আমরা যখন ছাত্র ছিলাম, তখন মেডিক্যাল কলেজের সব শিক্ষকই কিছুদিন গ্রামে না হলেও জেলা বা মহকুমা শহরের মাঝারি হাসপাতালে কাজ করে আসতেন। তাই আমাদের সে সকল প্রণম্য শিক্ষকদের অভিজ্ঞতায় একেবারে মেঠো লোকেদের চিকিৎসা করার নানান ঘটনা থাকত। ওনাদের কাছে আমদের শিক্ষাও তেমনি, যতোটা না বই এর পাতা থেকে আসত, তার থেকে বেশী আসত ওনাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে।
সেই যেমন একটা জেলার মেডিক্যাল কলেজের এক শিক্ষকের অবাক করা রোগ নির্নয়। এক বাড়ীর দুটি বাচ্চা ভর্তি হয়েছে একটু বিচিত্র রোগ লক্ষণ নিয়ে। বাড়ীর লোকের বক্তব্য, পাশের বাড়ির সাথে অনেক দিনের ঝামেলা, তারাই বাণ- টান মেরেছে। ওঝা গুনিন না করে কেন হাসপাতালে ভর্তি করেছে, সেটা একটা রহস্য বটে। এদিকে বাচ্চাদের রোগ লক্ষণ কোন ভাবে মেলানোও যাচ্ছে না। এক সময় শিক্ষক-চিকিৎসক স্যার নতুন অর্থাৎ জুনিয়র ডাক্তারদের বললেন, ভালো করে খুঁজে দেখতো, সাপের কামড়ের দাগ পাও কি না। বাচ্চাদের উলঙ্গ করে গোটা শরীর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোন দাগ পাওয়া গেল না। স্যার কিন্তু সাপের কামড়ের ওষুধ, অ্যান্টি ভেনম চালিয়ে দিতে বললেন।
নতুনদের অবাক করে, বাচ্চা দুটি ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠল। স্যার এবার পড়ালেন যে, ঐ রকম বিচিত্র রোগ লক্ষণ কালাচ নামের একটি রহস্যময় সাপের কামড় থেকে হতে পারে। সে সময় নতুন ডাক্তাররা কতোটা কি শিখেছিলেন জানি না। এখন কিন্তু এ বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামের স্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডাক্তারবাবুও কালাচ সাপের কামড়ের এই রহস্যের সমাধান করে, অনেক রুগীকে বাঁচাচ্ছেন।
এবার যদি ঐ বাচ্চাদের বাড়ীর লোকেরা, ঐ শিক্ষক চিকিৎসককে ওঝা গুনীনের মত দৈব ক্ষমতার অধিকারী মনে করেন, কিছু বলার নেই। ইনি তো সাপের কামড়ের ওষুধ, স্যালাইন ইত্যাদি নিয়ে চিকিৎসা করেছেন, বাড়ীর লোকেরা সামনে বসে দেখেছেন। আমি যে রুগীর চিকিৎসা করেছিলাম, তাকে তো কোন ওষুধ পত্র কিছুই দিইনি। আর যে রোগ ধরেছিলাম, সেটা লোকজনকে ডেকে বলার মতোও নয়।
আমি তখন উত্তর বঙ্গের একটা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে কাজ করি। মাইল খানেক দূরের একটা গ্রাম থেকে প্রায় শ’ খানেক লোক, হৈ হৈ করে, একটা রুগী নিয়ে হাজির হল ঐ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে। তখন রাত দশটার মত হবে। হৈ হৈ শুনে হাসপাতালে গিয়ে দেখি, একটি বছর পনের ষোল বয়সের মেয়ে রুগী। রুগীর খিঁচুনী হচ্ছে। বাড়ীর লোকের ধারণা ভূতে ধরেছে।
ওখানে মহিলা রুগীদের দেখার আলাদা ঘর বলতে লেবার রুম। যেখানে সিস্টাররা বসেন তার পিছন দিকে ঐ লেবার রুমে যাওয়ার একটা দরজা আছে। ওটা দিয়ে ভেতরে ঢুকে রুগীকে দেখলাম, ডেলিভারী টেবিলে শুইয়ে। এইসব “ভূতে ধরা” রুগীর রোগ ধরতে আমাদের এক মিনিটও সময় লাগে না। কিন্তু ভুতটা কোথায় আছে ধরতে না পারলে চিকিৎসা করা যাবে না। ভূত যদি সর্ষের মধ্যেই থাকে?
এরকম একটা ভূত হচ্ছে, ব্যথা কমানোর বা ঘুমের ইঞ্জেকশন। যতোবারই ওই রুগী হাসপাতালে যায়, তাকে ওরকম একটা ওষুধ দেওয়া হয়, আর রুগী ভালো হয়ে বাড়ী যায়। এই করতে করতে ঐ রুগী ঐ ওষুধের নেশায় পড়ে যায়। এটাকে সর্ষের ভেতরের ভূত বলা যায়।
আমার রুগিনী যেই মাত্র বুঝতে পারে যে, সে ডাক্তারের কাছে ধরা পড়ে গেছে, তার খিঁচুনীও থেমে যায়। এই রোগ ধরার জন্য ডাক্তারকে গোয়েন্দা হতে হয়। ব্যোমকেশ বক্সি বা ফেলুদা এক একটা রহস্যের সমাধানের জন্য সাতদিন দশদিন সময় পেয়েছেন; আমাদের প্রায়ই সাত মিনিটের ভেতরই রোগটা ধরতে হয়। একেকটা রহস্যের সমাধান করে, ব্যোমকেশবাবু যেমন সকলকে একজায়গায় বসিয়ে, কি করে, কোন সূত্রে সমাধান করলেন, বুঝিয়ে বলেন; আমাদের তেমন করার উপায় নেই। বড় জোর বাড়ীর খুব কাছের এক দু জনকে ভূতটা চিনিয়ে দিতে হয়।
এই মেয়েটি একটি মানসিক সমস্যায় ভুগছে বুঝতে পেরেই, ওর মা এসেছে কিনা জানতে চাই। জানা গেল, মা নয়, শাশুড়ী এসেছে সাথে। শাশুড়ী? তাহলে তো আরও নিশ্চিত হওয়া গেল। ঐ শাশুড়ী মাকে সিসটারদের বসার জায়গায় ডেকে কয়েকটি কথা জেনে নিলাম। এর মধ্যে রুগীর খিঁচুনী সেরে গেছে জেনে, সাথে আসা জনতা আর ঠেলে ভেতরে আসার চেষ্টা করছে না। তারা এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়েছে। কেঊ কেঊ হাসপাতালের গাছে কতোগুলি তাল হয়েছে, গোনার চেষ্টা করছে। এবং ইত্যাদি। এই বধূটির কতোদিন বিয়ে হয়েছে, ছেলে কি করে, এমন মামুলী কয়েকটা প্রশ্ন করে, শাশুড়ীমাকে তাদের রুগীর সমস্যাটা বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম। যাকে ইংরেজীতে বলে কাউনসেলিং।
দরজার কাছে দু একজন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল। তারা যাতে শুনতে না পায় তেমন আস্তে কথা বলতে হচ্ছিল। একটি ছেলে দেখলাম, দরজার বাইরে থেকে হাত নেড়ে আমাকে ইসারায় কিছু বলতে চাইছে। মহিলা জানাল ওটিই আমার রুগীর স্বামী। এবার মাকে বাইরে যেতে বলে, ছেলেকে ভেতরে ডাকলাম। ছেলেটির আঠারো কুড়ির বেশী বয়েস হবে না। কিন্তু বেশ সপ্রতিভ। ও কিন্তু বুঝে গেছে যে, এ ডাক্তার ভূতটাকে ধরেই ফেলেছে। ও আমাকে যা জানাল, সেটাই রোগের মূল। আমি ঠিক ঐ জায়গাটাতেই পৌছতে চেষ্টা করছিলাম। মরণাপন্ন রুগীকে বাঁচিয়ে যেমন মনে একটা নির্মল আনন্দ পাওয়া যায়, এরকম রোগ ধরতে পারলেও এরকম একটা অনুভুতি হয়।
আরে দাঁড়ান মশাই; রহস্যটা বলে দিলেই তো গল্প শেষ। বলব তো নিশ্চয়ই। ছেলেটির মায়ের কাছেই জেনেছি যে, ওদের বিয়ে হয়েছে মাত্র চার-পাঁচ দিন আগে। ছেলেটি আমাকে জানাল, রাত্রে বিছানায় শুয়ে, নতুন বউ এর গায়ে হাত দেওয়া মাত্রই বৌটি ভয় পেয়ে ওরকম ভূতে পাওয়ার মত করতে শুরু করেছে। কোন ওষুধ পত্রের প্রশ্নই নেই। শাশুড়ীমা আর স্বামী ছেলেটিকেই কাউনসেলিং করে বিদায় দিলাম। ভাগ্যিস সে সময় ঝড় ওঠেনি। না হলে হয়তো ঝড়ে হাসপাতালের কোন গাছের ডাল ভেঙ্গে পড়তে পারত। আর রটে যেত , ডাক্তার যে ভূতটা তাড়িয়েছে, সেই ভূতই গাছের ডালটা ভেঙ্গে দিয়ে গেল।
ভালো লেখা।