এই লেখাটা লেখার ইচ্ছা অনেকদিনের। কিন্তু লেখা হয়ে ওঠে না। লেখার জন্য মানসিক স্থিরতা দরকার, আজকাল বিশেষ পাই না। সময় দরকার, জোটে না। তাও ট্রেনে-মেট্রোতে ঝুলতে ঝুলতে যদি বা কিছু লিখে ফেলি, বিদ্বজনেদের তা বিশেষ পছন্দ হয় না, আকারে ইঙ্গিতে অনেক তির্যক মন্তব্য শুনি- সত্যিই ডাক্তারদের বন্ধু জোটে না, শত্রু বাড়িয়ে লাভ কী!
কিন্তু কিছু কথা না বলতে পারলে প্রগলভ মানুষদের মনের খচখচানি যায় না, সেটা নিয়ে বেশিদিন চললে আবার গ্যাস মাথায় উঠে যাওয়া ইত্যাদি হতে থাকে- তাই না লিখেও গতি নেই।
এরই মাঝে জীবনে প্রথম বার এক ভাইকে প্রায় এক ঘন্টা ধরে বোঝালাম কেন তার এম.বি.বি.এস. পড়া অনুচিত- আগে মজা করে বলতাম, এখন বেশ প্রত্যয়ের সঙ্গেই বলেছি, যা বলেছি নিজে প্রতি মুহূর্তে অনুভব করেছি- তাতে এক ফোঁটা ভেজাল ছিল না। সদ্য মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হলো- এই সময়েই মানুষ নিজের জীবনের গতিপথ মোটামুটি নির্ধারণ করে নেয়, তাই লেখাটা লেখার ইচ্ছা কয়েকাংশে বেড়ে গেল আর কি!
আসলে আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা মানুষদের শৈশবের শিক্ষার একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ থাকে ‘ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করা’। কয়েকশ’ বই ঘেঁটে ‘তোমার জীবনের লক্ষ্য’ রচনায় ডাক্তার হওয়ার শপথগ্রহণ আর মনে মনে ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’ জপ করতে করতেই ডাক্তারি পড়ার স্বপ্ন দেখি আমরা, অন্তত আমি সেটুকুই দেখেছি।
খুব মনে পড়ে মেডিক্যাল কলেজে প্রথম প্রথম ওপিডি-র লাইন দেখে খুব মন খারাপ হয়ে যেত, মানুষের এত দুঃখ-কষ্ট- যেন চোখে দেখা যায় না! ভাবতাম মন দিয়ে পড়াশোনা করে একদিন মানবতার এই কষ্টের অবসান ঘটাবো ইত্যাদি ইত্যাদি। আজ এসএসকেএমে মানবসাগর লঙ্ঘন করে রোজ ডিউটি যাচ্ছি, দিনগত পাপক্ষয় করছি- নির্বিকারে। জরা-ব্যাধি মানবজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, শাশ্বত সত্যও বটে। এর কুল-কিনারা স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ পাননি, আমরা তো কোন ছাড়!!
সর্বপ্রথম আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা প্রয়োজন। আমরা ঠিক কোন স্তরে পরিবর্তন আনতে চাই! ব্যক্তিজীবনে নাকি সমাজজীবনে! যদি সমাজজীবনে পরিবর্তন চাই আর ভেবে থাকি আমাদের পড়াশোনা, আমাদের বিনিদ্র রজনী, আমাদের স্বেদ-রক্ত এই অসীম সংখ্যক রোগীর জীবনে পরিবর্তন আনবে- তাহলে আমরা মূর্খের স্বর্গে বাস করছি। প্রতারণার মাধ্যমে রাজনীতি হতে পারে, সমাজের মঙ্গলসাধন সম্ভব নয়। তাই নিজেদের সঙ্গে প্রতারণা না করে আমাদের সত্যের সম্মুখীন হওয়া প্রয়োজন। মডার্ন চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যয়সাপেক্ষ, সমাজের সর্বস্তরে তার বিস্তার চাইলে সরকারি সহযোগিতা আবশ্যক। আমি পাঁচ টাকায় রোগী দেখে দিলাম, পাঁচ জায়গায় মেডিক্যাল ক্যাম্প করে দিলাম, এটা কোনো দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হতে পারে না। তাছাড়া এতে ঔষধের দাম কমে যাবে না, স্টেন্ট-পেসমেকার-ইম্প্ল্যান্টের দাম কমে যাবে না, ল্যাব টেস্টের খরচ কমে যাবে না। বলা বাহুল্য স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বরাদ্দের করুণ অবস্থা দেখে এই পরিস্থিতির কিছুমাত্র উন্নতি সম্ভব বলে মনে হয় না। আর মানুষই বা কী চায়! নিজেদের স্বাস্থ্যের জন্য কোনোদিন দাবি এরা তোলেনি। প্রিয়জনের অসুস্থতায় যদি বা এরা বিচলিত হয়, হার্ট অ্যাটাকের রোগীও হাসপাতালে বেড না পেলে বলে ‘মেঝের এক কোণায় ভর্তি করে রেখে দিন’। নিজেদের স্বাস্থ্যের প্রতি এত ঔদাসীন্য অন্য কোনো দেশে আছে কিনা আমার জানা নেই।
এসবের বাইরে উঠে চিকিৎসাকে কম খরচসাপেক্ষ করতে দরকার দু’টো জিনিস। এক, জনস্বাস্থ্যের উন্নতি, দুই, কিছু মৌলিক গবেষণা।
আমাদের দেশে জনস্বাস্থ্যের ব্যাটন আমলাদের হাতেই সীমাবদ্ধ। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের এতটাই পেছনের সারিতে রেখেছি আমরা, যে মহামারীর সময়েও কোন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞকে আমরা যুদ্ধের সেনাপতি হিসেবে পাইনি। মৌলিক গবেষণার মাধ্যমে চিকিৎসা বিজ্ঞানে যুগান্তর সম্ভব, তবে তার সম্ভাবনা এদেশে সীমিত। এই মুহূর্তে দু’জন বাঙালি ডাক্তারের কথা মনে পড়ছে যাঁরা সত্যিই যুগান্তকারী আবিষ্কার করেছেন- ডা. দিলীপ মহলানবীশ আর ডা. সুভাষ মুখোপাধ্যায়। প্রথম জনের নাম ক’জন শুনেছেন জানিনা, আর দ্বিতীয় জনের মতো পরিণতি কারো হোক, এটা কেউই চাইবেন না। এদেশে গবেষণাধর্মী কাজকর্মকে উৎসাহপ্রদান হয়নি, হবে বলে মনেও হয়না।
বৃহত্তর সমাজে না হোক, অন্তত নিজের রোগীদের ব্যক্তিজীবনে পরিবর্তনের চেষ্টা করেছি। বই পড়ে বলেছি মাসে আধ লিটার ভোজ্য তেল বরাদ্দ করবেন। উত্তর এসেছে, রান্নার লোক রান্না করে, ওরা বলে ‘তেল না দিয়ে কি জলে মাছ ভাজবো’!! সুগারের ঔষধ খসখস করে লিখে দিলে লোকে খেয়ে নেবে, কিন্তু এক নম্বর ঔষধ ডায়েট আর আধ ঘন্টা করে হাঁটা- তাতে অধিকাংশ মানুষ রাজি নন। আজকাল তো লোকজন হাসপাতালেও বিড়ি ধরিয়ে সুখটান দিচ্ছে, আপত্তি করলে তারা এমন ভাবে তাকায় যেন বাইরে পেলে দেখে নিতাম। সেদিন একজন রোগী কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট নিয়ে ইমার্জেন্সি এলো, তাকে তুলে নিয়ে আইসিসিইউ-তে গেলাম, তেড়ে সিপিআর দিলাম- ততক্ষণে সে অন্য লোকে চলে গেছে, তবে তার পকেট থেকে বেশ এক প্যাকেট বিড়ি সিপিআরের ধাক্কায় বাইরে এসে পড়লো- আমার দিকে তাকিয়ে যেন পরিহাস করছে!
কোনো জনদরদী সরকার এসব মদ-বিড়ি বন্ধ করবে? আদি অনন্তকাল থেকে এসব চলে আসছে, মেনে নিতে হবে আমাদেরও। লোকে বিড়ি খাবে, হার্ট অ্যাটাক হবে, আমরা ঔষধ দেব, স্টেন্ট বসাবো, নিজেদের ভগবান ভাববো। কিন্তু এই বিষবৃক্ষের গোড়া কাটবো না। সত্যি বলতে এই যান্ত্রিক ডাক্তারির জন্য এমন কিছু মেধা লাগে না। যে মনীষা নিয়ে লোকজন ডাক্তারি পড়তে আসে, তা দিয়ে বুঝি অন্য অনেক মঙ্গলকর কাজ সমাধা হতো।
আগে ডাক্তারের সম্মান ছিল, মূল্য ছিল। কারণ ডাক্তার ছিল কম। ইংরেজ দণ্ডমুন্ডের কর্তাও অগ্নীশ্বর মুখার্জিকে তোয়াজ করতো, কারণ বিকল্প কেউ ছিল না। এখন প্রত্যেক রাজপথে মেডিক্যাল কলেজ। লক্ষ লক্ষ ডাক্তার বেরোচ্ছে। আজ শুধু ডাক্তারের ডাক্তারির জন্য কোনো পয়েন্ট নেই। সেই ডাক্তার সরকারপন্থী কিনা, তাকে দিয়ে নিজেদের মতো কাজ করিয়ে নেওয়া যাবে কিনা, সে মিডিয়াকে তোয়াজ করে কিনা, নেতামন্ত্রীর ডাকে সে ছুটে যাবে কিনা- এরকম অনেক অলিখিত শর্ত আস্তে আস্তে ঢুকে যাচ্ছে একজন ডাক্তারের সাফল্যের পেছনে। আমি রাজি না হলে, অন্য লোক আছে।
আর প্রাইভেট চেম্বার? দুয়ারে মেডিক্যাল কাউন্সিল আসছে। নিজের স্বাধীন প্র্যাকটিস কতদিন স্থানীয় কর্তৃপক্ষের চোখরাঙানি পেরিয়ে চলবে সে নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে।
তবে সবই কি অন্ধকার! তা নয়। একজন মুমূর্ষু রোগী যখন বাঁচবে, ভালো লাগবে। বাঁচাতে পেরে নয়, বাঁচা-মরা আমাদের হাতে নেই এটুকু বিশ্বাস এতদিনে দৃঢ় হয়েছে। তবে এই ভেবে ভালো লাগবে যে ঈশ্বর এই বাঁচানোর কাজটার জন্যে আমাদের বেছে নিয়েছেন। শুধু এইটুকু ভালোবাসা সম্বল করে এই শত-সহস্র পঙ্কিলতাকে পেরিয়ে যাওয়ার ইচ্ছাটুকু থাকলে ডাক্তারি তোমার, নয়তো এই পাড়ায় কোনো সুস্থ মানুষের আসা উচিত নয়।।
স্যার আপনার লেখাটি আমার মন ছুঁয়ে গেলো… ডাক্তার সত্যি ভগবানের এক রূপ …