ঠিক যেমন কোনো ব্যাকটেরিয়ার জন্য ফোঁড়া হয়, টাইফয়েড হয়, টিবি হয়, পেট খারাপ হয় –সেরকমই একটা ব্যাকটেরিয়ার জন্য কুষ্ঠ হয়। সে সব কথা বুঝতেই অনেক দিন লেগে গেল। আরো অনেক দিন লাগল দুনিয়া থেকে কুষ্ঠরোগ দূর করতে। একেবারে দূর হতে আরো ঢের দেরী। কিন্তু এই যে ভারতে স্বাধীনতার পরে ১৯৪৭-এ কুষ্ঠ রোগের ব্যাপকতা (prevalence ) ছিল ৫০ অর্থাৎ প্রতি দশহাজার জনসংখ্যায় বছরে নতুন কুষ্ঠরোগীর সংখ্যা পঞ্চাশ –তা ২০০২ সালে কমে গিয়ে হল একের নীচে –তাই বা কম কি? আর এই লড়াইতে আমরা ছিলাম একদম নীচুতলার সৈনিক। কিন্তু উঁচুতলার নীতিনির্ধারকরা সরাসরি যা দেখেন না আমরা তা দেখেছি খুব কাছ থেকে।
দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর সরকারি কুষ্ঠ আধিকারিকের দায়িত্বে থেকে, স্ট্যাটিসটিক্যাল রিপোর্টের বাইরে যা দেখেছি –আজ কুষ্ঠ রোগ নিয়ে সেই প্রাগৈতিহাসিক দেখাটুকু বলি কেমন? হ্যাঁ প্রাগৈতিহাসিক তো বটেই –একালের নিউরোলজির বিশেষ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারেরও কুষ্ঠ রোগ চিনতে অসুবিধা হয় কারণ তাঁরা ছাত্র অবস্থায় এই রোগী বেশী দেখেননি। বয়স বাড়লে এই এক জ্বালা –এত কথা বলার থাকে যে কোনটা ছেড়ে কোনটা বলি খেয়াল থাকে না।
আমাদের মহকুমা হাসপাতালে কুষ্ঠ রোগীদের চল্লিশ বেডের একটা ওয়ার্ড ছিল। স্যানাটোরিয়াম কনসেপ্ট উঠে না গেলে ওই শব্দটাই বেশ যুৎসই হত। বেশ কয়েকটি জেলার মধ্যে এটাই ছিল এই রুগীদের ভর্তি হবার একমাত্র ঠিকানা। সত্যি কথা বলতে যেসব কুষ্ঠ রোগীর আস্তানা নেই, হাত পা ঠিকঠাক কাজ করে না তাদের একটা ঠাঁই। MDT খেয়ে কুষ্ঠ রোগটা সেরে গেলেও যদি সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু না হয় তাহলে কিছু অঙ্গবিকৃতি, ত্বকের অনুভূতির নার্ভ অকেজো হবার ফলে অসাড়ভাব থেকে যায়। ফলে বারে বারে ঘা হয়, এই ধরনের কুষ্ঠ রোগীর থেকে রোগ ছড়ায় না অথচ মানুষ ভাবে এরা বোধহয় আজীবন সংক্রামক রোগী। সুতরাং অস্পৃশ্য।
কুড়ি জন মহিলা বেড, কুড়ি জন পুরুষ। আমার ওপিডি, এমার্জেন্সি ইত্যাদি অন্য সব কাজের উপরে এটা ছিল উপরি দায়িত্ব। প্রতিদিন একবার রাউন্ডে যেতে হত। হাসপাতালের মূল বিল্ডিং কমপ্লেক্স থেকে বহুদূরে এক ভাঙাচোরা পোড়ো বাড়ি। রঙ চটে কবেই। ” L” শেপের দুটো উইং। শালবনের ছায়ায় ছায়ায় শুকনো পাতায় মর্মর তুলে যেতাম। বেশ লাগত ওই পথটুকু। দু’একটা ইঁট খসে পড়া, দেয়াল বেয়ে বৃষ্টির জল চুঁইয়ে পড়ে, কোথাও অশথ চারা –অনভ্যস্ত চোখে হানা বাড়ি মনে হবে বাইরে থেকে। ভিতরে হাসপাতালের সবচেয়ে পরিস্কার ওয়ার্ড। কখনো সব কাজের আগে, কখনো পরে –বেশ একটু সময় নিয়ে যেতাম। একসময় আমার গাড়িটাও ওই ওয়ার্ডের সামনে পার্ক করতাম –তাহলে দুবার ওদের সমস্যার কথা শোনা হত।
এই ওয়ার্ডে যে সিস্টার দিদিরা ডিউটি করতেন –সবাই প্রায় এক পরিবার তখন। বন্দনাদি তখন দাপুটে নেত্রী –ওনার হুঙ্কারে ওই পেশেন্টরা বেশ কিছু সুবিধে পেত–মানুষ বলে গণ্য হত এই আর ক। এই যেমন কিচেন থেকে খাবার দিতে এসে কেউ কেউ ওদের কাছে না গিয়ে অনেক দূর থেকে ছুঁড়ে ছুঁড়ে খাবার দিত। হাসপাতালের চৌখুপি থালাও ওদের জন্য বরাদ্দ নয়। ভাত না হয় কিছুটা ছড়িয়ে ছিটিয়েও থালায় পড়ে, ডাল আর কুমড়োর ঝোলের বেলা কি হবে –ব্যাপারটা দেখে সুপারকে বেশ ঝাঁঝালো ভাবে বলা হল। তারপর থেকে থালায় ভাতের চুড়োয় ডাল তরকারি পড়া শুরু হল। এটুকু প্রাপ্যও যে লড়াই করে আদায় করতে হয় সেকথা অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকতে পারে।
ওখানে যারা থাকত বেশীর ভাগই পার্মানেন্ট –মানে কিছুদিনের জন্য বাড়ি যেত, বাড়ি থেকে খেদিয়ে দিলে অথবা অযত্নে হাতে পায়ের ঘা বাড়লে আবার এসে ভর্তি হয়ে যেত। ২০০৩ সালের আগে কুষ্ঠ রোগীদের জেনারেল ওয়ার্ডে অন্য রোগীর সঙ্গে ভর্তি করা হত না। সুতরাং তাদের যদি অন্য কোনো অসুখ করত তাহলেও এখানে ভর্তি হত। জঙ্গলের ধারে পৃথিবীর বাইরে একটা আলাদা দ্বীপ যেন। যেখানে ওরা থাকত। বাড়ির কেউ আসে না। বছরের বছর একই বেডে থাকতে দেখেছি কয়েকজনকে। ওদের অঙ্গ বিকৃতিও ঠিক হবার নয়। ছুটি দিলেও যায় না কোথাও।
এরকম একজন ছিল ভিখু। হাত পায়ের আঙুল খুইয়েছে অনেক দিন। তিনকুলে কেউ নেই। রোজ ওয়ার্ডের আশেপাশে ঝরা পাতা ঝাঁট দিয়ে তকতকে করে রাখত। আমাদের দেখলেই একগাল হাসি। সব ঋতুর সব দিনগুলোই ওদের ওয়ার্ডে চল্লিশ ওয়াটের বাল্বে আটকে থাকতজ। কোনো ওঠা পড়া নেই। লুকিয়ে চুরিয়ে কেউ মাঝে মাঝে ভিক্ষা করতে বেরিয়ে যেত। সেই পয়সায় পাঁঠার মাথা কিনে আনত। ওয়ার্ডের সামনে একটা মাটির উনুন বানিয়ে রেখেছিল। তাতে লাল লঙ্কা দিয়ে পাঁঠার মাথার ঝোল রেঁধে ফিস্টি করত।
একটা বড় বেল গাছ ছিল সামনে। এখান সেখান থেকে আধলা ইঁট কুড়িয়ে আনত জিতেন। মাটি দিয়ে ইট গেঁথে বেলগাছের গোড়াটা ইঁট দিয়ে বাঁধিয়েছিল জিতেন। একটা সিমেন্টের শিব ঠাকুর আর মাথায় মস্ত ফণা তোলা সাপও গড়েছিল। লুকোনো একটা শিল্পী মন ছিল জিতেনের। সে-ও ওরকম স্থায়ী পেশেন্ট। ওয়ার্ডের ফেলে দেওয়া ছেঁড়া পিচবোর্ড কাগজ দিয়ে পাখি ফুল এটা ওটা বানাত। আমরা একটু তারিফ করতাম, ওয়ার্ডে সাজিয়ে রাখতাম। ওই টুকুই ওর এজন্মের শিল্পীসত্ত্বার প্রাপ্তি।
বন্দনাদি ওয়ার্ডের জন্য একটা টিভি আদায় করলেন রোটারি ক্লাব থেকে। আনন্দের বান এল ওয়ার্ডে। কেবল ছাড়াই তখন টিভি চলত। আলাদা খরচ ছিল না।
ভিখু ফিমেল ওয়ার্ডের একজনকে বিয়ে করে ওর সেই স্পেশাল এক গাল হাসি নিয়ে হাসপাতাল ছাড়ল একদিন। কি খুশি যে হয়েছিলাম আমরা। আহা হাত পা বাঁকা হলে কি হবে, মনটা বড় ভালো ছেলেটার –মনের সুখে সংসার করুক। হাঁড়িকুড়ি বালতি ঘটিও আমরা কিছু দিয়েছিলাম মনে হয়। তা –ভিখুর কপাল খারাপ, কয়েক বছর পর –একেবারে শেষ অবস্থায় এল হাসপাতালে, কাঁদতে কাঁদতে বলল ভিক্ষা কম জুটলেই বউ খুব মারে, খেতে দেয় না। হাজারটা রোগ বাসা বেঁধেছে শরীরে। ইহজীবনের কষ্ট অবশ্য দুদিন পরেই ফুরোল ভিখুর। আমাদের হাতের পাতার উপরে।
এমনি করে অনেক বছর পরে আমাদের হাতের মধ্যেই মারা গেল ধীরেন। ধীরেন দুর্গাপুর ষ্টেশনে ভিক্ষা করত। মাঝে মাঝে পালিয়ে যেত –কদিন ভিক্ষা করে দু’দশ টাকা রোজগার করে আবার এসে হাতে পায়ে ধরত –ভর্তি করে নাও গো দিদিমণি।
আর এক পেশেন্ট ছিল মিঃ পারফেক্ট। আসলে একটা নাম ছিল। আমরা ওই নামেই ডাকতাম। বি কম পাশ ছেলে। ভটচায বাড়ির। কিন্তু ওই যে ট্যাবু। কুষ্ঠ হয়েছে বলে বাড়ির কেউ তার ছায়া মাড়ায় না। দাদা বৌদির কথা ছেড়েই দিলা , মা পর্যন্ত বলত –ওখানেই থাক বাবা, বাড়িতে আমার অন্য ছেলেমেয়ে নাতি নাতনিদের কথা তো ভাবতে হবে। বাবাকে ডেকে বলা হল –আপনার ছেলের অসুখ তো সেরে গেছে, ওর থেকে কারো হবে না আর। বাবা বললেন –‘ওই যে হাতটা থাবার মতো গুটিয়ে গেছে। ওকে বাড়িতে রাখলে পাড়ায় আমরা একঘরে হয়ে যাব’। মিঃ পারফেক্ট কেঁদে কেটে বলে –‘আপনারা ছুটি দিলে আমাকে ভিক্ষা করে খেতে হবে, রাস্তায় থাকতে হবে দিদি’। তা বললে তো হবে না বাপু। তুমি এখন ভালো আছো, ছুটি দিয়ে বেড ফাঁকা করতে হবে। সে রাতারাতি নিজে খোঁচাখুঁচি করে পায়ের ঘা এমন বাড়িয়ে নিল যে সে যাত্রা ছুটি বাতিল। ওর কাছে একটা ছোট বাঁধানো খাতা রাখত –তাতে রোজ বসে বসে ঘড়ি দেখে লিখে রাখত কোন স্টাফ, কোন সিস্টার কটায় ঢোকেন আর কটায় বেরোন। একেবারে মিনিট সেকেন্ড ধরে। সরকারি ডিউটি থেকে কে ক’মিনিট ক’সেকেন্ড ফাঁকি দিচ্ছে সব ওর খাতায় লেখা থাকত। কখনো হাসপাতালের খাবারের গুণগত মানের সমালোচনা করে, কখনো কোন দেয়াল থেকে জল চুঁইয়ে পড়ছে এসব অভিযোগ করে মন্ত্রীদের চিঠি লিখত। সবই ওই খাতায়। মায়া হত –বেচারার লেখাপড়া কোন কাজে লাগল না, ওই খাতাটুকুতেই যেন খেলাঘরের লেখা।
পরে, ওই কজন পেশেন্টদের লেখাপড়া শেখানোও শুরু করেছিল আমাদের উদ্যোগে। গুরুমশাইগিরি করতে পেরে মিঃ পারফেক্ট এর খাতায় অভিযোগ লেখা বন্ধ হল।
এর কিছুদিন পরেই, সম্ভবতঃ ২০০২ সালে WHO এর প্রতিনিধিদল ও সাসাকাওয়া কমিটি ভারতে কুষ্ঠরোগের হালচাল পরিদর্শনে এসেছিলেন। আমাদের হাসপাতালেও স্বয়ং সাসাকাওয়া (যিনি বিশ্বে কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যয়ভার অনেকটা বহন করেন) এসে আমাদের ওয়ার্ডে পেশেন্টদের জড়িয়ে ছবি তুললেন। ওরা আহ্লাদে আটখানা হল। তার একমাসের মধ্যেই ওই ওয়ার্ড বন্ধ হয়ে গেল। মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকেই নিয়ম হল –কুষ্ঠরোগীদের জন্য কোনো আলাদা ওয়ার্ড থাকবে না। সবার সঙ্গে জেনারেল ওয়ার্ডেই ভর্তি হবে। এই নিয়মের উদ্দেশ্য “অস্পৃশ্যতা”-র ট্যাবু মানুষের মন থেকে দূর করা। সত্যি কথা বলতে কি– অন্য অনেক রোগের চাইতে কুষ্ঠ কম ছোঁয়াচে। দীর্ঘদিন ঘনিষ্ঠভাবে একমাত্র সংক্রামক রোগীর (চিকিৎসা না হওয়া মাল্টি ব্যাসিলারি রোগী) সংস্পর্শে এলে, তবেই এ রোগ হবার সম্ভাবনা থাকে। ধীরে ধীরে মনের অন্ধকার দূর হচ্ছে। চাকা লাগানো চেয়ারের মতো কাঠের ঠেলাগাড়ি নিয়ে হাত পা খোয়ানো দুই রোগী ভিক্ষা করছেন –এই নিদারুণ দৃশ্যও সচরাচর আর চোখে পড়ে না। সচেতনতামূলক প্রচারের ফলে, এখন প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষও একটা ছোট সাদা দাগ দেখলেই ডাক্তার দেখাতে আসেন। একদিন এই রোগ পৃথিবী থেকে একেবারে নির্মূল হবে সে আশাও এখন আর দুরাশা নয়।
কিন্ত আমাদের সেই একই পরিবারের সদস্যের মতো THW ওয়ার্ডের পেশেন্টরা কোথায় যে হারিয়ে গেল –আর দেখা হয় নি।
এদিক ওদিক থেকে ডাল ভেঙে এনে যত্ন করে রোপন করে, ছোট্ট একটা ফুলবাগান করেছিল ওরা ওয়ার্ডের সামনে। টগর, গন্ধরাজ, রঙ্গন এইসব আটপৌরে ফুল ফুটত। ফাঁকা স্যালাইনের বোতলের ফুলদানিতে রোজ সকালে কিছু বুনো পাতার সঙ্গে দু একটা টাটকা ফুল তুলে এনে রাখত ওরা। হাত পা না হয় কিছু বিকৃত হয়েছিল অসুখে, মনে ফুলের সুরভি কারো কিছু কম ছিল না।
আজ কয়েক বছর পরে দুর্গাপুর “নবদিগন্ত” কুষ্ঠ কলোনিতে চিকিৎসা শিবিরে গিয়ে দেখা হল কিছু পুরোনো পেশেন্টের সঙ্গে। আয়োজন করেছিলেন অপথ্যালমোলজি সোসাইটি, ডাঃ মনোজ হাজরা।
ফুল দিতে এসে একজন বলল –দিদি চিনতে পারছেন আমি সাধু। কেউ বলল—আমি লতার বোনপো, মাসি আপনার কথা বলত।এখন এখানে একজনও অ্যাকটিভ রোগী নেই, মানে সবাই সুস্থ। স্কুল কলেজে যায় সব শিশু। বড়রা নিজ নিজ পেশায় –তবু শহরের সীমানা পেরিয়ে এদের বসতি। একসময় শুকনো তালপাতা আর প্লাস্টিকে ইগলুর মতো ঘরে থাকতে দেখেছি এদের। শ্রী শঙ্খ সাঁতরা মহাশয় মহকুমাশাসক থাকাকালীন এক অসম্ভব উদ্যোগ নিয়ে এই সুন্দর পাকাবাড়ি, স্কুল, পার্ক, কম্যুনিটি হল করে দিয়েছিলেন। বর্তমান মেয়র অনিন্দিতাদি উদ্যোগ নিয়েছেন রাস্তাঘাট মেরামতি করার। পুনর্বাসন প্রকল্পে রোজগারের পথ দেখাতে চলছে –মাশরুম চাষ, ফুলের নার্সারি।
ফেরার পথ ধরব যখন, একটি ছেলে ফুলসমেত তিনটে ক্যালেন্ডুলা ফুলের চারা এনে হাতে দিল –চোখে জল এল, অস্পৃশ্যতার আড়ালে অগোচরে ফুল গাছেরা তাহলে এবার সত্যিই বাড়ছে।
Chokhe jol eshe galo. Shob lekha ebar portei habe
Indeed inspiring
A very moving and inspiring read.