সে বেশ অনেকদিনের কথা। মানে, বেশ কিছুদিন আগে এই যে সিরিজটা লিখছিলাম, তারও অনেক, অনেকদিন আগের কথা।
বাইরে কোথাও গিয়েছিলাম, ক’দিন চেম্বার বন্ধ ছিল। ফিরে আসার পরে দোকানের দাদা জানালো, এরমধ্যে একজন অদ্ভুত রোগী এসেছিল। সে বলছিল, তার ঘাড়ের পিছনে একটা ফ্যান লাগানো আছে, সেটার সুইচটা “অন” হয়ে গেছে, কিছুতেই “অফ” হচ্ছে না। এই ডাক্তারবাবুই সেটা “অফ” করতে পারবে।
খুব মনোযোগ দিয়ে চেহারা ও প্রকৃতির এবং ঠিকানারও বিবরণ শুনে বুঝলাম, বেশ অনেকদিন আগে এনার আমি চিকিৎসা করেছিলাম।
প্রথমে যখন আসে, অসংলগ্ন আচরণ খুব বেশী ছিল। কিন্তু চিকিৎসায় খুব ভালো সাড়া দিয়েছিল। ছেলেটি শিক্ষিত ছিল, গ্রাজুয়েট। চাকরি না পেলেও বাড়ীতে ছাত্র পড়াতো। অসুস্থ হওয়ার পরে সেসব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু চিকিৎসা চলাকালীন আবার চালু হয়েছিল।
এরমধ্যে হঠাৎ আসা বন্ধ হয়ে গেল। কদিন পরে বাড়ীর লোক নিয়ে আসলো, বেশ খারাপ অবস্থায়। জানা গেলো, ওষুধ কিছুদিন বন্ধ করে দিয়েছিল, তারপরে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল, হঠাৎ। খুঁজে পাওয়ার পর ধরে নিয়ে এসেছে।
আবার চিকিৎসা শুরু হল, আবার অনিয়মিত, আবার নিরুদ্দেশ। এভাবে দুই-তিনবারের পরে আর আসেনি। বিবরণ শুনে বুঝতে পারলাম, সেই ছেলেটিই এসেছিল… এবারে একা, বাড়ীর লোক বুঝি হাল ছেড়ে দিয়েছে।
আশায় আশায় থাকলাম, আবার যদি আসে, আবার যদি চিকিৎসা শুরু করে ওকে সামাজিক জীবনে ফেরানো যায়। কিন্তু না, আর কখনো আসেনি। আমি আশাবাদী, নিশ্চয়ই অন্য কোনো ডাক্তারের নিয়মিত চিকিৎসায় ও এতদিনে সুস্থ হয়ে উঠেছে, ভালো আছে। কিংবা হয়তো…. না, সেসব কথা ভাবতে চাইনা!
রোগটার পোশাকি নাম “স্কিজোফ্রেনিয়া”। সাধারণ মানুষজন এই ধরনের মানসিক রোগীদেরই, অনেকসময় “পাগল” বলে থাকে, কারণ এদের মধ্যেই চিন্তা ও ব্যবহারের অবিন্যস্ততা সবচেয়ে বেশী থাকে। আমাদের, মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীদের অভিধানে এই কথাটা নেই। আসলে, কোনও মানুষকেই এইভাবে চিহ্নিত করা উচিৎ নয়, কারোর পক্ষেই।
শরীরের যেমন রোগ হয়, মনেরও তেমনি রোগ হয়, বিভিন্ন ধরনের। একে “তুচ্ছতাচ্ছিল্য” করে অস্বীকার করা বা এদের আলাদা করে দেগে দেওয়াটাও একটা সামাজিক অসুস্থতা, এর থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার, মন কিন্তু শরীরেরই অংশ, মনের যে “ভাষ্য” তা কিন্তু আমাদের মস্তিষ্কের কিছু রাসায়নিক কার্যকলাপের দ্বারাই নির্ধারিত হয়।
যা হোক, “স্কিজোফ্রেনিয়া” রোগটি মানসিক অসুস্থতার সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং ধরন। ক্রেপলিন সাহেব যখন এই রোগের প্রথম বর্ণনা দিয়েছিলেন, তখন এই রোগের বিবরণে বলেছিলেন, “ক্রনিক ডাউনহিল কোর্সের” কথা, অর্থাৎ ক্রমনিম্নগতির কথা। পরে দেখা যায়, সব রোগীর ক্ষেত্রে এমনটা নয়। পরে ব্লয়লার সাহেব যখন “স্কিজোফ্রেনিয়া” নামকরণ করেন তখন তিনি এই “ডাউনহিল কোর্স” বিষয়ে নির্দিষ্ট সন্দেহ প্রকাশ করেন।
আরো নতুন নতুন আচরণগত সমস্যা পরবর্তী সময়ে চিহ্নিত হয়েছে, অসুস্থতার চিহ্নিতকরণের জন্য নানা লক্ষ্মণের তালিকা তৈরী হয়েছে। আধুনিক কালে, ICD/10 বা DSM/5, এই ধরনের শ্রেণীবিন্যাস পদ্ধতির মাধ্যমে চিহ্নিতকরণের কাজ আরো সহজ ও নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। তবে, আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে আরো নির্দিষ্টভাবে “স্কিজোফ্রেনিয়া”র শারীরবৃত্তীয় কারণ খোঁজার চেষ্টাও এখনও ভীষণভাবে জারি আছে।
এদের সমস্যা কি ধরনের হয়? কিভাবে বা কোন বয়সে শুরু হয়? এদের প্রতি কি ধরনের আচরণ করা উচিৎ? চিকিৎসায় এরা কতটা সাড়া দেয়? এই সমস্ত প্রশ্নের নির্দিষ্ট আলোচনা একটি লেখায় করলে “গুরুপাক” হওয়ার সম্ভাবনা আছে! বরং “কেস ডায়েরির” মত করে একটি একটি করে নির্দিষ্ট কেস ধরে ধরে সমস্যাগুলি বিভিন্ন পর্বে আলোচনা করার ইচ্ছে রইল।
আজ শুধু একটি কথাই বলা, আজকের দিনটির কথা মাথায় রেখে… সেটা হচ্ছে, এই রোগ সম্পর্কে সমস্তরকম সংস্কারের বাঁধা দূরে সরিয়ে চিকিৎসা করান। আধুনিক ওষুধের ব্যবহারে সমস্ত রোগীদের শতকরা প্রায় ৫০ শতাংশের মতো মানুষ ওষুধসহ বা কোনো ওষুধ ছাড়াই সম্পূর্ন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেন।
যারা এদের শুশ্রূষা করেন, তাদের মনে সবসময় আশার আলো রাখতে হবে, রোগীকে আশ্বস্ত রাখতে হবে, “দূর-ছাই” করে দূরে সরিয়ে রাখা যাবে না, আবার অতিরিক্ত আগলে রাখাও ঠিক হবে না। যদি সম্ভব হয়, একটু বেশী ধরনের যারা অসুস্থ, তাদের মানসিক ও সামাজিক পুনর্বাসনের (PSR) প্রক্রিয়ার মধ্যে আনতে হবে, যদিও আমাদের দেশে এই সুযোগ এখনও খুব ভালো প্রসারিত নয়, সবাইকে এই প্রক্রিয়ার মধ্যে আনা যায়নি।
শুরুটা করেছিলাম একটা “সম্ভাব্য” দুঃখের বিবরণ দিয়ে। এবারে একটা অন্যরকম গল্প বলি।
পেশায় প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক, এই মানুষটিকে নিয়ে তার বাড়ীর লোকেরা আমার কাছে এসেছিল, প্রায় ষোল-সতেরো বছর আগে। মধ্যবয়সী, চল্লিশের কোঠায় বয়স। মানুষটি প্রায় দশ বছর নিরুদ্দেশ ছিলেন। হঠাৎ করে ফিরে এসেছেন ছোট বোনের বাড়ীতে।
কথাবার্তায় যা বোঝা গেলো রাতে “ওরা” ওকে প্রচণ্ড পেটায়, অত্যাচার করে, দিনের বেলাতেও গায়ের ব্যাথা কমতেই চায় না। “ওরা” কারা, তার কোনো নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা উনি দিতে পারলেন না। যাই হোক, চিকিৎসা শুরু হল। উনি আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠতে শুরু করলেন, “ওদের” পেটানো বন্ধ হল।
তিনভাই-এর একান্নবর্তী পরিবার, উনি বড়। সবাই ওনাকে আগলে রাখে। পরে মামলা-মোকদ্দমা করে উনি চাকরীটিও ফেরৎ পেলেন। দিব্যি চাকরী করতে শুরু করলেন। বাড়ীর থেকে দূরে পোস্টিং হওয়ায় একা থাকতে হয়েছিল, এইসময় বিভিন্ন মানসিক সমস্যাগুলি আবার ফিরে এসেছিল, কিন্তু একটু নিবিড় (intensive) চিকিৎসায় সেগুলো কেটেও যায়।
পরে বাড়ীর কাছে ট্রান্সফার হয়ে এসেছেন। মাঝেমধ্যে সমস্যার ওঠানামা হয়েছে, কিন্তু নিয়মিত চিকিৎসার সুবাদে খুব বাড়াবাড়ি হওয়ার আগেই সামলে নেওয়া গেছে!!
এখন চাকরীতে অবসরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, আর “হোম-লোন” নিয়ে বাড়ী বানাচ্ছেন। ওষুধ এখনও নিয়মিত চলে, চেক-আপও, আর পরিবার সেই একান্নবর্তীই আছে, নতুন বাড়ীতে একসাথেই থাকবে সবাই। “স্কিজোফ্রেনিয়া”র ক্ষেত্রে প্রাচ্য সংস্কৃতির এই পারিবারিক বন্ধন অনেকসময় ওষুধের থেকেও বেশী কাজ দেয়।
কাল “সোনার কেল্লা” সিনেমা দেখছিলাম। গাড়ীর টায়ার ফেঁসে যাওয়ার পর ফেলুদার একটা বিখ্যাত ডায়ালগ, “আছে! আছে! আমাদের টেলিপ্যাথির জোর আছে!” তেমনি “স্কিজোফ্রেনিয়া” রোগীর সমস্ত পরিচর্যাকারীদেরও এই ভরসা রাখতে হবে, “আছে, আমাদের বিশ্বাসের জোর আছে!” অবশ্যই বিজ্ঞানভিত্তিক, যুক্তিবাদী, সংস্কার-বর্জিত বিশ্বাস, কোনো বাবাজীর “হাতুরী” মার্কা বিশ্বাস নয়।
চলুন, আমরা এই দিনটিকে আরো তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলি, এই সপ্তাহটিকেও (২৩ থেকে ২৯ শে মে) ‘স্কিজোফ্রেনিয়া সেবা সপ্তাহ’ হিসেবে।