আজকের শক্তিই, আগামীর আশা।
৩০ শে মার্চ পেরিয়ে এলাম। বিশ্ব বাইপোলার দিবস। এবারের বাইপোলার দিবসের থিম- Strength for Today, Hope for Tomorrow।
বাইপোলার (Bipolar) হল একধরনের ব্রেইন ডিসঅর্ডার যা মূলত আমাদের ইমোশান (emotion) বা মুড (Mood)-কে অর্থাৎ মানসিক আবেগ বা অনুভূতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে, এমন ভাবেই প্রভাবিত করবে যে আমরা পুরোপুরি আমাদের অনুভূতি দিয়ে চালিত হই, পাশাপাশি মানুষের নিজের কাজ করার ক্ষমতা ও নিজের কর্মশক্তি সম্পর্কে ধারণা সাংঘাতিক ভাবে বাড়িয়ে দেয় বা কমিয়ে দেয়।
এর মূলত তিনটে অবস্থান থাকে- বাইপোলার ম্যানিয়া (mania), বাইপোলার ডিপ্রেশান (depression) এবং একেবারে স্বাভাবিক অবস্থায় থাকা। কারও কারও ক্ষেত্রে অবশ্য ডিপ্রেসিভ এপিসোড অর্থাৎ মানসিক অবসাদের পর্যায় নাও থাকতে পারে।
আমাদের দেশে NMHS (National Mental Health Survey ২০১৫-২০১৬) সার্ভে দেখেলে বাইপোলার ডিসঅর্ডার এর উপস্থিতি ০.৩%। কিন্তু সাংঘাতিক রকমের ভয়ের ব্যাপার হল এর ট্রিট্মেন্ট গ্যাপ -যা প্রায় ৭০%। অর্থাৎ ৭০% বাইপোলার ডিসঅর্ডারের রোগীরা চিকিৎসা থেকে দূরে। তার মানে দাঁড়ায় ১৪০ কোটির দেশে ০.৩% হল ৪০-৪৫ লাখ- যারা কিনা বাইপোলার রোগের শিকার! এর মধ্যে ৭০% মানে ৩০-৩৫ লাখ লোক কোনো রকম চিকিৎসা পায় না! এটা শুধুমাত্র ৩৫ লাখ মানুষ নয়! ৩৫ লাখ পরিবার আসলে এই রোগের দ্বারা আক্রান্ত! রোগী শুধুমাত্র একা কষ্ট করছেন এইরকম নয় ব্যাপারটা! একই সঙ্গে তাঁর পরিবারের লোকেরাও যন্ত্রণার শিকার!
যখন আপনি বাইপোলারে আক্রান্ত হন তখন আপনার মুড অর্থাৎ ইমোশান এমন জোরালো ভাবে আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করে, এই ইমোশান স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক সুতীব্র ও আলাদা হয়, যদি চিকিৎসা না করানো হয় তাহলে এই পরিবর্তন আপনার কাজের জায়গায় ক্ষতি করতে পারে, আপনার ব্যক্তিগত সম্পর্কে সমস্যা তৈরি করতে পারে। আপনি এই সময় ভুল সিদ্ধান্ত নেবেন, আপনার নিজের সম্বন্ধে ভ্রান্ত, বিকৃত ধারণা তৈরি হবে। চিকিৎসা না করালে অনেকেই সুইসাইড করেন।
একজন বাইপোলার ম্যানিয়াতে থাকলে তার মন মেজাজ বেশ ফুরফুরে থাকে, স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ফুর্তিতে থাকে, তার সৃষ্টিশীল কাজের পরিমাণ বেড়ে যায়। এই ম্যানিক এপিসোড একসপ্তাহ থেকে প্রায় ৫-৬ মাস অবধি থাকতে পারে।
বাইপোলার ম্যানিয়াতে যে ধরণের লক্ষণ সাধারণত দেখা যায়-
মন মেজাজ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি ভালো থাকে অথবা কখনও খিটখিটে মন-মেজাজও থাকতে পারে, যদি নিজের প্রকৃত ক্ষমতার চেয়েও বেশি ক্ষমতাবান বা শক্তিশালী কিম্বা গুরুত্বপূর্ণ লোক বলে মনে করা, রাতে না ঘুমিয়ে জেগে থাকা, আগের চেয়ে বেশি কথা বলা, মাথার মধ্যে একটার পর একটা বাড়তি কাজ করবার প্ল্যান তাড়াতাড়ি আসতে শুরু করে, যেন একটা শেষ না হতেই আর একটা ঘাড়ের কাছে এসে হাজির! খুব সহজেই নিজের কাজে অমনোযোগী হয়ে পড়া, সামাজিক ভাবে কাজের জায়গায়, স্কুলে অথবা যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে উদ্দেশ্যমূলক কাজ অনেকটা বেড়ে যাওয়া কিম্বা লক্ষ্যহীন ভাবে উত্তেজিত হয়ে কাজ করে চলা!
প্রচুর পরিমাণে বিভিন্ন হঠকারী কাজ কর্মে নিজেকে জড়িয়ে ফেলা, যার ফলে পরবর্তী কালে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থাকে!
অনেকের ক্ষেত্রেই এর পাশাপাশি সাইকোটিক সিম্পটোমও অর্থাৎ delusion (ভ্রান্ত বিশ্বাস), hallucination- (অস্তিত্বহীন এমন কিছু উপলদ্ধি করা) থাকতে পারে।
অবশ্যই মনে রাখতে হবে উপরের বর্ণিত সমস্যাগুলো কারো মধ্যে ধরে ধরে খুঁজে পেলেই তাকে ম্যানিক এপিসোড বলে দাগিয়ে দেবেন না! প্রথমেই তাকে একজন পেশাদার মনোবিদ এর কাছে নিয়ে যান তাঁর ক্লিনিকাল অবসারভেশানের জন্যে!
এবার বাইপোলার ডিপ্রেশান নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। এটি হল ম্যানিক এপিসোড এর ঠিক উলটো। যেসময় আপনার মনের স্বাভাবিক ফুর্তি, আনন্দ কমে আসে, মন খারাপ থাকে আগে যে জিনিসগুলো আপনার মুডকে ভাল করে দিত, আনন্দ দিত তা যেন ফিকে হয়ে আসে। মন মেজাজ এতটাই তলানিতে এসে ঠেকে যে কোনও কিছুই আপনাকে ‘হাই ফিল’ করাতে পারে না।
অপরাধবোধ, অসম্পূর্ণতা, আশাহীনতা আপনাকে গ্রাস করে। ভবিষ্যতে ভাল কিছু হবে না। নিজের খিদের অভ্যাস ও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। মরে যাবার ভাবনা ও সুইসাইডের চিন্তা মাথায় আসতে থাকে।
লক্ষ্যণীয় যে উইনিপোলার ডিপ্রেশান (unipolar) অর্থাৎ মেজর ডিপ্রেশিভ ডিসঅর্ডার (MDD)-এর সাথে এর অনেক মিল আছে। একজন দক্ষ পেশাদার মনোবিদ ক্লিনিকাল অবসারভেশানের এবং হিস্ট্রির মাধ্যমে বাইপোলার ডিপ্রেশান আর উইনিপোলার ডিপ্রেশানের মধ্যে পার্থক্য করতে পারেন।কারণ এই পার্থক্য অত্যন্ত আবশ্যক- উইনিপোলার ডিপ্রেশানের চেয়ে বাইপোলারে সুইসাইডে মারা যাবার সম্ভাবনা অনেক বেশি এবং দুটোর চিকিৎসা এক্কেবারে আলাদা।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েন এনারা, যা তাঁদের আরও খারাপের দিকে নিয়ে যায়। সর্বোপরি বাইপোলার অনেক সময় খুব ভয়াবহ এবং অসহ্য হয়ে ওঠে রোগী এবং তাঁর পরিবারের কাছে, সঠিক ভাবে এই রোগকে না বোঝা এবং সামাজিক স্টিগ্মা, ভয়, চিকিৎসা না করানো আরও যন্ত্রণার দিকে নিয়ে যায়।
নিয়মিত ওষুধের মধ্যে থাকা।
এই রোগের লক্ষণই হল বারবার করে ফিরে আসা। পরিবারের লোকজন এবং রোগী দুজনকেই রোগ সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। রোগ এবং রোগের ফিরে আসার লক্ষ্মণ বুঝতে পারা যেমন- যদি হঠাৎ করে ঘুম কমে গিয়ে এনার্জি ফিরে আসা, নিজেকে আলাদা ভাবে স্পেশাল ভাবতে থাকা এগুলো হল ম্যানিক এপিসোড ফিরে আসার লক্ষ্মণ। কিম্বা এনার্জি কমে যাওয়া, লম্বা সময় ধরে বেডে শুয়ে থাকা, হঠাৎ করেই চোখে জল চলে এসে কাঁদতে শুরু করা, সুইসাইডের চিন্তা ভাবনা আসা এসব ডিপ্রেসিভ এপিসোড ফিরে আসার লক্ষ্মণ। এইসব লক্ষ্য করলেই রোগীকে মনোবিদের কাছে নিয়ে যান ওষুধ শুরু করবার জন্যে।
সবশেষে এইটাই বলার ওষুধ খেয়ে বাইপোলারে আক্রান্ত রোগীরা ভালো থাকেন! কিন্তু ওষুধ যদি অনিয়মিত হয় তাহলেই সর্বনাশ! যেহেতু এই রোগে এপিসোড ফিরে ফিরে আসাটাই ধর্ম এবং যত বেশি এপিসোড হবে তত বেশি মস্তিস্কে চাপ পড়বে, কাজ করার প্রবণতা কমতে থাকে, ওষুধের কার্যক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকবে! তাই রিলাপ্সকে আটকানোই, এই রোগের চিকিৎসার মূল জিনিস! ওষুধ অনিয়মত যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে! যদি কেউ অনেক দিন একদম সুস্থ থাকেন ওষুধ খেয়ে তাহলে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করেই ওষুধ বন্ধ করবেন বা ডোজ কমিয়ে আনার কথা ভাববেন করবেন!
বিভিন্ন নেশা জাতীয়দ্রব্য থকে দূরে থাকা, রেগুলার এবং স্বাস্থ্যকর ঘুম, এই সবকিছু নিয়ে একজন মানুষ বাইপোলার ডিসঅর্ডারকে সফল ভাবে জয় করতে পারেন!