(প্রথম পর্বের পর)…
সত্যিই, মরার কি বয়স হয় কোনও!! ইশকুলে দু ক্লাশ উপরে পড়া অরিজিৎদা যে শীতে মরে গেল ব্লাড ক্যান্সারে, ছবিতে মালা পরিয়ে ইশকুল ছুটি হয়ে গেল, মফস্বলের শীতে ধুলো ওড়া রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে একবারও কি ভেবেছিলাম, মরার কি বয়স হয় কোনও? বাকি আর কিছু মনে নেই, শুধু মনে পড়ে, সেদিন বিকেলে হইহই করে খেলতে মন চায়নি। বাড়ি থেকে বেরিয়ে ডানদিকে গেলে খেলার মাঠ, আর লাল মোরামে বাঁধানো সেই রাস্তা ধরে বাঁদিকে কিছুদূর গেলেই বাড়িঘর শেষ, দুদিকে বিস্তীর্ণ চাষজমি, মাঝে ছোট সোঁতার মতো, দুদিকের চাষের জল রাস্তা গভীর করে কেটে পারাপার করছে। আরেকটু গেলেই রুক্ষ খালি জমি, লাল কাঁকরে ভরা, কিছু কাঁটাঝোপ, উপরে হাই-টেনশন ইলেকট্রিক লাইন, তার জন্য অদ্ভুতদর্শন খাঁচা, যে খাঁচার মাঝখানে দাঁড়িয়ে উপরদিকে চাইলে কেমন একটা শিরশিরে অনুভূতি হয়। তারও পরে ছোট্ট টিলা, লম্বাটে গোছের। তারপর জঙ্গল। শাল, ইউক্যালিপটাস, আরও কাঁটাছোপ, ফণীমনসার গায়ে লতানো লাল-কালো দানার কুঁচফল আর অজস্র শেঁয়াকুল। অন্যমনস্ক ঘুরে বেড়িয়েছিলাম। জঙ্গল অব্দি ঘুরঘুর করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধে হয়ে গেল। অরিজিৎদার কথা মনে পড়ছিল বারবার। বেশ কিছুদিন পরে একদিন আমার বাবাকে অরিজিৎদার দাদা বলছিল, আমরা তো স্যার কিছু বুঝতেই পারিনি। জ্বর হতো, ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছিল, তা ভাইটা তো এমনিতেই ফর্সা, আন্দাজ করতে পারিনি কিছু। ডাক্তারবাবু আমাদের সেভাবে কিছু বলেননি। শুধু বলেছিলেন, খুব খারাপ অসুখ, সেরে ওঠা মুশকিল। আসলে জানাতে চাননি, এ রোগের তো ওষুধ নেই কোনও (সময়টা আশির দশকের মাঝামাঝি, এখন পরিস্থিতি অনেকখানিই ভালো), থাকলেও এখানে চিকিৎসা হবে না, এদিক-ওদিক নিয়ে যাই তেমন সামর্থ্যও তো আমাদের নেই। জানেন স্যার, শেষদিন সন্ধেবেলায় ভাইটা বাথরুমে গেল, পায়খানার সঙ্গে হুড়হুড়িয়ে রক্ত বেরিয়ে গেল, অনেক রক্ত, শরীরের পুরো রক্তটাই হয়ত। ভাইটা খুব ভয় পেয়ে গেছিল। বাইরে বেরিয়ে আমাকে ধরে বলছিল, দাদা, আমার না শীত করছে খুব… ওটাই শেষ কথা স্যার, তারপর তো সেন্স চলে গেল…
কতটা শীত করছিল অরিজিৎদার? তখন তো সে ক্লাস এইট কি নাইন। কতখানি শীত আর কতখানি আতঙ্ক… আর কতখানিই বা আসন্ন আচ্ছন্নতা…
তুষারকাকু তো আমাদের ঘরের লোক হয়ে গেছিল। কিশোর পুত্রের মলদ্বারে ক্যানসার। যথাসাধ্য চেষ্টার পরেও চিকিৎসায় সাড়া মিলল না। তার পরের গল্পটা একই। বাবার খুব প্রিয় ছাত্র তুষারকাকু। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক বদলে গিয়েছিল অসমবয়সী বন্ধুত্বে। বলেছিল, কী বলব স্যার, ছেলেটা যখন অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছে, আমার শুধু মনে হচ্ছিল, হাতের কাছে একটা বন্দুক থাকলে বেঁচে যেতাম, মনে হচ্ছিল, হয় আমি গুলি করে ওকে এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়ে দিই, নইলে আমি নিজেই স্যুইসাইড করে ফেলি… তুষারকাকুর কথা আর এগোয়নি, গলা বুঁজে এসেছিল। শীতকালই ছিল কি? মনে নেই আর…
আর পাড়ার রমেশদা। রমা বলে ডাকত সবাই। সদাহাস্যময়। পরোপকারী। প্রায় অজাতশত্রু। কখনও কাউকে রমাদার নামে নিন্দে করতে দেখিনি। পরের ঝামেলা হোক বা রক্তদান শিবির, রমাদা সবার আগে হাজির। সেই রমাদা আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়ল। না, ঠিক আচমকা নয়, আস্তে আস্তে ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়ল। অমন সুন্দর চেহারা ক্রমশ কেমন একটা হয়ে গেল। ডাক্তার দেখানো। পরীক্ষানিরীক্ষা। কিছুতেই কিছু হয় না। বুকে নাকি জল জমে যাচ্ছে বারবার। চিকিৎসার জন্যে নিয়ে যাওয়া হলো জেলা সদরে। তার কিছুদিন পর কলকাতায়। সুদূর কলকাতা থেকে রমাদার চিকিৎসার আপডেট আসত বিভিন্ন পথে। তখন তো মোবাইলের যুগ নয়, এমনকি পুরো পাড়া মিলিয়েও একখানা টেলিফোন নেই। তবুও খবর আসত। প্রথমদিকে ঘন ঘন, কখনও রোজ, সপ্তাহে অন্তত তিন-চারবার তো বটেই। তারপর দুটি সংবাদের মধ্যে ব্যবধান বাড়তে থাকল। চিকিৎসা চলতে থাকল কয়েক মাস। শুনতাম, চিকিৎসায় তেমন কাজ হচ্ছে না রমাদার। কে একজন বলল, ব্লাড ক্যান্সার। অমনি আরেকজন বলল, না না, ওরকম কিছু নয়। রমাদা ভালো নেই এটুকু বুঝতাম, তার বেশি আর কিছুর আন্দাজ পেতাম না। শুধু দেখতাম, সুনীলকাকুর মুখটা ক্রমশই যেন শুকনো হয়ে আসছে।
সুনীলকাকু রমাদার বাবা। পেশায় রাজমিস্তিরি। দারুণ রাজমিস্ত্রী। সুনীল মিস্তিরির সুনাম আমাদের সেই ছোট্ট শহর জুড়ে। কিছুদূর অব্দি পড়াশোনা করে রমাদা বাবার কাজে হাত মিলিয়েছিল। রমাদার মিষ্টি স্বভাবের কথা আগেই বলেছি, সঙ্গে বেশ ঝকঝকে বুদ্ধি। রমাদার যোগ্য সঙ্গতে সুনীলকাকুর সুনাম আরও অনেক বাড়ছিল। সুনীলকাকুর মুশকিল একটাই, দিনের শেষে মদ গিলে বাড়ি ফেরেন আর চেঁচামেচি করেন। রমাদার এসব বিলকুল নাপসন্দ। সেই নিয়ে নিয়মিত ঝামেলা। মাঝেমধ্যে রাত্তিরের দিকে সুনীলকাকু টলতে টলতে আমাদের বাড়ি চলে আসতেন। মাস্টারমশাই, আপনি একটা বিহিত করুন। সারাদিন খাটাখাটনির শেষে একটু মদ খাই, সেই নিয়ে রমা বলার কে? আমি ওর খাই না পরি!! বলে, মদ খেলে বাড়ি ঢুকতে দেবে না। আপনি বিচার করুন। বেগতিক দেখে বাবা বলত, আচ্ছা সুনীল, আপাতত বাড়ি যাও, আমি না হয় রমেশকে বুঝিয়ে বলব তোমার দিকটা।
তো একদিন খবর এলো, রমাদাকে বাড়ি ফিরিয়ে আনা হবে। কলকাতা থেকে গাড়ি রওয়ানা হয়েছে রমাদাকে নিয়ে। সেও এমনই এক শীতের সন্ধে। রমাদার বাড়ি পৌঁছে দেখি উপচে পড়া ভিড়। পাড়ার সবাই হাজির। গাড়ি বলতে অ্যাম্বাসেডর ভেবেছিলাম আমি, কিন্তু গিয়ে দেখি একখানা ম্যাটাডোর বাইরে দাঁড় করানো। সে বছর শীতের ওই আচমকা ধাক্কাটা কোনোদিন ভুলতে পারব না। দেখলাম, রমাদা আসেনি। কোনোদিনই আর আসবে না। এসেছে শাদা কাপড়ে ঢাকা রমাদার মৃতদেহ। তার উপর আছড়ে পড়ে কাঁদছেন কাকিমা। রমাদার মা।
সেই শীতে সুনীলকাকু সব কাজকর্ম ছেড়েছুড়ে দিয়ে ঘরে বসে রইলেন। কথাবার্তা বলেন না। ঝিম হয়ে বসে থাকেন। প্রায় এক বছর পার হওয়ার পর আস্তে আস্তে কাজে ফেরার চেষ্টা করেন। উপায়ই বা কী, পেট বড় বালাই। কাজের শেষে ভরপেট্টা মদ খেয়ে সুনীলকাকু বাড়ি ফিরতেন। আপনমনে রমাদাকে ডাকাডাকি করতেন। রমা, কুথায় গেলি তুই!! কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতেন, দেকুন দিকি, ছা-টা আসচিল সাথে, কুনদিকে যে গেল!! কখনও বা বলতেন, রমা, এই দ্যাক, আমি মদ খেইচি। লে, কী করবি করে লে! এই আমি ঘর যাচ্চি, কিচ্ছুটি বলতে লারবি…
ছোট্ট মফস্বল। সন্ধের পর নিঝঝুম হয়ে আসত। শীতের সন্ধেয় নির্জনতা নামত আরও তাড়াতাড়ি। মোরামের রাস্তা দিয়ে কেউ হেঁটে গেলে খরখরে শব্দ শোনা যেত। মাতাল সুনীলকাকুর নড়বড়ে পায়ের শব্দ, রমাদার সঙ্গে তাঁর একান্ত খুনসুটি… আমাদের সেই ছোট শহরের দ্রুত ঘনিয়ে আসা সন্ধেয় তা এক অন্যরকম বাড়ি ফেরার গল্প। ওই মুহূর্তে মা কথা বলতে বলতে চুপ করে যেত। কিছু একটা ভাবত হয়ত, সে আমার নেহাতই ছোটবেলা, সব কি আর মনে থাকে!!
বড়বয়সে কত বাবার মুখে দেখেছি সুনীলকাকুর আদল!! অনুজিৎ, পরিবারের আন্দাজে শৌখিন নাম, বছর বাইশেকের তরুণ, ছ’ফুট হাইট, তেমনি তাগড়াই জোয়ান। হাড়ের কঠিন ক্যানসার। একখানা পা হাঁটু থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। আর দুমাস বাদেই বোঝা গিয়েছে, তাতে কিচ্ছু লাভ হয়নি, কেননা অসুখ ছড়িয়েছে শরীরের অন্যত্র। তাড়াতাড়ি করে চিকিৎসা চালু হলেও আর লাভ নেই। লাভ হয়ওনি। বাবা এসে চুপটি করে বসে থাকেন রোজ। অনুজিতের পাশে নিতান্ত পলকা চেহারা তাঁর। একদিন জানাতেই হলো, ছেলে চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছে না, এখন শুধু শেষের অপেক্ষা। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন তিনি। এমন শূন্য সে দৃষ্টি, বাধ্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আমার কথাটা বুঝতে পেরেছেন তো? হ্যাঁ, বুঝতে তিনি পেরেছেন। আমিও পেরেছিলাম। চিনতে পেরেছিলাম আরও এক ভিন্ন মুখমণ্ডলের মধ্যে সুনীলকাকুকে।
কথায় কথায় কত মুখই যে মনে পড়ে যায়!! সব চলে যাওয়া হয়ত অসময়ে নয়। নির্ভরতার আশ্রয়টি কি আর একই থাকে সবক্ষেত্রে? সে আশ্রয় হারিয়ে ফেলে শূন্য দৃষ্টিগুলোও তো সবসময় একই দেখতে লাগে না। তবু কোনও এক অদৃশ্য সুতোয় গাঁথা একের পর এক শূন্যতা। হাজি জিয়াদ আলি। তাঁর চিকিৎসার দিনগুলো। তখন আমি নেহাতই শিক্ষানবিশ ছাত্র। কত গল্পই না করতাম। বলতাম, হাজিসাহেব, স্ত্রীকে সঙ্গে না নিয়ে একা একাই হজ করে এলেন, এ আপনার কেমন বিচার!! মানুষটা লজ্জিত হয়ে পড়তেন। বছরদুয়েকের মাথায় আমায় রীতিমতো খুঁজেপেতে জানিয়ে গিয়েছিলেন, হ্যাঁ, তিনি স্ত্রীকেও হজ করিয়ে এনেছেন। খবরটা দেওয়ার মুহূর্তে মুখে বিজয়ীর হাসি। হাতে কিছু খেজুর। খাস আরবদেশের। জানালেন, পাড়ার লোক বলছিল বটে, বিবিকে আবার হজে নিয়ে যাওয়া কেন!! আমি বললাম, আমার ডাক্তারবাবু বলেছেন যে…
তারও অনেক বছর বাদে, অন্য এক হাসপাতালে, পরিচিত নাম শুনে গিয়ে দেখি, আমার চেনা সুঠাম স্বাস্থ্যের হাজিসাহেবের জায়গায় শুয়ে আছেন এক জীর্ণ মানুষ। হ্যাঁ, আমার হাজিসাহেবই বটেন, কিন্তু এই দফায় মারণরোগ থাবা বসিয়েছে সর্বত্র। জিজ্ঞেস করলাম, চিনতে পারেন হাজিসাহেব? চিনতে সময় লাগল। তারপর ঝরঝর করে কাঁদতে লাগলেন। তাঁর সঙ্গে কথা হলেই আমি বিবিসাহেবার কথা জিজ্ঞেস করতাম, যাঁকে আমি দেখিনি কখনও। এবারে জিজ্ঞেস করে জানলাম, স্ত্রী আচমকা মারা গিয়েছেন কয়েকমাস হলো, হৃদরোগে। অসুখের বাড়বাড়ন্ত তারপরই যেন। ছেলে বাবাকে ভালোবাসে, কিন্তু বউ সবসময় অবহেলা করে। কত অভিমান, ক্ষোভ। ছেলেকে একপাশে আলাদা করে ডেকে নিয়ে জোর ধমক লাগালাম। একরাশ অভিমান নিয়ে সে বলল, বউ যতখানি করে, নিজের মেয়েও আজকাল অতটা করে না – কিন্তু আব্বু তো বউকে বিশ্বাসই করতে পারে না, সবেতেই সন্দেহ আর মুখখারাপ করে রাগারাগি, আম্মা মারা যাওয়ার পর আব্বুর মাথাটাই যেন কেমন একটা হয়ে গেছে… আসন্ন মৃত্যুর মুখে দিশেহারা দুই দফা হজ করে আসা হাজি জিয়াদ আলির অভিমানী বয়ান, নাকি ক্লান্ত ছেলের হতাশ ব্যাখ্যা – সম্পর্কের শৈত্যের সত্য কোনখানে, বুঝতে পারিনি।
এর’ম করেই একের পর এক শীতকাল পার হয়ে যায়। মায়ায় জড়িয়ে রাখা। মায়া কাটিয়ে ফেলা। মাঝে মাঝে অশ্রু পুড়িয়ে দিতে তীক্ষ্ণ গ্রীষ্ম। ধুইয়ে নতুন করা বর্ষার কিছু কিছু বিরতি।
শহরের হাসপাতালের ভিতর ইতিউতি গজিয়ে ওঠে অট্টালিকা। হাসপাতাল, তাকেও তো বড় হতে হয়। নিত্যনতুন অট্টালিকায় – আরও বড় আরও আধুনিক হয়ে ওঠার উচ্চাকাঙ্ক্ষায় – শূন্যতার পরিসর ক্রমে কমে আসে। ইতস্তত বিল্ডিং-এর ফাঁক দিয়ে বয়ে আসা শীতল বাতাসে বুঝি, এ-ই শীত। হাজিসাহেব, মিঠু, সাহিনা, মীরা চ্যাটার্জি, অনুজিৎ – আরও কত মুখ – কত ক্লান্তি, দীর্ঘশ্বাস – কত হেরে যাওয়ার গ্লানি – ক্লেদও – ওয়ার্ডের গুমোট ভাব কাটাতে বাইরে এসে দাঁড়াই। শীতের হিমেল বাতাস। সঙ্গে মিঠে রোড। এ সম্ভবত চড়ুইভাতিরও সময়। ফুলকপি, মটরশুঁটি। মনে পড়ে, হাঁসেরা নিজেদের মাংস বড় সুস্বাদু করে তোলে এ সময়ে।
বাইরে দাঁড়িয়ে দেখি, সামনের ওই একফালি জায়গায় নতুন বিল্ডিং উঠবে। শুরু হয়েছে প্রস্তুতি। জোর তোড়জোড়। এই গাছখানা এ’দফায় কাটা পড়বে নিশ্চিত। দেখি, তার শেষ শীতে সেই গাছ শেষ বারের মতো পুরোনো পাতা ঝরিয়ে নিচ্ছে আপাতত।