বছরের শুরুটা খুব সুবিধের হলো না। ইথার তরঙ্গে শুভেচ্ছা বার্তায় ভেসে যেতে যেতে, সেই সোশ্যাল মিডিয়াতেই প্রথম খবর পেলাম সৌরভ গাঙ্গুলির আকস্মিক অসুস্থতার।
তারপর সন্ধ্যে না গড়াতেই সব জানা অজানার সীমানা ভেঙে দিয়ে পপুলিস্ট টিভি চ্যানেল চিকিৎসকদের প্যানেল বসিয়ে দিল বোকাবাক্সের স্ক্রিনে, হৃদযন্ত্রের মডেল সমেত। আর সব্বাই চালাক হয়ে বুঝে গেল, কাকে বলে মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন (ইনফ্র্যাকশন নয়), কি করেই বা হৃদধমনীতে ‘প্লাক’ জমে ব্লকেজ হয়, আর রক্ত চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হলেই যে বুকে ব্যথা হয়, আর বেশি বাধাপ্রাপ্ত হলে যে তাৎক্ষণিক ‘ব্ল্যাক আউট’ বা জ্ঞানলুপ্তি ঘটে, এ কথা সেরেল্যাকখোর শিশুও জেনে গেল রাত আটটা বাজতে না বাজতেই।
সমস্ত মেডিক্যাল এথিক্সের মুখে ‘একুশে আইন’এর ঝামা ঘষে, রোগীর ইসিজি রিপোর্ট, ইকো-কার্ডিয়োগ্রাফি রিপোর্ট, মায় অ্যাঞ্জিওগ্রামের ফলাফল, স্টেন্টের সংখ্যা ও উপকারিতা, সব কিছুর প্রকাশ্য বুলেটিন প্রচার করে ফেলল ‘ফাইভ স্টার’ হাসপাতাল — সেলিব্রিটি বলে কথা, এ তো যে-সে রোগী নয়! তিনি কখন চা বিস্কুট খেলেন, কি দিয়ে ডিনার সারলেন, মহামান্য রাজ্যপালকে দেখে কতটা ঘাড় হেলিয়ে হাসলেন, সব কিছুর ‘লাইভ কভারেজ’ না দেখলে যে জনগণের হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে রে ভাই!
যাই হোক, এত ডামাডোলের মধ্যে কাজের কথাটি কিন্তু তুলে ধরলেন আমাদের মুখ্যমন্ত্রী। খুব সঙ্গতভাবে প্রশ্ন তুললেন, একজন ক্রীড়াবিদ, যার বয়স এমন কিছু বেশি নয় এবং আপাতদৃষ্টিতে যাঁকে যথেষ্ট সুস্থ এবং ‘ফিট’ বলে মনে হয়, তাঁর হৃদযন্ত্রের এমন মারাত্মক গোলযোগ হলো কি করে?
ভীষণ জরুরি প্রশ্ন।
হরেক তত্ত্ব উঠে এলো নানা বিশেষজ্ঞের আলোচনায়। তার মধ্যে প্রধান বিষয় তিনটি। এক, তাঁর পারিবারিক হৃদরোগের ইতিহাস। দুই, নিয়মিত খেলা ছেড়ে দেবার পরে তাঁর লাইফস্টাইল। তিন, কোনো বিশেষ ক্ষেত্রে (পড়ুন রাজনীতি) যোগদানের ব্যাপারে তাঁর সাম্প্রতিক মানসিক চাপ।
প্রথম বিষয়ের উপর কোনো মানুষের হাত থাকে না — কেউ নিজের বংশ নির্বাচন করতে পারে না।
কিন্তু দ্বিতীয় এবং তৃতীয় পয়েন্ট? এখানেই বিশ্বায়নের সমুদ্রমন্থনের ফলাফল নজর করা যায়।
দেশের প্রাচীর ভেঙেছে বিশ্বায়ন, অর্থনীতির ‘মেগ্যালোম্যানিয়া’ র হাত ধরে এসেছে উন্নয়ন, আর্থিক সুস্থিতি, বহির্বিশ্বের অধরা মাধুরী মুঠোয় এসেছে আমাদের মতো তথাকথিত ‘তৃতীয় বিশ্বের’ দেশগুলোর। ‘উন্নতশীল’ লাফ দিয়েছে ‘উন্নত’ হবার সিঁড়ি ভাঙবার জন্য। জোয়ার এসেছে আধুনিক জীবনযাপনে, প্রযুক্তিতে, শিক্ষায়, শিল্পবাণিজ্যে, পর্যটনে। আর হ্যাঁ, স্বাস্থ্যেও।
জীবন ছুটেছে উন্নয়নের রাজপথ ধরে, ফেলে দিয়ে পুরাতনী ক্রাচ, এখন মূলমন্ত্র হচ্ছে ‘লিভ লাইফ লার্জ সাইজ’!
প্রান্তিক স্তরের মানুষের কাছেও পৌঁছেছে বিশ্বায়নের চুঁইয়ে পড়া মধু! তাই মফস্বলেও এখন চলে কার্নিভ্যাল, দুগ্গাঠাকুরের থিমপুজো, নিউ ইয়ার ব্যাশ, পৌঁছে যায় মাল্টিন্যাশনাল ফুড চেনের সম্ভার, খুলে যায় কর্পোরেট মলের দরজা, হাতে হাতে ঘোরে স্মার্টফোন, আন্তর্জালের মায়ায় জড়িয়ে পড়ে আট থেকে আশি! পার্টি মানে গ্রামের মানুষ এখন কেবল লাল সবুজ গেরুয়া পতাকা বোঝে না, ঝালরওলা টুপি, বিবিধ সুখাদ্য সহযোগে মাতাল হওয়ার বচ্ছরকার মোচ্ছবও বুঝে যায় ঠিক।
এর সবটাই খারাপ, এমন কথা কেন বলব? সমুদ্রমন্থনে তো অমৃতও উঠেছিল, কেবল গরল তো ওঠেনি। কিন্তু, অর্গল ভাঙা স্বাধীনতার একটি অসুবিধাও রয়েছে যে! ভাল থাকার হাত ধরে এসেছে টার্গেট পূরণ, যেনতেন প্রকারেণ সফল হয়ে, সাফল্যের কেন্দ্রবিন্দুতে কায়েমি হয়ে থেকে যাওয়ার চাপ, মানুষের গগনচুম্বী প্রত্যাশা — নিজেরই কাছে, নিজের সাধ্যের হিসেব না কষেই। ফলশ্রুতি, একাকিত্ব, স্বার্থপরতা, অন্তঃসারশূন্য জাঁকজমকে নিজেকে ডুবিয়ে রেখে ভুলে থাকার চেষ্টা করা, না পেরে শেষ পর্যন্ত অবসাদে তলিয়ে যাওয়া।
আর এসেছে রোগব্যাধি। সীমানা মানেনি তারাও। চলে যাওয়া বছরটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছে, মারীর মুখে দেশ-বর্ণ-অর্থ নির্বিশেষে মানুষ কত অসহায়।
তবু, আমরা কিছু শিখেছি কি? উত্তর, না। জ্ঞানপাপী সবজান্তারা কিছু শেখে না। তাই, টিভির পর্দায়, একজন সফল খেলোয়াড়ের কি করে হার্ট অ্যাটাক হয়, এই নিয়ে আন্তরিক অনুসন্ধানের চেয়েও বড় হয়ে ওঠে এই বিজ্ঞাপন, যে ‘গোল্ডেন আওয়ারের’ মধ্যে চিকিৎসা ব্যবস্থার ছাতার তলায় নিয়ে আসা গেলে, একদিনের মধ্যেই হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হওয়া থেকে, চা খেতে খেতে ভিজিটরদের সঙ্গে খোশগল্প করার মতো পরিস্থিতিতে পৌঁছে যাওয়া কোনো ব্যাপারই নয়।
অতএব, বড়লোক নিরাময়ের চাবিকাঠির রেস্ত রেডি রাখবেন, মধ্যবিত্ত আর গরিব মানুষ সব কাজকর্ম ছেড়ে ‘স্বাস্থ্যসাথী’ আর ‘আয়ুষ্মান ভারতে’ নাম লেখাতে ছুটবেন, বীমার রমরমা হবে, আমরা নতুন লব্জ মুখস্থ করব — হাই কোয়ালিটি কিওর ইজ মাচ বেটার দ্যান প্রিভেনশন।
সমুদ্রমন্থনের পরে, দেবতাদের নিশ্চিন্ত করতে নীলকন্ঠ শঙ্কর এগিয়ে এসেছিলেন। এই আত্মঘাতী মানবজাতি নিজেরাই ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং মহেশ। অমৃত এবং বিষ, দুই-ই চেটেপুটে খেতে এদের লোল রসনা শকশক করছে। এদের বাঁচায় কে?
ভালো লেখা।