নারীর আগে ‘শ্রমজীবী’ কথাটা বসানো,
অনেকটা নদীর আগে প্রবাহিনী,
পাহাড়ের আগে সুউচ্চ
সমুদ্রের আগে সুবিশাল বসানোর মতো।
এখন পর্যন্ত কোনো বিশ্রাম-জীবী নারী জন্মাননি।
হোমো স্যাপিয়েন্সের আদিপর্বে,
কোনো গুহামানবীর সযত্নে সঞ্চিত বীজ থেকে জন্মেছিলো পৃথিবীর প্রথম কৃষিক্ষেত,
সংগ্রহ করা শাক থেকে প্রথম সবজি বাগান।
পুরুষের সাথে শিকার করতো নারী,
সে প্রমাণ আদি মানবীর অস্থিগঠনে নথিবদ্ধ হয়ে আছে,
যা কোনো ইতিহাসে নেই,
সেই ম্যামথ আর হরিণের মাংসকে রেঁধেবেড়ে বুড়ো শিশু জোয়ান ও গর্ভবতীদের মধ্যে
বাঁটোয়ারা কে করে দিতো..
ইতিহাস জুড়ে পুরুষের কাণ্ডকারখানা দেখে মনে হয়,
প্রাক-ইতিহাসে সে কোনো আদিম রমণী হতে বাধ্য।
তারপর, ইতিহাস এলো।
মাতৃতন্ত্র গিয়ে পাঁচহাজার সালব্যাপী পুরুষ-শাসন,
নারী হলো দাসী, ভোগ্যা, অন্তঃপুরচারিণী,
শস্ত্র ও শাস্ত্র নিষিদ্ধ হলো তার।
বাল্যে পিতার, যৌবনে স্বামীর আর বার্ধক্যে পুত্রের অধীন বলা সমাজে,
নারীর বিশ্রাম ও আরাম অসম্ভব হয়ে উঠলো,
পিতা, স্বামী ও পুত্রের যাবতীয় খেয়াল রাখতে রাখতে রাখতে..
নারী ভুলেই গেলো নিজের জন্য বাঁচতে।
তার প্রসাধন পুরুষপছন্দাভিলাষী শৃঙ্গার হলো,
তার ভূমিকায় সবচেয়ে বড় জায়গা নিলো মাতৃত্ব,
যে কোনো সন্তানের মা নয়,
কেবল পুত্রের জননী হওয়া সে নিজেও ঈপ্সিত লক্ষ্য বলে মেনে নিলো।
সে ‘রত্নগর্ভা’ হলো, নিজের হীরকদ্যুতি ছেড়ে,
সে ‘ঘরের লক্ষ্মী’ হলো, দুর্গা সরস্বতীর অবতার ছেড়ে,
‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’
শুনে সে আহ্লাদিত হয়ে প্রতিপ্রশ্ন কখনো করলো না,
‘ পুরুষের গুণে নয় কেন?’
আর এই চাপিয়ে দেওয়া ভূমিকায় দাসত্বকে দেবীত্ব ভেবে নারী অক্লান্ত পরিশ্রম করে চললো
পুঁথিতে যেমন লিখেছে,
তেমন করে মেয়ে বৌ মা বনতে,
পুঁথি লেখা তো দূর, পড়াও বারণ তার কেন,
মাথার ঘাম পায়ে ফেলে চব্বিশ ঘন্টা কাজের ফাঁকে
এ প্রশ্নটা সে করার সময়ই পেলো না।
তারপর নারীর অবতাররা এলেন।
কোথাও বা পুরুষের ছদ্মবেশে, কোথাও নারী হয়েই,
এলেন রাম-ঈশ্বর-সাবিত্রীরা,
আর কি আশ্চর্য,
রাম করলেন নারীকে আগুন থেকে রক্ষার ব্যবস্থা,
ঈশ্বর বললেন নারীর শিক্ষা অ-ঈশ্বরীয় নয়,
সাবিত্রী বললেন, সতীলক্ষ্মী সংসারসেবিকা হওয়াই নারীজীবনের মোক্ষ নয়।
একটা সলতে থেকে আর এর একটা সলতে,
তারপর আর একটা ..
জ্বলতে জ্বলতে দেখো,
আজ দেশ জুড়ে দীপাবলি।
যে দিকে তাকাবে,
সার সার নারীর জীবন স্বপ্ন জ্বালানি করে
আলো দিচ্ছে।
কিন্তু পুড়তে যে শ্রম লাগে।
প্রদীপের জ্বলে থাকতে শিখতে হয়,
নেভানোর চেষ্টা করা ফুঁ-য়ের থেকে সলতে বাঁচিয়ে,
ভুরু কুঁচকানো যুগকে নিংড়ে তেল বের করে,
একা একা জ্বলা যে কি কঠিন,
নারী মাত্রেই জানে।
দীপাবলি আলোর উৎসব হলেও সেটা রাত-ই,
দুটো প্রদীপের মাঝে অন্ধকার জমাট বেঁধে থাকে,
দিনের আলো না এলে
প্রদীপের জ্বলার থেকে মুক্তি নেই,
‘শ্রমজীবী’ তকমাটা জন্ম ইস্তক তার কপালে সেঁটে আছে।
বিশ্রামজীবী কোনো নারীকে আমি অন্তত চিনি না। পৃথিবীর সব নারী শ্রম করে বাঁচে।
তেমন কারোর খোঁজ আছে নাকি তোমাদের কাছে?