দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি বিশেষ ২৬
লেখাটা একান্তই ব্যক্তিগত, তাই সকলের পছন্দ না-ই হতে পারে। কিন্তু লেখার বিষয়বস্তু সামাজিক, তাই এরকম একটা মাধ্যমে দেওয়া যায় মনে হয়। কিছুদিন আগে পুণ্যদা (এত বয়োজ্যেষ্ঠ এবং এত বড়ো মাপের মানুষকে ‘দাদা’ সম্বোধনের ধৃষ্টতা দাদার দাবি মেনেই করছি) বললেন ডক্টরস ডায়ালগের দু’বছর পূর্তি উপলক্ষে লেখা জমা দিতে। মায়ের শারীরিক অসুস্থতার জন্য মাথায় কিছুই আসছিলো না, কিন্তু এই বিচিত্র দেশে খুব বেশিদিন লেখার বিষয়বস্তুর অভাব হয়না। কিন্তু মুক্তোর অভাব না থাকলেও, উলুবনে তা ছড়ানোর উদ্যমের অভাব মানুষের পক্ষে বেশ স্বাভাবিক। সেই উদ্যম সংগ্রহ করতে করতে নতুন বছর চলেই এলো, লেখাটা তাই আর জমা দেওয়া হয়ে উঠলো না- এখানেই থাক।
কিছুদিন আগেই চিকিৎসকদের একটা ধর্মঘট চলছিল, একথা অনেকেরই জানা, বেশির ভাগ মানুষই আবার হয়তো জানেন না। না জানাটাই স্বাভাবিক, ডাক্তারদের মধ্যে বেশির ভাগেরই পৃথিবীর আর পাঁচটা অ-ডাক্তার মানুষের জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত নিয়ে বেশি মাথাব্যথা থাকে না। শুধু ডাক্তার বলি কেন, বেশির ভাগ পেশাদার মানুষের জীবনই এখন সেই ধারাতেই চলছে। বাকি সবাই কী করছে, কেমন আছে- এসব ভাবনার সময় কারোর হাতেই নেই।
যাঁরা জানেন না, অথচ জানতে চান তাঁদের জ্ঞাতার্থে বলি, স্নাতকোত্তর ডাক্তারি পড়াশোনার ভর্তির জন্য নীট পিজি পরীক্ষা প্রতি বছর জানুয়ারি মাস নাগাদ হয়, যার ফলাফল বেরিয়ে ভর্তির প্রক্রিয়া মে মাসের মধ্যে সম্পূর্ণ হয়ে যায়। প্রতি বছরই এই পরীক্ষা ঘিরে (পড়ুন পরীক্ষায় বিভিন্ন রকম সংরক্ষণ নিয়ে) মামলা-মোকদ্দমা চলতেই থাকে, কারণ আমাদের মতো জেনারেল ক্যাটাগরির লোকেরা জেনারেল বলে গর্ব করলেও ‘স্পেশ্যাল’ হয়ে ওঠার তাগিদ তাদের কারো কারোর মধ্যেও রয়েছে প্রবল ভাবে। সে অন্য কথা। সেই মামলা মোকদ্দমার নিরিখে এবছর ভর্তি প্রক্রিয়া লাটে উঠেছে। মামলার শুনানি সেই সানি দেওলের ‘তারিখ পে তারিখ’ নীতিতেই চলছে। এই নিয়ে অবশ্য কারো বিশেষ মাথা ব্যথা নেই, না সরকারের, না জনগণের। কারণ হাসপাতাল খোলা আছে, চিকিৎসা তো চলছে। কত জন ডাক্তার আছে, কীভাবে চিকিৎসা হচ্ছে- এসব নিয়ে কার কী চিন্তা! সরকারি ক্ষেত্রে এসব ভাবনা কেউ করে না। এই যেমন ট্রেনে উঠে আপনি কি ভাবেন আপনি কখন গন্তব্যে পৌঁছাবেন! পৌঁছতে পারলেই অনেক। সরকারি সমস্ত পরিষেবারই quantity বিচার করা যায়, quality বিচার করা যায় না। দুর্ভাগ্য, মানুষের স্বাস্থ্য নিয়েও সেই ধারাই বজায় আছে।
এই টালবাহানায় তিতিবিরক্ত হয়ে এবং স্বাস্থ্য পরিষেবার মান বজায় রাখতে দ্রুত কাউন্সেলিং-র দাবি নিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করলে তাতে পুলিশ লেলিয়ে দেওয়া হয়। এই নিয়ে অবশ্য আমার বিন্দুমাত্র খেদ নেই।
এদেশ সাংবিধানিক ভাবে গণতান্ত্রিক হলেও দেশে গণতন্ত্রের লেশমাত্র নেই, একথা সবার জানা। কৃষক থেকে শিক্ষক- শাসকের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুললেই পুলিশি আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে সবাইকে, ডাক্তারেরা বাদ যাবে এই দুরাশা আমরা করি কীকরে! ফ্যাসিবাদী শক্তির তোষণ করলে একদিন তার ফল পেতে হবে, কাল কৃষকরা পেয়েছে, আজ আমরা পাচ্ছি, কাল আবার অন্য কেউ পাবে- এটাই ধ্রুব সত্য।
তো এই দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাবে কাউন্সেলিং নিয়ে দীর্ঘসূত্রিতা এবং পুলিশি আগ্রাসন- এই নিয়েই ধর্মঘট হয়েছিল। ডাক্তারদের যে সর্বাত্মক ধর্মঘট সম্ভব, তা পরিবহ মুখুজ্যের মাথা না ফাটলে আমরা জানতে পারতাম না। আর এই ধর্মঘটগুলোতে কাজের কাজ যে কিছুই হয় না সেই শিক্ষাও এন.আর.এস কাণ্ড দিয়ে গেছে, এবারও তার অন্যথা হয়নি। ধর্মঘটের ক’টা দিন অপ্রতুল ডাক্তারদের অপ্রতুলতর অংশ দিয়ে কাজ চালিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে ধর্মঘট তুলে দেওয়া গেছে।
আমার মাঝে মধ্যে সন্দেহ হয়, মডার্ন মেডিসিনের শিক্ষার ধারাকে অবরুদ্ধ করে অন্যান্য ধারার চিকিৎসাকে পক্ষান্তরে তুলে ধরার জন্যই কি এসব কারসাজি করা হচ্ছে! এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হলে অবশ্য আমি খুশিই হব। কিন্তু জনতার পালস আর গোবলয়ের প্রাচীন শিক্ষা-দীক্ষার ধারা দেখলে আমার এই সন্দেহে অবাক হওয়ারও বিশেষ অবকাশ নেই।
এদেশের মানুষের স্বাস্থ্য সম্বন্ধীয় জ্ঞান শূন্যের কোঠায়, এরা স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা-গুলোকেও ‘অলৌকিকতা’র আলোয় দেখতে পছন্দ করে। সামান্য ভাইরাল জ্বর জলপড়া ইত্যাদি দিয়ে কমে গেলে তারা সেটাকেই পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য বলে মেনে নেয়। আবার তাদের কাছেই ব্রেনের ক্যানসারের চিকিৎসা করাতে যায়। এই সমস্যা আজকের নয়, শ্রদ্ধেয় বনফুলও তাঁর অভিজ্ঞতা ‘অগ্নীশ্বর’-এ লিখে গেছেন, সেটা আজকের পরিস্থিতি থেকে কিছুমাত্র আলাদা নয়। এদেশে থাকি বলে এদেশের গল্প বলি, খোদ আমেরিকার তথাকথিত শিক্ষিত মানুষের মাস্ক-বিরোধী আন্দোলন দেখেও সমভাবে বিস্মিত হই বই কি!
মডার্ন মেডিসিনও এদেশে আল্ট্রা-মডার্ন। তাকে এদেশে ‘এলোপ্যাথিক চিকিৎসা’ বলা হয়। এই এলোপ্যাথেটিক চিকিৎসা কোয়াক, হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদ ইত্যাদি ইত্যাদি থেকে শুরু করে পাড়ার দোকানদার, সবাই কমবেশি করে থাকেন। সেই কুলদাবাবুর মতোই নৈঋত কোণে খাটের পাশে একমনে হাওয়া করা বাদ দিয়ে সবরকম প্রেসক্রিপশনই দেখলাম। নানান রকম ভিটামিন, অবৈজ্ঞানিক এন্টিবায়োটিক মিশ্রণ ইত্যাদি দিয়ে এলোপ্যাথিক চিকিৎসাও এদেশে ভালোই চলছে- “দিলে ক্ষতি তো কিছু নেই”!!
আগে বলতাম, বলা কমিয়ে দিয়েছি। লোকজন জিগ্যেস করেন, আজকাল আর লেখালিখি করো না! লিখে এই মহাবিশ্বের গতিপ্রকৃতির কী পরিবর্তন আর হবে! ডক্টরস ডায়লগের কথা দিয়ে শুরু হয়েছিল। দু’বছর হয়ে গেল ওয়েবসাইটের, প্রচুর বিজ্ঞানসম্মত লেখা রয়েছে- নিজেও পড়ে শিখি, সব কথা তো আর বইতে থাকে না! কিন্তু কত জনের কাছে সেই বার্তা পৌঁছেছে তা জানিনা, এখনো অব্দি বাজারে বাজারি পত্রিকাগুলোরই রমরমা। ক’দিন আগে দেখলাম জনৈক সাংবাদিক পি জি হাসপাতালে একজন রোগী ভর্তি নিয়ে বেশ নাটক করলেন। এই সাংবাদিকেরা হাসপাতালের পরিকাঠামো, ডাক্তারদের অমানুষিক রোজনামচা- এসব নিয়ে একটা অক্ষরও খরচ করেন না। তাই রোগী ও চিকিৎসকদের মধ্যে থাকা পর্বতপ্রমাণ অবিশ্বাসের বোঝা ডক্টরস ডায়লগ কতটুকু সরাতে পেরেছে বা আগামী দিনে কতটা পারবে সেটা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে।
ধর্মস্থাপনার জন্য নাকি কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধ হয়েছিল, তাও আজ পৃথিবী অধর্মে গলা অব্দি ডুবে আছে। এই পৃথিবীটা সত্যিই কুকুরের লেজ, হাজার প্রচেষ্টায় টেনে সোজা করলেও সে বেঁকে যাবেই। তাও সেই সোজা করার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়াই বোধ হয় ধর্ম। ডক্টরস ডায়লগ এই সোজা করার প্রচেষ্টায় ব্রতী থাক, এই কামনা করি নতুন বছরে।