দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি বিশেষ ১৬
প্রায় কুড়ি বাইশ বছর আগে, এক প্রখর গ্রীষ্মের অপরাহ্নে দীর্ঘ আউটডোর আর অপারেশন শেষ করে, হাসপাতাল থেকে ঘরে গিয়ে খেতে বসেছি, দূরভাষের তীব্র আর্তনাদে উঠতে হলো। খবর এলো কর্মরত অবস্থায় দুর্ঘটনাগ্রস্থ ( injured on duty ) একজন রোগী এখনই হাসপাতালে আসছে। তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে হাসপাতালে পৌঁছলাম। খবর পেলাম একজন মোটর ড্রাইভার পথ দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে, তাকেই আনা হচ্ছে। অনতিবিলম্বেই রোগী হাসপাতালের জরুরী বিভাগে পৌঁছলেন। ওখানে আগেই বলা ছিলো। এক্স রে ইত্যাদির পর ওঁকে সোজা অপারেশন থিয়েটারে আনা হলো। দেখি বছর চল্লিশেকের এক তরুণ যাঁর শরীরের ডানদিকটি দুর্ঘটনায় দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ। রক্তাপ্লুত ওই যুবকের ডান কনুই, ঊরুর হাড় এবং পায়ের দুটি হাড়ই ভেঙে গেছে। সেই সঙ্গে কনুই, ঊরু আর পায়ে বড় বড় ক্ষত হয়েছে। কনুইতো ভেঙে একদম চুরমার হয়ে গেছে। ডাক্তারি পরিভাষায় যাকে বলে, compound comminuted fracture lower end right humerus, fracture shaft femur, fracture both bone right leg। ওঁর নাড়ির গতি খুবই ক্ষীণ, প্রচুর রক্তপাত জনিত কারণে রক্ত চাপ খুবই কম। অতি দ্রুত শিরায় প্রয়োজনীয় ফ্লুইড চালু করা হলো। রক্তের ব্যাঙ্ক থেকে রক্তের ব্যবস্থা করা হলো। ক্ষতস্থানগুলি মোটামুটি পরিষ্কার করে ওঁকে অপারেশন টেবিলে তুললাম। অ্যানাস্থেটিস্ট সহকর্মী অ্যানাস্থেশিয়া দিয়ে অজ্ঞান করে দেওয়ার পর সমস্ত ক্ষতস্থানগুলি খুব ভালো ভাবে পরিষ্কার করলাম। কনুইয়ের হাড় এতো টুকরো টুকরো হয়েছিল যে পরিষ্কার করার সময় যথেষ্ট সাবধানতা নেওয়া সত্ত্বেও দুতিনটি হাড়ের টুকরো টেবিলে খসে পড়লো। রাস্তায় দুর্ঘটনা বলে ক্ষতস্থানগুলি খুবই নোংরা ছিলো। অনেক সময় নিয়ে সব ধুলো,ময়লা, তেল,কালি পরিষ্কার করলাম। তারপর ক্ষতস্থানগুলির সমস্ত মৃত টিস্যু কেটে বাদ দিলাম, রক্তপাত বন্ধ করার জন্য ছিন্ন রক্তবাহী নালিকাগুলিকে সেলাই বা সিল করলাম । এবার ভাঙ্গা হাড়গুলিকে বসিয়ে বাঁধার পালা। এই ধরনের ক্ষতস্থানযুক্ত হাড় ভাঙ্গায় প্লেট বসানোর কোনো প্রশ্ন নেই। এক্সটার্নাল ফিক্সেটর নামক এক ধরনের যন্ত্র এইসব ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। আমি তিন জায়গায় তিনটি এক্সটার্নাল ফিক্সেটর ব্যবহার করলাম। প্রথমে কনুইয়ের জন্য একটি ফিক্সেটর লাগালাম। তারপর ঊরুর হাড় ভাঙ্গার জন্য আর একটি, এবং সব শেষে পায়ের ভাঙ্গা হাড়দুটির জন্য তৃতীয় ফিক্সেটরটি লাগালাম। এর পর ক্ষতস্থানগুলির চামড়ায় অল্প দুচারটি সেলাই দিয়ে, সেগুলি ব্যান্ডেজ করে দিলাম। উপযুক্ত অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবস্থা করা হলো। লম্বা অপারেশন শেষ করে যখন বাইরে এলাম তখন অনেক রাত হয়েছে। ডিউটি চলাকালীন আঘাত, কর্মচারীদের হাসপাতালে সব সময়ই একটু বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বেরিয়ে দেখি বেশ কয়েকজন কর্মচারী ও অফিসার তখনও অপেক্ষমাণ। কর্মী ইউনিয়নের নেতৃস্থানীয় দুচারজন ও রয়েছেন। ওঁদেরকে পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝিয়ে বললাম। বললাম ওঁনার অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক, এই অবস্থায় আমার যথাসাধ্য আমি করেছি। শরীর আর বইছিলো না, ক্লান্ত পায়ে বাড়ির পা বাড়ালাম। পরের দিন ওঁকে পরীক্ষা করে দেখলাম, অবস্থা মোটামুটি স্থিতিশীল। তৃতীয় দিনে আবার ওঁকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গিয়ে ড্রেসিং পরিবর্তন করলাম। এর থেকে একদিন অন্তর ওঁর ড্রেসিং পরিবর্তন করেছিলাম। ক্ষতস্থান গুলির পচে যাওয়া টিস্যু কয়েক বারই কেটে বাদ দিতে হয়েছিল। তারপর আস্তে আস্তে কনুই ও পায়ের ক্ষতস্থান গুলি শুকিয়ে আসতে লাগলো। কিন্তু আমার শত প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে ঊরুর ক্ষতস্থানটি কিছুতেই ভালো হচ্ছিল না। ক্রমশই ক্ষতটি বিষিয়ে উঠলো। ওখান থেকে গলগল করে পুঁজ রক্ত বেরিয়ে আসতে লাগলো। পুঁজের জীবাণুর কালচার ও অ্যান্টিবায়োটিক সেনসিটিভিটি পরীক্ষা করে অ্যান্টিবায়োটিক পরিবর্তন করলাম কিন্তু যথা পূর্বং তথা পরং। হাতের এবং পায়ের ক্ষত সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেলো আর হাড়গুলিও মোটামুটি ভালই জুড়ে গেলো। কনুই ও পায়ের ফিক্সেটর খুলে দিলাম। কিন্তু ঊরুর ক্ষতটি আমার চিন্তা বাড়িয়ে তুললো। রোগীর শরীরে বারংবার রক্তাল্পতা দেখা দিলো। রক্ত দেওয়া হলো। অ্যান্টিবায়োটিক পরিবর্তন করে, ক্ষতস্থান বারংবার পরিষ্কার করেও কিছু লাভ হলো না। ক্ষতস্থান থেকে পুঁজ বেরোতেই থাকলো। কখনও একটু কম, কখনও বেশি। এক্সটার্নাল ফিক্সেটরের রডগুলি কয়েকটি পিন দিয়ে হাড়ের সঙ্গে লাগানো থাকে। পিনগুলি চামড়ায় ছিদ্র করে হাড়ে ঢোকানো হয়। এইবার ওই চামড়ার ছিদ্রগুলি থেকেও পুঁজ বেরোতে শুরু করলো। এটা খুবই আশঙ্কাজনক একটি সমস্যা। এরপর পিনগুলি আস্তে আস্তে ঢিলে হয়ে যাবে আর হাড়ের টুকরোগুলিও নড়বড়ে হয়ে যাবে। ফলে ফিক্সেটর খুলে ফেলা ছাড়া কোনো গত্যান্তর থাকে না। এক্ষেত্রে একটিমাত্র রাস্তাই আমার সামনে খোলা আছে, হাড়ের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক সিমেন্টের নেল লাগানো। সমস্যা হচ্ছে যে এই নেল বানানোর কোন অভিজ্ঞতা আমার নেই। কোন দিন করিনি, কাউকে করতেও দেখিনি। দীর্ঘদিন ধরে রোগী ভর্তি রয়েছেন কিন্তু তার ক্ষত শুকোচ্ছে না। অবস্থাও মোটেই সন্তোষজনক নয়। একদিন এক ইউনিয়নের নেতা আমার সাথে দেখা করলেন। ‘ গণশত্রু ‘ ছবিতে রাজারাম যাজ্ঞিকের স্টাইলে টেবিল চাপড়ে রোগীর ভালো করে দেখভাল করার ‘ অনুরোধ ‘ করে গেলেন। রোগীর খারাপ কিছু হলে আমার কি হবে তা অনুক্ত কিন্তু প্রকটভাবে অনুমেয় রইলো। শেষ পর্যন্ত অ্যান্টিবায়োটিক সিমেন্টের নেল লাগানোই স্হির করলাম। বোন সিমেন্ট এবং ভ্যাঙ্কোমাইসিন অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবস্থা করা হলো। রোগীকে সব কিছু বুঝিয়ে বললাম । অ্যানাস্থেশিয়া দেওয়া হলে প্রথমে ক্ষতস্থানটি ভালো করে পরিষ্কার করলাম, ফিক্সেটরের রড খুলে হাড় থেকে পিনগুলি বার করে দিলাম । এরপর হাড়ের টুকরোগুলির প্রান্তগুলিও ভালভাবে পরিষ্কার করা হলো। এবার ঊরুর হাড়ের দৈর্ঘ্যের মাপ অনুযায়ী একটি সরু ‘K’ নেল বেছে নিলাম। একটি বাটিতে বোন সিমেন্ট পাউডারের সাথে অ্যান্টিবায়োটিক মেশানো হলো, তারপর সিমেন্ট গুললাম। আমি গ্রামের ছেলে। উত্তর ২৪ পরগনার এক প্রত্যন্ত গ্রামে আমার বাড়ি। ছেলেবেলায় গ্রামের মেয়েদের পাটকাঠির ওপরে গোবর মুঠো মুঠো করে লাগিয়ে ‘ বোড়েন ‘ বা ‘বোড়ে’ বানাতে দেখেছি, ওগুলো পরে রোদে শুকিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। আমিও সেই ভাবেই ওই কাদা কাদা সিমেন্ট নেলের গায়ে লাগালাম, তার পর ওটি যন্ত্রপাতির টেবিলে বেলে বেলে কিছুটা সমান করলাম। ছিদ্র যুক্ত স্কেল মেপে নির্দিষ্ট ছিদ্রের ব্যাসের মাপে নেলটি বানালাম। শক্ত হয়ে গেলে ঊখো দিয়ে ঘষে ঘষে সমান করা হলো। প্রথম প্রচেষ্টা হিসেবে নিতান্ত মন্দ হয়নি বলেই মনে হলো। এবার হাড়ের টুকরোগুলির মধ্যে বানানো নেলটি ঢুকিয়ে টুকরোগুলিকে সঠিক ভাবে বসিয়ে দিলাম। তারপর ক্ষতস্থানটি অল্প কয়েকটি সেলাই দিয়ে বন্ধ করে, ব্যান্ডেজ করে দিলাম। অপারেশনের পরদিন গিয়ে দেখি ব্যান্ডেজ খুব একটা ভেজেনি, তার মানে পুঁজ বা রক্ত সেরকম বের হয় নি। কিছুটা আশার কথা ! তার পরদিন অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে ব্যান্ডেজ খুললাম, দেখলাম ক্ষতস্থান থেকে পুঁজের পরিমাণ অনেকই কম। এরপর থেকেই রোগীর অবস্থা আস্তে আস্তে ভালো হয়ে উঠলো । শেষমেষ ক্ষতস্থান সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেলো। আমিও একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম, অন্তত পিটুনি খেতে হবে না, এই ভেবে। ভর্তি হওয়ার প্রায় মাস পাঁচেক বাদে ওঁকে ছুটি দিতে পারলাম। উনি মাসখানেক পরে আউটডোরে আমায় দেখাতে এলেন। দেখলাম ঊরুর ভেঙ্গে যাওয়া হাড় ভালোই জুড়ছে। কনুই আর পায়ের হাড়ও জুড়ে গেছে। কনুইয়ের হাড়ের দু এক টুকরো হাড় অপারেশন টেবিলে ঝরে পড়ে যাওয়া সত্ত্বেও,কনুইয়ের সঞ্চালন বেশ সন্তোষজনক। ঊরুর হাড় পুরোপুরোপুরি জুড়ে গেলে, ওঁকে দ্বিতীয়বার ভর্তি করে, ওই নেলটি বার করে দিলাম। সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে, উনি আউটডোরে আমায় দেখাতে এসেছিলেন। অল্প খুঁড়িয়ে হাঁটা ছাড়া মোটামুটি ঠিকই ছিলো। ওঁর হাস্যোজ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে মনে পড়লো, হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময় কখনো এমন মুহূর্ত এসেছিল, যে মনে হয়েছিল এই যুদ্ধে আমরা হারতে চলেছি। প্রকৃতি মায়ের অসীম দাক্ষিণ্য, একটা প্রায় হেরে যাওয়া যুদ্ধে আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে। মধুর তোমার শেষ যে না পাই।
Bah!
Ei toh daktari!
Thank you so much.
কঠিন লড়াই।
কেউ জানবে না কী মূল্যে সাফল্য অর্জন করতে হয়।
অনেক ধন্যবাদ দাদা।