শীতকাল পড়লেই বড্ডো হাঁসের মাংসের কথা মনে পড়ে। শীতে অবিচল থাকতে পালকের নিচে প্রকৃতি একান্তে জমিয়ে তোলে স্নেহ-উপাদান – আহা, স্নেহ তো ওম জোগায়, সব অর্থেই – সেই চর্বি গলে ঝোলে মিশলে তা ভারি সুস্বাদু ব্যাপার। বড় মায়ায় জড়ানো এই বিবর্তনটুকু। ক’বারই বা খেয়েছি আর! রাজগ্রামের হাট থেকে অনিলদা যেবার হাঁস কিনে এনে দিল, সেই প্রথম। রান্নার কৃৎকৌশল নিয়মকানুন জানা ছিল না মোটে। গড় পরিমাপ তেলে চর্বি গলে মিশে সে এক থইথই কাণ্ড। যেমন হয়, ঠেকে শিখতে শিখতে রান্না করতে করতে সঠিক মাপজোখ পরে আয়ত্তে এলো, কিন্তু প্রথমবারের সেই অনিশ্চিত স্বাদ, আহা!!
তবে হাঁসের মাংস নয়, শীত পড়লেই সেই মাংসের প্রতিশ্রুতির কথা যেন বেশি করে মনে ভাসে। মীরা চ্যাটার্জির কথা মনে পড়ে যায়। বিখ্যাত মানুষ কেউ নন, আমিই বা কতটুকু চিনতাম তাঁকে। চিকিৎসক আর রোগীর সম্পর্ক, ব্যাস ওটুকুই। নাকি ওটুকু নয়, ও-ই অনেকখানি? স্তনের ক্যানসারের রুগি – রোগ নয়, বুড়ো বয়সে রোগের আধার হিসেবে এমন অঙ্গটি উপরওয়ালা কেন বাছলেন, সেই নিয়ে ভারি অভিমানী ছিলেন। তবু শুরুর পর্যায়ের অসুখ, সেরে যাওয়ারই কথা। কিছু ওষুধ-স্যালাইন, তারপর শল্যোপচার, তার পর আবারও দুই কি তিন দফা ওষুধ। মায়ের বয়সী মীরা যেন বড্ডো মায়ায় বেঁধেছিলেন আমাকে। নেমন্তন্ন করতেন বারবার। একদিন আমাদের বাড়িতে অবশ্যই এসো। গ্রামের বাড়ি। পুকুরে মাছ, ক্ষেতে টাটকা সবজি – মাংস ভালোবাসি শুনে হাঁসের প্রতিশ্রুতি। আহা, আবারও সেই হাঁস!! জানোই তো, বাবা, আমাদের বামুন বাড়িতে মুর্গি চলে না। এসো, তুমি এলে পুকুরে জাল ফেলতে বলব, টাটকা মাছ তুলে খাওয়াব, শীতের টাটকা মটরশুঁটি, কচি মটরের শাক ভাজা, সকালবেলায় টাটকা খেজুররস, আর হাঁসের মাংস। আসবে তো, বাবা? বলতাম, আপনি সেরে উঠলেই, ব্যাস, এই তো আর মাত্র দু-তিনটে মাস, ভালো করে জমিয়ে শীতটাও পড়বে তখন…
যাওয়া হয়নি।
শেষ দফা চিকিৎসা করে বাড়ি ফেরার দুদিন পর তাঁর বউমার ফোন। বউমাকেও চিনতাম, বা বলা যায়, তাঁর পরিজনদের মধ্যে যেন বউমাটিকেই বেশি চিনতাম। নাকি, পেশেন্ট পার্টি? শাশুড়ির হাত ধরে বিছানায় বসে থাকত মেয়েটি, মুখচোরা, নেহাতই ছেলেমানুষ। মজার ছলেই জিজ্ঞেস করতাম, এই নরমসরম মানুষটাই শাশুড়ি হয়ে বাড়িতে প্রবল দাপট দেখায় তো? থতমত খেয়ে উত্তর দিত, আমার মায়ের চেয়ে বেশি আদরে রাখে, সত্যি বলছি ডাক্তারবাবু। অমনি হাসপাতাল ওষুধের গন্ধ আর টিমটিমে রুগ্ন আলো মুছে কী যেন এক অলৌকিক ডিফিউজার সবকিছুকে ভরিয়ে দিত এক মায়াবী হলুদে, সে ভারি নরম অনুভূতি। মীরা বলতেন, বাবা, একটা মেয়ের বড় শখ ছিল, গোপাল এই মেয়েকে দিয়ে সেই সাধ মিটিয়েছেন। ছেলেকে এত শাসন করি, কখনও সখনও ওকেও কি করি না আর…
সেদিন সে মেয়ে ফোনে জানাল, এই দফা বাড়ি গিয়ে ইস্তক মায়ের পরিস্থিতি বেশ খারাপ, আজ বেশিই বাড়াবাড়ি। মুখে ঘা, জলের মতো পাতলা পায়খানা, সারাক্ষণ অল্প জ্বর, আজ যেন একটু বেশিই ঝিমিয়ে পড়েছেন। শুনেই বুঝলাম কী হয়েছে। রোগের প্রাবল্য নয়, চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। বললাম, এখুনি হাসপাতালে নিয়ে এসো। জানা গেল, অত প্রত্যন্ত গ্রামদেশ থেকে এত দ্রুত আনতে পারা অসম্ভব, আগামীকাল সকাল নাগাদ গাড়ির ব্যবস্থা হবে। অগত্যা ফোনেই কিছু সহজপ্রাপ্য ওষুধের বিধান। জানতাম, এখুনি চিকিৎসা জরুরি, যা ওই প্রত্যন্ত গাঁ-গঞ্জে ঘরে বসে হবে না। জানতাম, দুটো দিন ঠিকঠাক ওষুধ পড়লেই এই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কাটিয়ে উনি চাঙ্গা হয়ে উঠবেন, কিন্তু সেজন্য এখুনি চিকিৎসা শুরু জরুরি, একটু দেরি বড় বিপদের কারণ হতে পারে। জানতাম… কিন্তু জেনেও কিছু উপায় রইল না। পরদিনই ফোন। বউমা, নাকি মেয়ে, বড়ো আকুল হয়ে কাঁদছিল।
সময়টা তখন শীতকাল।
মীরাদেবীর পুকুরের গভীরে রয়ে গেল পাকা কাতলা, জলের উপরতল দিয়ে চরে বেড়ালো হাঁস, পাতলা পর্দা দিয়ে জোড়া পায়ের পাতার ছায়া যখন মিশে যাচ্ছিল মায়ায় ভরা রুইয়ের আঁশে, ঠিক তখনই হয়ত কেউ খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধতে ব্যস্ত। মৃতদেহ কাঁধে শ্মশানযাত্রীর দল যখন অতিক্রম করল আবাদি জমি, পুকুরের পাড়, তালগাছের সারি – কুয়াশার মায়া তখনও রয়ে গিয়েছিল কি!
শীতকাল। তবু নেমন্তন্ন রাখার সুযোগ হয়নি। ছেলে বলেছিল, একবার আসুন, মায়ের কাজে অন্তত একটিবার, মা সবসময় বলত, ডাক্তার তো নয়, ও আমার ছেলে, আপনি এলে মা শান্তি পাবে। নাহ্, যাওয়া হয়নি আর।
আর সাহিনা? বছর তিরিশেকের ফুটফুটে সাহিনা যখন প্রথমবার হাসপাতালে দেখাতে এলো, সে এক প্রাণোচ্ছ্বল ঝলমলে মেয়ে। সঙ্গে ততোধিক ফুটফুটে এক শিশু, সিনেমায় দেখা বাচ্চাদের মতো সুন্দর। হাসপাতালে এমন বাচ্চাকে নিয়ে আসো কেন? কোথায় রাখব দাদা, বাড়িতে আর কেউ নেই, এর দিদি স্কুলে গেছে, এই বাচ্চা একা থাকবে কোথায়? বাচ্চার বাপ প্রাজ্ঞ মানুষ, স্ত্রীর অসুখ বুঝে তৎক্ষনাৎ পাড়ি দিয়েছেন অ-সুখ থেকে সহজলভ্য সুখের আশায়। সেদিনই স্তম্ভিত হয়েছিলাম, বাইরে সঙ্কটের চিহ্নমাত্র দৃশ্যমান না হলেও অসুখের বীজ ছড়িয়ে পড়েছে সাহিনার দেহের সর্বত্র। সে খবর সাহিনা-কে বলতে পারিনি। জানিয়ে উঠতে পারিনি, যকৃৎ ফুসফুস ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছে, বেশীদিন আর হাতে নেই তার। বলিনি, বলতে পারিনি।
সে বছর রাখীপূর্ণিমার দিন যখন আমায় রাখী পরিয়ে গেল, জানতাম, খুব সম্ভবত তার জীবনের শেষ রাখীপূর্ণিমা এটিই। উজ্জ্বল চোখ এড়িয়ে একটা আলগোছে হাসিমুখ নিয়ে হাতটুকু এগিয়ে দিয়েছিলাম। চেয়েছিলাম, খুব চেয়েছিলাম, সাহিনা সেরে উঠুক। বিজ্ঞানের উর্দ্ধে, শুনেছি, গল্পকথা হলেও শুনেছি, মাঝেমধ্যেই অনেক কিছু ঘটে – চেয়েছিলাম, সাহিনাও থাকুক সেই ব্যতিক্রমী উদাহরণগুলোর একটি হয়ে, খুব চেয়েছিলাম থাকুক, আমার ডাক্তারিজীবনে দেখা অন্তত একমাত্র ব্যতিক্রম হিসেবে। সাহিনা বলেছিল, দাদা, সবাই বলে, আমাদের পাড়ায় আমার মতো বিরয়ানী আর কেউ বানাতে পারে না, তোমাকে একদিন নিজের হাতে বিরয়ানী রান্না করে খাওয়াব… বলতে বলতেই একটু যেন হাঁফিয়ে উঠত সে, সম্বিত ফিরে পেয়ে আমারও মনে পড়ত সাহিনার ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া ফুসফুসের কথা। জানতাম, বুঝতাম, কিন্তু হাসিমুখ বজায় রাখা বাদে উপায়ই বা কী! রাখীপূর্ণিমার পর ক্যালেন্ডারের নিয়মে এলো পুজো, পুজো শেষ হয়ে শীত পড়ার আগেই সাহিনাকে আসতে হলো প্রতিবেশীদের হাত ধরে, পাংশু মুখ, পেটে জল জমে বেলুন… আমি নিজে সাহিনার সঙ্গে বেশি কথা বলতে পারিনি তখন, বারবার সে জানতে চাইছিল হঠাৎ এমন বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কেন, আমি উত্তর দিতে চাইনি, ব্যস্ততার অজুহাতে অন্য ডাক্তারের হাতে সাহিনাকে ঠেলে দিয়েছিলাম। নাহ্, সে আচরণে আমার আর কোনও অপরাধবোধ নেই। পালাতে চাইলে অত অপরাধবোধ থাকলে চলে না।
সেই শীতে সাহিনার কোনও খবর পাইনি। পরের শীতেও না। আর কখনোই না। আমার কাছে শেষ খবরটুকু পৌঁছে দেওয়ার মতো কোনও নিকটজন তো সাহিনার ছিল না। পাড়ার শ্রেষ্ঠ বিরয়ানী সে আর কখনোই দাদা-কে খাইয়ে উঠতে পারেনি।
কতটুকু সত্যিই বা বলতে পারি? সতীর্থ চিকিৎসকের স্ত্রী, দেশের অন্য প্রান্তে দৌড়ে চিকিৎসা করিয়ে ফিরে আসার শেষে জানলেন, তাঁর অসুখ আরোগ্যের অতীত। আমায় যেদিন প্রশ্ন করলেন, ক্লাস নাইনে পাঠরত ছেলের মাধ্যমিকটুকু তিনি দেখতে পাবেন কিনা, পেরেছিলাম কি সত্যি উত্তর দিতে? এমনকি শেষের সে সন্ধেয় রক্তবমি দেখে আতঙ্কিত উৎকণ্ঠিত মানুষটি যখন জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, আমার এই রক্ত উঠে আসাটা কি খুব খারাপ কিছুর ইঙ্গিতবাহী, তখনও অবলীলায় শুনিয়েছি মিথ্যে স্তোকবাক্য। ওই স্তোকবাক্যের বেশি কিছু বলতে পেরেছি কি কখনও? সেও তো ছিল এমনই এক শীতের সন্ধে।
আর সেই বছর বাইশেকের মিঠু? দীর্ঘ চিকিৎসার শেষে রুটিন পরীক্ষায় যখন দেখা গেল অসুখ সম্ভবত ফিরে এসেছে, আরও কিছু টেস্ট না করালে নিশ্চিত বোঝা যাচ্ছে না। পরীক্ষানিরীক্ষার কথা বলায় আমাকে একরাশ সারল্য নিয়ে প্রশ্ন করেছিল, এরপর তাহলে কী ডাক্তারবাবু? মরে যাব? আচ্ছা বলুন তো, মরার মতো বয়স কি আমার হয়েছে?? নাহ্, উত্তর দিতে পারিনি। বলতে পারিনি, মরার কোনও বয়স হয় না মা। তখন অভিজ্ঞতা কম, গুছিয়ে স্তোকবাক্য শোনানোর অভ্যেস আয়ত্ত হয়নি। আর হয়ত সেজন্যই, মিঠু আর তারপর কোনোদিনই আমাদের হাসপাতালে দেখাতে আসেনি। সে হাসপাতাল থেকে বদলি হয়ে চলে গেছি অন্যত্র, সেও অনেক বছর। সেখান থেকে অন্য হাসপাতালে। ফেরা হয়নি আমার। জানতে পারিনি কিছু। হয়ত মিঠু ভালো আছে এখনও। নাকি…
(বাকিটা পরের পর্বে)
ট্রাপিজ পত্রিকার মুক্তগদ্য সংখ্যায় প্রকাশিত