গভীর সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে মানুষের আচরণ সমতা হারায়। তেমনটাই ঘটেছে এই কোভিড অতিমারীর কালে। বিশেষত: শিশু ও কিশোর-কিশোরীরা ভীষণভাবে বিপর্যস্ত। গত এক বছর যাবত বাড়িতে বন্দী থেকে তারা অনলাইন পড়াশোনা নামক প্রহসনের শিকার। গ্রামে গঞ্জে সে সুবিধা না থাকায় অনেক শিক্ষার্থী পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। আছে আমাদের বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন শিশুরা। প্রশিক্ষণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের জীবনের জট আরো পাকিয়ে উঠেছে। বিভিন্ন মানসিক ও আচরণগত সমস্যার জালে ক্রমাগত জড়িয়ে পড়ছে আমাদের তরুণ প্রজন্ম। এই অবস্থা কতদিন চলবে তাও আমাদের জানা নেই। আমাদেরকেই অনিশ্চিয়তা আর অনির্দিষ্টকালের এই কুহক কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে হবে। ভুললে চলবে না সব রাতের পরেই ভোরের আলো ফুটে ওঠে, সব ঝড়ই একদিন থেমে যায় , সব কালোর শেষে আলো নিশ্চয় থাকে।
মানসিক ও শারীরিক ভাবে ভাল থাকার বীজ মন্ত্র হলো :
1. ভাল লাগা (pleasure)
2. ব্যস্ততা ( Engagement)
3. অর্থবহতা ( meaning)
অভিভাবক হিসাবে আমাদের এই দিশাহারা শৈশব ও তরুণ প্রজন্মকে এমন কিছু কাজে ব্যস্ত রাখতে হবে যাতে তাদের ভাল লাগা আছে আবার যে কাজে ব্যস্ত থাকলে সে তার মতো করে একটা অর্থবহ সময় কাটাতে পারবে। যেমন শিশুরা অনেকক্ষেত্রে ছবি আঁকতে ভালবাসে, বা তাদের যদি গল্প শোনার ব্যবস্থা করা যায় তাহলে তাদের ভাল লাগার সাথে সাথে আমরা অর্থবহ ব্যস্ততাও তৈরি করতে পারব। যে সব শিশু বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন তাদের ঘরে রেখেই ছোট্ট ছোট্ট পুরস্কারের মাধ্যমে নিজের পরিচর্যার ট্রেনিং দেওয়া চলতে পারে। বিশেষ করে সেই সব অভিভাবকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি যাঁরা তাঁদের বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যাচ্ছিলেন অথচ বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের ট্রেনিং বন্ধ আছে। বাচ্চারা এতদিন যা শিখেছে সেটা বাড়িতে অভ্যাস করাতে থাকুন। কারণ এই সব শিশুর প্রধান সমস্যা হলো এরা পরিস্থিতি অনুযায়ী তাদের শিক্ষাকে সাধারণের মতো প্রয়োগ করে উঠতে পারে না। কিন্তু আবেগ ও অনুভূতির ক্ষেত্রে এই শিশুরা বিশেষভাবে সংবেদনশীল। তাদের আবেগসঞ্জাত সমস্যা এড়াতে এমন কাজে ব্যস্ত রাখা প্রয়োজন যাতে শিশুটি একই সঙ্গে ভাল লাগা পেতে পারে ও নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করতে পারে। কিশোর বয়সের ছেলে মেয়েরা এই মূহূর্তে যে সমস্যার মুখোমুখি তা হলো অনিশ্চিয়তা। সমস্ত রাজ্যে এবং কেন্দ্রীয় বোর্ড মিলিয়ে লক্ষ লক্ষ ছাত্র ছাত্রী এই মূহূর্তে দিশাহারা। তাদের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে তারা বুঝতে পারছে না কি করণীয়। পড়ায় মনোযোগ ধরে রাখা মুস্কিল হচ্ছে, অনলাইন গেমের আসক্তি বাড়ছে, বাড়ছে সোশ্যাল মিডিয়ার নেশা। এই পরিস্থিতিতে অভিভাবকদের উচিত তাদের সঙ্গে বসে তাদের সমস্যা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করা। কিছু দিন পড়াশোনা থেকে ছুটি নিয়ে এমন কোনো কাজে তাদের উৎসাহিত করা উচিত যাতে তারা ভাল লাগার সাথে সাথে ব্যস্ত থাকতে পারে ও অর্থবহ জীবন যাপন শিখতে পারে। তাদের আগ্রহ অনুযায়ী কোন বিষয়ে যেমন গান, নাচ, আবৃত্তি ইত্যাদি বিষয়ে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে তারা অংশগ্রহন করতে পারে। গ্রামের দিকে যাঁরা থাকেন প্রকৃতির পরিচর্যা করতে পারেন। আসলে কম বয়সী বা বেশি বয়সী সবার ক্ষেত্রে এই সত্য প্রযোজ্য। আমরা কাজ করি জীবন ধারণের জন্য ঠিকই কিন্তু সবার কাজের অবদান বৃহত্তর সমাজে আছে। সেই অবদানের কথা যদি আমরা উপলব্ধি করি তা হলে আমাদের সাধারণ কাজ করেও আত্মসন্তুষ্টি সম্ভব। যেমন ধরুন যিনি রিক্সা চালাচ্ছেন তিনি এই কাজ করে তাঁর পেট চালান সেটা যেমন ঠিক তেমন এই কাজের মাধ্যমে তিনি সাধারণ মানুষকে পরিষেবা দিচ্ছেন সেই বোধ মনের মধ্যে জাগলে তাঁরও একটা ভাল লাগা তৈরি হবে যে তিনিও গুরুত্বপূর্ণ।
আসলে আমি যেটা বলতে চাইছি মানসিক রোগ না হলেও মানসিক ভাবে ভাল থাকাটা একটা শেখার বিষয়। এই ভয়ানক অন্ধকার সময়ে, এত রোগ, শোক, মৃত্যুর মাঝে দাঁড়িয়ে ভাল থাকার লড়াই চালাতে গেলে খুব সামান্য বিষয়েও নিজের অবদান বিষয়ে আমাদের সচেতন হতে হবে। যেমন এই পরিস্থিতিতে মাস্ক পরুন, হাত ধোয়ার অভ্যাস রাখুন, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখুন। এটা কেন করবেন? কারণ এই সমাজের প্রতি আপনার দায়বদ্ধতা আছে। এতে শুধু নিজের সুরক্ষা নয় আপনি আর পাঁচ জনকে সংক্রমণ থেকে বাঁচাতে পারবেন। কাজ করুন আবার কাজের ফাঁকে ফাঁকে কিছু অকাজও করতে শিখতে হবে আমাদের। যে অকাজগুলো আমার আমিকে বিশেষ করে তোলে। নিজের কাছে, সবার কাছে।