কোভিড পৃথিবীতে নেই তখন| জীবিকা হারানোর প্রশ্ন ও সমস্যা এমন করে শরীর মনকে পাক দিয়ে ধরেনি| সেসময় কিছুদিন ধরে দুটি মুসলিম কিশোরীর সাথে বেশ বন্ধুভাব জন্মাচ্ছিল আমার| কেন? তারাও বলেনি– আমিও খুঁজিনি কারণ| কেবল ধরে নিয়েছিলাম এ জন্মাবে| হয়ত তারাও তাই ভেবেছিল| প্রেম জন্মানোর কারণ স্থায়িত্ব এসব নিয়ে ধান্দাহীন মানুষ চিরধাঁধাঁয় থাকে|
খুব ভোর ভোর তারা আমার বাড়ি আসত| বাড়ির কিছু কাজকর্ম করে দিত| ছোটো মেয়েটার সর্বদাই মুখে খৈ ফুটছে| হাঁটাচলায় নদীর স্রোতের ঢেউ| বড়টা শান্ত| এমন শীতের দিনগুলোতে তার সমস্ত শরীর ঢাকা থাকত একটি কালো বোরখায়| জিজ্ঞেস করেছিলাম— বোরখা কেন? ফিক করে হেসে আগ বাড়িয়ে উত্তর দিল ছোটো—- দূর ও তো শীতে কেবল গরম হওয়ার জন্য| শীত শেষ তো আমাদের বোরখাও সুটকেসে
মাঝে মাঝে খবর নি— হ্যাঁ রে, তোদের গাঁয়ে হিন্দু মুসলিম বেশ মিলেমিশে থাকিস তো? উত্তর—থাকব না কেন সেইটা আগে বল তো দিদি! ভালোবাসা না থাকার চিন্তা কেন এল আগে তুমি সেটা বল| বন্ধুবান্ধবদের সাথে ঝগড়া করে মরব– এমন হঠাৎ কেন ভাবলে দিদি? সবাই আমরা গরিব মানুষ দিদি– সবাই গরিব —-
স্তম্ভিত হয়েছিলাম রাজারহাটের সুদূর গ্রাম থেকে পনেরো বছরের মেয়ের একতা নিয়ে এই সত্য আকুলতায় — সর্ব মানবের গরিব হওয়ার এই মহার্ঘ ব্যথায়| কারণ তার ভুবন তো তার গ্রাম| হয়ত সে বুঝতে পেরেছিল প্রতিদিন না হওয়া ঝগড়ার কথাই শুনতে চাই আমি— শুনে তৃপ্ত হই| শেয়ালের শিকার খাওয়ার মত করে খুঁজি বানিয়ে তোলা বিভেদ এবং বিভেদ উপশমে ততোধিক বানিয়ে তোলা প্রীতির পাশবিক ফর্মুলাটাকে|
তারপর থেকেই দেখতাম — বড় ছোটো দুটো পাখিই অবিশ্রাম তাদের গাঁয়ের প্রেমকথা বলে বলে আমায় ফ্রেশ করে দিয়ে যায়| গরম কচুরি খেতে ভালোবাসে বলে রোজ তাদের কিছু করে পয়সা দিতাম| একদিন সকালে একটু শরীর খারাপ লাগছিল| সেদিন তাদের কাছে গাঁয়ের গরিব মানুষদের (দুই ধর্মীয় প্রজাতির নয় ভাই) মিলনের গল্পও শুনতে পারিনি| বিছানা থেকে উঠে না পেরে বললাম— ব্যাগ থেকে তোরা নিয়ে কচুড়ি কিনে খা| খলবলে মেয়েটা আর তার একটু শান্ত দিদিটা দুজনেই কেমন চুপচাপ হয়ে গেল| ট্যারা চোখে বিছানায় আমার শুয়ে থাকা দশাটা লক্ষ্য করল কাজের ফাঁকে ফাঁকে| খানিক চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল|তারপর বললে, আজ থাক|কাল সুস্থ হয়ে আগে আমাদের গপ্প তারপর কচুড়ি দিদি| সেদিন দিনের শুরুতেই আমার আঁজলায় এসেছিল দুই কিশোরীর অনেকটা ভালোবাসা| ঠিক করেছিলাম পরদিন তাদের পরিয়ে দেব দুডজন কাঁচের চুড়ি| দুরকম রঙের — তাতে রুপালি চিকমিক|
কোভিড এল|
শুনতে পাই বড় ছোট দুটোরই বিয়ে হয়ে গেছে| জানি না– আজো তারা বোরখাকে শীতের পোশাক ভেবে শরীর গরম করে কিনা! জানতে ইচ্ছে হয়|
না— এ কোনো হিন্দু মায়ের মুসলমান কন্যাকে সন্তান ভাবার গল্প নয়| এ হল এক মধ্যবিত্ত মায়ের তার দুই গরিব মেয়েকে চুড়িতে সাজানোর গল্প|
ওমা! লিখতে লিখতে দেখি কখন যেন বাইরে ঝুপ ঝুপ বৃষ্টি নেমেছে| দ্যাখো দিকি — এই শীত – এই গরম –আবার এখন বৃষ্টি? তাতে আবার আকাশে গোটা তিন চার তারা! প্রকৃতির এ ভিন্নতার কারণ? কারণ — তা ভিন্ন নয়| একটিবার ভাবুন — ঝড় বৃষ্টি রোদ এরা মাটিরও –আকাশেরও –আবার বনপাহাড়েরও| তাই না? একই পাখি দু প্রান্তরে তাদের রব দেয়| প্রান্তমানুষেরা মিষ্টান্নের মত চেটে খায় সে ডাক|
বৃষ্টিভেজা নক্ষত্র বলে— যা তোর নিজের তা দুবার নিজের ভাবিস না|
দে ! আমাদের ছাতা দে||
গা ফা শুকোই|
সরে দাঁড়া|
আলো দি —
ভালোবাসার গল্প। স্নেহের গল্প। সম্প্রীতির গল্প। ভালো লাগলো।
ভারি ভালো লাগলো এই সম্প্রীতি র গল্প