্প করতে হয় আর ঢিলে দিলে রক্তচাপ কমে যাবে। আসলে রক্ত কতটা চাপ দিয়ে নিজের রাস্তা তৈরি করে যেতে পারে, সেটাই রক্তচাপ।”
রোগী কিন্তু ভোলবার নয় “কিন্তু আমার কি হয়েছিল?”
ডাক্তার মৃদু গুরুজি মার্কা হাসি দিয়ে ফের শুরু করেন– “বলছি তো মশয়, অত তাড়া দিলে আমার সব গুলিয়ে যায়। শুনুন … সাধারণতঃ একশো ষাঠ রক্তচাপে আমাদের শরীরে কোন অসুবিধে বোধ হয় না। এখন কোনও কারণে আপনি ভয় পেলে বা উত্তেজিত হলে শরীরে অ্যাড্রিনালিন বলে একটা হর্মোন বেশী বেরোয়। এই হর্মোন মোটামুটি দশ সেকেন্ডের মধ্যেই একজনের রক্তচাপ দ্বিগুণ করে দিতে পারে – অনেক সময় ডাক্তার দেখাতে গেলে বা মেডিক্যাল সেট আপে গেলে রক্তচাপ বহুৎ বেড়ে যায়। এটাকে বলে হোয়াইট কোট সিন্ড্রোম বা হোয়াইট কোট হাইপারটেনশন, বাংলায় “সাদা জামার রক্তচাপ” বলা যায়। এটাই আপনার রোগ। এছাড়াও বয়সজনিত প্রাথমিক রক্তচাপ, অসুখজনিত রক্তচাপ–এসবও হয় । কিন্তু আর বকতে পারি নে বাপু – এবার ভালোমানুষেরা গাত্রোৎপাটন করুন দেখি।”
রোগী কিন্তু খুশি নন–“একটা প্রশ্ন ছিলো। এতে কোনো ক্ষেতি নেই তো?”
ডাক্তার খ্যাঁকশেয়ালের মতো একটুখানি হেসে বলেন–“দেখে তো মনে হচ্ছে বিয়ে হয়েছে, সঙ্গমের চূড়ান্ত সময়ে আমাদের প্রেশার অনেক অনেক বেড়ে যায়। জানেন কি?”
সকলেই লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললেন ।
রোগীর বাড়ির লোক হাত জোড় করে বলেন–“হাতুড়েদা আপনি ভগবান।”
ডাক্তার গম্ভীর হয়ে বলেন–“ভগবান? ভগবানের ইংরেজি কি?”
সবাই সমস্বরে বলে–“গড গড গড”
ডাক্তার হেসে বললেন–“উল্টে দেখুন পাল্টে গেছে”
chomtkar
আমার লেখা সার্থক হলো ।
অনেক সময় এই রকম temporary pressure বাড়লেও ডাঃ ওষুধ দিয়ে whole life খেতে বলেন সেটা কি ঠিক ।
ডাক্তারবাবুর সঙ্গে কথা বলুন
সুন্দর পরিবেশন। উচ্চ রক্তচাপ সম্বন্ধে এই রকম আরও বিস্তারিত লেখা চাই।
অবশ্যই আসবে । নজর রাখুন ।
ভালো লাগলো।
ধন্যবাদ
দারুন দারুন। আমার ভয়ও কমল খানিক কারন কদিন আগে ওষুধের দোকানে প্রেসার মাপতে গিয়ে দেখি ১৫০/১০০এমএম এইচজি। দোকানদার বললেন ডাক্তারবাবুকে দেখাতে। এমনিতেই অ্যামলো ৫ খাই। শুনে এট্টু ভয় লেগেছিল বটে। এখন বুঝলাম, প্রেসার মাপতে গেলে আমারও বোধহয় হোয়াইট কোট হাইপারটেনশন হয়। থ্যাঙ্কু ডাক্তারবাবু।
খুবই স্বাভাবিক
আপ্লুৎ হলাম
Like!! Really appreciate you sharing this blog post.Really thank you! Keep writing.
ধন্যবাদ
I learn something new and challenging on blogs I stumbleupon everyday.
I like this website very much, Its a very nice office to read and incur information.
ধন্যবাদ