(এক “পাগলের ডাক্তারের” জবানিতে)
তা, দিনটা তো ছিল ১০ তারিখ, অক্টোবরের। এক-দুদিন আগেই! আজ কেন?
আরে, আমি কি সময়মত সব করে উঠতে পারি, নাকি করেছি কোনোদিন! (স্কুলে তিন থেকে সাত মিনিট লেট তো বাধা ছিল)!
এখন, একটা অবশ্য সুবিধা আছে, “দিবস”টা “সপ্তাহ” হয়ে যায়, “সপ্তাহ”টা “মাস”। এভাবেই একটা সময়ের “ফ্রেম” পাল্টে ফেলা হয়, যেহেতু লক্ষ্যটা হচ্ছে “সচেতনতা” বাড়ানো।
***************************
আচ্ছা, শশী কি বলেছিল, মনে আছে?? …”শরীর! শরীর! তোমার মন নাই, কুসুম?”
(পুতুল নাচের ইতিকথা, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়)
শশী ঠিক বলে নাই।
আসলে “মুন্ডু” আছে!
“… মুন্ডু গেলে খাবোটা কি? মুন্ডু ছাড়া বাঁচবো নাকি?”…
(গুপী গাইন, বাঘা বাইন/ সত্যজিত রায়ের সিনেমা)
হ্যাঁ, মুণ্ডুর হাড় যদি ফাটানো যায় তার ঠিক নিচেই আছে, “মস্তিষ্ক”, বেশ নরম-সরম একটা অঙ্গ। এটিই হার্ড ডিস্ক, মন আর শরীর, দুইকেই নিয়ন্ত্রণ করে।
***************************
এই কারনেই শশী ঠিক বলে নাই। শরীর আর মন, পরস্পর সম্পর্কযুক্ত বিষয়। কোনো আলাদা আলাদা অস্তিত্ব নেই। “মস্তিষ্ক” সবসময় আমাদের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করছে, আবার মনের সমস্ত অনুভূতিগুলোকেও নিয়ন্ত্রণ করছে, কিন্তু ঠিক “ট্রাফিক পুলিশের” মতো লাল-সবুজ বাতি জ্বালিয়ে নয়, একদম পারস্পরিক আন্ত:সম্পর্ককে মাথায় রেখে, বিশ্লেষণ করে।
এর সঙ্গে বাইরের পরিবেশ ক্রমাগত: খাদ্য যুগিয়ে যাচ্ছে, যা শরীর আর মন, দুয়ের চলনকেই একধরনের স্বয়ংক্রিয়, সংশ্লেষিত উপায়ে ধারাবাহিকভাবে চালনা করে যাচ্ছে।
তবু, শরীরের অসুখ হয়, ব্যাথা, বেদনা, বিষ, আমাশা ঝাড়া, বুক ব্যাথা, আরো কত কি! কিন্তু মনের খালি “ব্রেন শর্ট” (স্থানীয় চলতি ভাষায়!) হয়, কিংবা “মাথায় জ্বালা, শরীলে জ্বালা”! তারপর অনেক কথাবার্তা বলে, ঠিক করতে হয়, রোগটা ঠিক কি, সমস্যাটা আসলে কোথায়!
অনেক কথাবার্তা!? বললাম বটে, কিন্তু বলা কি যায়? আউটডোর পরিসরে, এবারের “বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসে”র দিনেও নতুন, পুরোনো মিলিয়ে “রোগী” দেখেছি একশো প্লাস। তাও আবার পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে, ইনডোরে দুটো রেফারালও ছিল। কতটুকু কথা বলা যায়? ঝটাকসে ওষুধ লিখে, স্লিপ দিয়ে পাঠাতে হয়, ফার্মেসীতে।
উপায় কি? লোক বাড়ানো। সমস্যার একটি অংশ যদি এটা হয় যে বড় অংশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কেন্দ্রীয়ভাবে বেসরকারী পরিসরে কাজ করতে পছন্দ করে, তাহলে অন্য অংশটি হল, গোটা দেশের মোট জনসংখ্যার সাপেক্ষে এই ধরনের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা অত্যন্ত কম। ১৪০ কোটির দেশে খুব বেশী হলে সাড়ে পাঁচ হাজারের আশেপাশে হবে। আর সবধরনের মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীকে একসাথে ধরলেও সংখ্যাটা পনেরো হাজারের বেশি কিছুতেই হবে না।
আরেকটা অন্য উপায় হচ্ছে, অন্য চিকিৎসকদের, স্বাস্থ্যকর্মীদের, এই বিষয়ে কিছুটা শিক্ষিত করে তোলা। সেই চেষ্টাও হচ্ছে, গোটা দেশে দীর্ঘ কুড়ি বছরের বেশী সময় এই প্রক্রিয়া চলছে, “জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য প্রকল্প” (NMHP)-এর অধীনে। প্রথমে কিছু জেলাকে “পাইলট” হিসেবে ধরে “জেলা মানসিক স্বাস্থ্য প্রকল্প” (DMHP)-এর অধীনে কাজ হত। পরে তা আস্তে আস্তে বেশীরভাগ জেলাতেই প্রসারিত হয়েছে।
এটি একটি চালু প্রকল্প, মানে এখনো নিয়মিত রীতি-নিয়ম মেনে কাজ হয়। কিছুটা সুবিধা এর মাধ্যমে করা গেছে, এটা ঠিক। কিন্তু, তবু তা নিতান্তই অপ্রতুল।
ফলে উন্নত দেশের মতো, একটি “টিম” হিসেবে প্রচুর সময় নিয়ে একজন রোগীকে দেখা, মূলত: অসম্ভব। হয়তো বেসরকারী “চেম্বার” সেট-আপে রোগী কম রেখে সেটা কিছুটা করা যেতে পারে, কিন্তু রোগীর চাপ সেখানেও কিছু কম থাকে তা নয়, যদি কেউ “প্রতিষ্ঠিত” হয়ে যান। আর নতুনদের ক্ষেত্রে (যারা সরকারী নয়, আবার সরকারীদের একাংশের মধ্যেও) “পেশাগত জীবনের” প্রাথমিক পর্যায়ে রোগীর সংখ্যা বাড়ানো বা অন্যভাবে বললে “পেশাগত জীবনে”র পরবর্তী সুরক্ষার জন্য ক্রমাগত ছুটে বেড়াতে হয়।
আবার এর বাইরেও অনেক চিকিৎসক “মানসিক চিকিৎসা” দিয়ে থাকেন, মানুষের “মানসিকভাবে” ভালো থাকার স্বার্থে (অর্থাৎ “স্বাস্থ্যের” সংজ্ঞাপূরণের জন্য) এরও প্রয়োজন আছে।
কিন্তু আমাদের দেশে তো বটেই, পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেও এই ধরনের “রোগ” বা “সমস্যা”কে এখনও একটা আধিভৌতিক আড়ালের মধ্যে রাখা হয়। অথবা সামাজিক সংস্কারের কারণে “চিকিৎসা” এড়িয়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা আছে। যার ফলে আধুনিক চিকিৎসার সুযোগ অনেকের কাছেই পৌঁছায় না।
অন্য অসুবিধাটি স্বাস্থ্য-অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো অত্যাধুনিক দেশে “স্কিজোফ্রেনিয়া”র মতো মানসিক অসুস্থতার জীবনভর চিকিৎসার খরচ, অনেকক্ষেত্রেই একজন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসার খরচের সমান বা বেশী হয়। আমাদের দেশে “সরকারী স্বাস্থ্যব্যবস্থা”র সুযোগ নিলে হয়তো কিছুটা সুবিধাজনক, কিন্তু সেখানে সব ধরনের “ওষুধ” সবসময় “লভ্য” নয়, আবার যে বড় হাসপাতালে এই অসুস্থতার জন্য যেতে হয় সেখানে মাসে একবার করে পৌঁছানোর খরচও অনেকক্ষেত্রে অনেকটাই।
প্রথমদিকে বোঝানোর সুবিধার জন্য “রোগ” কথাটা ব্যবহার করলেও এখন “অসুস্থতা” বলছি। কারণ, নির্দিষ্টভাবে রোগনির্ণয়ের জন্য যে নির্দিষ্ট পরীক্ষা করতে হয়, “মানসিক স্বাস্থ্যে”র ক্ষেত্রে তা করা যায় না। “মস্তিষ্কের” যে অংশে যে ধরনের “নিউরো-কেমিক্যালের” তারতম্যের জন্য এই সমস্যা হচ্ছে, তা মূলত: কোষের পর্যায়ে, রিসেপটরের পর্যায়ে, যাকে এক্কেবারে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করবার মতো কোনো ব্যবস্থা নেই, এমনকী অত্যাধুনিক দেশেও। হ্যাঁ, পরীক্ষামূলক অনেক কাজ হচ্ছে, নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে।
তাই, আপাতত “রোগ” নয়, “অসুস্থতা”।
আর, এর চিকিৎসা যারা করেন তারা অন্যান্য চিকিৎসকদের কাছে “পাগলের ডাক্তার” ছিলেন অনেকদিন অবধি, আজকাল অবশ্য “সাইকিয়াট্রিস্ট” তকমা জুটছে বেশ। “মানসিক স্বাস্থ্যের” প্রয়োজন নিয়ে অনেকে অনেককিছু ভাবছেন, বলছেন, করছেনও।
***************************
আপনারা কেউ লু সুনের “ডায়েরী অব এ ম্যাড ম্যান” পড়েছেন (আমার কাছে একসময় “অনুবাদ বইটি” ছিল, কিন্তু সুনিপুণভাবে কেউ ঝেড়ে দিয়েছেন)! তবে, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের “চিলেকোঠার সেপাই” বোধহয় অনেকেই পড়েছেন। এদের “মানসিক অসুস্থতা” ছিল বলেই লোকে বলে, এবং সেই অবস্থাতেই লেখাগুলো লেখা। এরা অসাধারন সৃষ্টিশীল মানুষ ছিলেন, এবং এই অবস্থায় কি ধরনের অনুভূতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, তার অনেকাংশ বর্ণনা লেখাগুলির মধ্যে আছে। এবং “খোয়াবনামা” (প্রথমে ভুলে গিয়েছিলাম)।
ঋত্বিক ঘটক মানসিক হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, এবং সেখানে থাকা অবস্থাতেই , সেখানকার স্বাস্থ্যকর্মী ও অসুস্থদের নিয়ে একটি নাটক পরিচালনা করে মঞ্চস্থ করেছিলেন, দাপটের সঙ্গে।
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে শোনা যায় “দ্য ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সী” লেখার সময়, মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন। পরে মানসিক অবসাদের জন্য তৎকালীন যে একমাত্র চিকিৎসা, ECT (ELECTRO CONVULSIVE THERAPY) তা নেওয়ার জন্য বার তিনেক হাসপাতালে ভর্তিও হয়েছিলেন। অনেকটা সুস্থ হয়েছিলেন বটে, কিন্তু লেখক হিসাবে তার সৃষ্টিশীলতা অনেকটা কমে গিয়েছিল বলে শোনা যায়। হয়তো, এই আক্ষেপেই শেষঅবধি “আত্মহত্যা” করেন।
এই সামান্য কটা (আরো অনেক অনেক আছে) উদাহরণ দিলাম একটাই কারণে, যে মানসিক অসুস্থতার মধ্যে দিয়ে সৃষ্টিশীল শিল্পী, সাহিত্যিক, নাট্যকারদের অনেককে যেতে হয়েছে বহুবার, তাদের অনেকের চিকিৎসাও হয়েছে… সেইসময়কার অগ্রগতির ভিত্তিতে। আজ তা আরো অনেক উন্নীত।
***************************
সচেতনতার কথা তো বলতেই হয় আমাদের, কারণ এখনও সংস্কারের বশে উদ্বেগ, মানসিক অবসাদের মতো সাধারণ মানসিক অসুস্থতা যা কর্মজীবনে, সামাজিক জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনছে, সেখানেও কোনরকম মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীর সাহায্য নিতে ইতস্তত: করা হয়। হয়তো এই বিপর্যয়ের কারণে “আত্মহত্যার চেষ্টা” বা একেবারে “আত্মহত্যার” মতো মারাত্মক ঘটনা ঘটে যায়, তবু “সংস্কার” কাটে না।
আর অসংলগ্ন আচরণ কারো মধ্যে দেখলেই “পাগল” বলে চিহ্নিত করে সমাজ থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার একটা সামাজিক প্রবণতা তো দীর্ঘদিনের। অনেক তথাকথিত শিক্ষিত মানুষের মাথাতেও, “অসুস্থতা”, “মানসিক অসুস্থতা” … এইসব শব্দ তখন আর বেরোয় না।
আসুন না, আজ থেকেই আর কোনো অসুস্থ মানুষকে “পাগল” বলবেন না, “অসুস্থতা”কে চিহ্নিত করে তার কাছের মানুষকে যথাযথ, ধারাবাহিক চিকিৎসার পরামর্শ দেবেন। সেটাও অনেকটাই “সচেতনতা” হবে।
[[বিষয়টা এমন যে অনেক কথাই আরো থেকে যায়, তবু থামতে হয়…]]
১২/১০/২০২৩