চোখ কপালে তোলার কিছু নেই। আজকাল শুধু হাতে অঢেল পয়সা থাকা মহিলারা নয়, মধ্যবিত্ত ঘরের মহিলারাও পরামর্শ নিতে আসেন–কি ভাবে স্তনের গঠন বদলানো যাবে –বাড়ানো,কমানো অথবা আরো সুগঠিত। বিভিন্ন পত্র পত্রিকার ‘রূপচর্চা’ কলামে আজকাল হামেশাই এসব নিয়ে লেখা হয়। কসমেটিক্স ব্রেস্ট সার্জারির ভয়ানক খরচ, বিপদ,খুব বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া ইনসিওরেন্সও পাওয়া যায় না –তবু তা অনেক মেয়েদের টানে। যে দেশে নুন আনতে পান্তা ফুরায়, যে দেশের ত্রিবাঙ্কুরে, এই তো সেদিন–১৮৫৯ সাল পর্যন্ত কি মারাত্মক আইন ছিল — নিম্নবর্গের মেয়েদের বক্ষআবরণী ব্যবহার করলে “স্তনশুল্ক” দিতে হত –নিজের স্তন কেটে ফেলে নাঙ্গেলি যে আইনের প্রতিবাদী শহিদ,যে দেশে আজ পর্যন্ত অধিকাংশ মহিলার পরনের কাপড়ই জোটেনা তো ব্লাউজের নীচে ব্রা!! সেই দেশে এসব বাহারি অপারেশনের খোঁজখবর চাইলে ছুরির ফলার মতো মনকে ফালা ফালা করে কাটে অন্য এক পরিসংখ্যান।
ভারতে প্রতি চার মিনিটে একজনের ব্রেস্ট ক্যান্সার শনাক্ত হয়, প্রতি তেরো মিনিটে একজন ব্রেস্ট ক্যান্সারে মারা যান। কয়েকবছর আগেও ভারতে সারভাইকাল (জরায়ু মুখ) ক্যান্সারের হার ছিল সর্বাপেক্ষা বেশী। বর্তমানে সবচেয়ে বেশি ব্রেস্ট ক্যান্সার। এর প্রাদুর্ভাবের হার বছরে ২৫.৮% –অর্থাৎ বছরে প্রতি একলাখ জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ছাব্বিশ জন এই কর্কটের কামড়ে আক্রান্ত হন। ভাবা যায়! এই মুহূর্তে গোটা দেশে পঞ্চাশ জন করোনা ভাইরাস আক্রান্ত নিয়ে ১৩৭কোটি মানুষের প্রত্যেকে প্রতিটি শ্বাস নিতে গিয়ে ভয়ে মূর্চ্ছা যাচ্ছেন –পাশাপাশি বছরে প্রতি একলাখ জনসংখ্যার মধ্যে সাতাশ জন ব্রেস্ট ক্যান্সারে মারা যাচ্ছেন তবু কারো কোন হেলদোল নেই।
ফোনের প্রতিটি কলার টিউনের শুরুতে বার্তা ছড়িয়ে দেবার ফলে করোনা ভাইরাস নিয়ে পাড়ার রিক্সায়ালা ভাই থেকে শুরু করে অফিসের বড়সাহেব সবাই সন্ত্রস্ত ও সচেতন। সারা দেশে সব জমায়েত বন্ধ। এই সচেতনতার বার্তা মাত্র কয়েক সপ্তাহে বস্তি থেকে রাজপ্রাসাদ সব ঘর দুয়ারে পৌঁছে গেছে। কারণ–সরকার সচেতনতা বার্তা পৌঁছাতে তৎপর হয়েছেন। এর অর্ধেক তৎপর হলে কবেই টিবি রোগ নিয়ন্ত্রণে আনা যেত –মাল্টিড্রাগ প্রতিরোধী যক্ষ্মা তৈরীই হত না।
ব্রেস্ট ক্যান্সার ঠিক সময়ে ধরা পড়লে আর ঝটপট চিকিৎসা হলে বেঁচে যাবার সম্ভাবনা অন্য ক্যান্সারের চাইতে অনেক বেশী। ঠিক সময়ে ধরা পড়ে না কারণ এখন পর্যন্ত নিয়মিত পরীক্ষা বা স্ক্রিনিং এর জন্য আমাদের কোনো সরকারি প্রকল্প নেই। সুতরাং কোনো সচেতনতাও নেই। আমেরিকায় ব্রেস্ট ক্যান্সারের রোগীদের পাঁচ বছর বাঁচার হার ৮৯% , আমাদের দেশে তা ৬০%। এর কারণ যে শুধু ওদেশের উন্নত চিকিৎসা পরিকাঠামো তা নয়। ভারতে ৫২% ব্রেস্ট ক্যান্সার যখন ধরা পড়ে তখন রোগের মাত্রা — গ্রেড তিন অথবা চারে পৌঁছে গেছে অর্থাৎ অনেকটা ছড়িয়ে পড়েছে! এক চিলতে সদিচ্ছা থাকলেই এত দেরিতে ধরা পড়া ব্যাপারটা আটকানো যায়।
বিষয়টা এত স্পর্শকাতর–যতই বল না কেন লজ্জা না পেয়ে খোলামেলা আলোচনা কর, মহিলারা অপারগ। শুধু গ্রামের মহিলা নয় –শহুরে শিক্ষিত মহিলারাও এগিয়ে আসেন না। বড় সুপারস্পেশালিটি হাসপাতাল বানাও, দামী দামী যন্তর কেনো –আরে বাপু, প্রাথমিক ভাবে কর্কট দানা বেঁধেছে কিনা বুঝতে এসব কোনো আয়োজনের কিচ্ছু দরকার নেই। একটু বুঝিয়ে দিলে সব মহিলা নিজেই নিয়মিত নিজের পরীক্ষা করতে পারেন। মহিলা স্বাস্থ্য কর্মীদের যদি একদিনের ট্রেনিং এ শেখানো হয় কি কি লক্ষণ দেখে ব্রেস্ট ক্যান্সার শনাক্ত করা হয়–যেমন স্তনে কোনো গুটি আছে কিনা, স্তনবৃন্ত থেকে কোনো ক্ষরণ হয় কিনা, স্তনবৃন্ত বা স্তনের ত্বক কোথাও কুঁচকে ভেতরে ঢুকে আছে কি, বগলে কোনো গুটি আছে কিনা–ব্যাস। এবার এই স্বাস্থ্যকর্মীরা মহিলাদের শেখাতে পারেন কিভাবে নিজেই নিজের স্ক্রিনিং করা যায়। প্রাথমিক ভাবে দু’ধরনের স্ক্রিনিং হয়–Clinical Breast Examination (CBE) যা ডাক্তার দেখবে আর Self Breast Examination (SBE) যা নিজে দেখা সম্ভব গ্রামেগঞ্জে পাশকরা অ্যালোপাথ ডাক্তার হাতে গোনা, মহিলা ডাক্তার আরো কম– প্রতি দশহাজার জনসংখ্যাতে একজনেরও কম মহিলা ডাক্তার গ্রাম এলাকায় –সুতরাং যেখানে এটা ডাক্তারিমতে সম্ভব- নিজেই নিয়মিত নিজের পরীক্ষা করতেই পারে মেয়েরা। সন্দেহজনক কিছু পেলে ম্যামোগ্রাফি,ইউএসজি দ্বারা নিশ্চিত হওয়া। তারপর কোথায় দেখাতে যাবে যেখানে ক্যান্সারের চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত আছে,এমন হাসপাতালে রোগীকে রেফার করতে হবে।
প্রথম ধাপ–নিজে নিজের পরীক্ষা, এ সচেতনতা যদি বা তৈরী করা গেল। পরের ধাপ আর এগুতে চায় না। প্রথম চিন্তা কোথায় দেখাতে যাবে, লজ্জা ভয় সংশয় –পরিবারের লোকজন জানলে কি বলবে, স্বামীর প্রতিক্রিয়া কি হবে, অপারেশন করতে হলে পরবর্তী বিবাহিত জীবন সুখের হবে কিনা বা আদৌ বিয়ে টিঁকবে কিনা, লাখো চিন্তায় এক পা এগোয় তো দশ পা পিছিয়ে যায়। কখনো বা ভাবে –ও তেমন কিছু না, পাড়ার হোমিওপ্যাথি ডাক্তারবাবুকে বলে ওষুধ খেলেই কমে যাবে। মটরদানা বাড়তে থাকে……
সদ্য নারীদিবস পেরিয়ে এলাম–অনেক হৈচৈ ঘটা করে পালন টালন হল। যে মেয়েরা কম খেয়ে বেশি খেটে শুধু ঘরের নয়, দেশেরও টাকা বাঁচায় –তাদের মারণরোগের জন্য আজও কোনো জাতীয় প্রকল্প তৈরি হয় না কেন? রোগটা ছোঁয়াচে নয় বলে নাকি শুধু মেয়েদের অসুখ বলে!
খুব ভালো লাগলো