বড় বড় মানুষের আক্ষেপও বড় বড়। এই যেমন উমবার্তো ইকো আক্ষেপ করেছিলেন, মানুষকে যাতে গলায় পেন্ডুলাম-ঘড়ি ঝুলিয়ে না চলতে হয়, অথবা যাতে খানিকক্ষণ বাদে বাদেই পকেট থেকে ঘড়ি বের করে সময় দেখতে না হয়, বিজ্ঞান হাতঘড়ির মতো চমৎকার একখানা আবিষ্কার করল। আবার সেই প্রযুক্তিই এমন একখানা আবিষ্কার করল, স্মার্টফোন, যাতে অন্য যেকোনও কাজ করার সময় মানুষের একখানা হাত আটকা পড়ে থাকে – আস্তে আস্তে মনুষ্যজাতি শরীরের একখানা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হাতের ব্যবহার হারিয়ে ফেলছে…
আমাদের অবশ্য অত বড় স্কেলে না ভাবলেও চলবে। পেশায় ডাক্তার যেহেতু, দুটি যন্ত্র অবশ্যসঙ্গী হওয়ার কথা। গলায় স্টেথো, এবং হাতে হাতঘড়ি। দুটির ব্যবহারই অপসৃয়মান, কিন্তু সুপ্রাচীন পেশার অনতিপূর্ব-আধুনিকতার চিহ্ন। স্মৃতিচিহ্ন। ডাক্তারবাবু গম্ভীর মুখে নাড়ি দেখছেন – ডানহাতে ধরে আছেন রোগীর কবজি, বাম হাতটি কনুই থেকে নব্বই ডিগ্রি কোণে, চোখ বাম কবজিতে বাঁধা থাকা হাতঘড়িটিতে।
ঘড়ির সঙ্গে ডাক্তারির সম্পর্ক কি শুধু ওইটুকুনিই? ব্যাপারটা অত সহজও নয়। মনে রাখুন, গ্যালিলিও কিন্তু গোড়ায় সেই ডাক্তারি পড়তেই ঢুকেছিলেন – আর ঠিক সেই ডাক্তারি-শিক্ষার সময়ই এক ঝুলন্ত ঝাড়বাতির দুলুনি দেখতে দেখতে দুলুনিকে মিলিয়ে দেখলেন নিজের নাড়ির গতির সঙ্গে – ডাক্তারি না পড়লে তাঁর মাথায় কি নাড়ি-স্পন্দনের সঙ্গে ঝাড়বাতির দোলন মেলানোর আইডিয়া আসত? মোদ্দা কথা হলো, ডাক্তারি-শিক্ষার্থীর মাথাতেই এলো পেন্ডুলামের ধারণা, যে ধারণা ঘড়ি আবিষ্কারের মূল। তাহলে বলুন, ঘড়ির সঙ্গে ডাক্তারির যোগ কি নেহাত হেলাফেলা করার ব্যাপার!
তো ডাক্তারের হাতঘড়ির বিশেষত্ব বলে যদি কিছু থাকে, সেটা হলো, এ হাতঘড়িতে সেকেন্ডের কাঁটার অনিবার্য উপস্থিতি। অন্তত তেমনটাই হওয়ার কথা। তবে ব্যাপারটা অত অনিবার্যও নয় হয়ত। কলেজের এক অগ্রজের ক্ষেত্রে যেমন। প্র্যাক্টিকাল পরীক্ষার মোক্ষম মুহূর্তে তিনি আবিষ্কার করলেন, ঘড়িখানা চলছে না, ওই সেকেন্ডের কাঁটাটি স্থির। কী করবেন। কী আবার? আগের আগের প্যারাগ্রাফে লেখা ভঙ্গিটির নিখুঁত অভিনয় করলেন, নাড়ির গতি হিসেবে একটা সংখ্যা বলে দিলেন – কেননা, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বিশ্বাসযোগ্য একটি সংখ্যা বলতে পারলে, পরীক্ষক কি আর মিলিয়ে দেখবেন?
আরও একখানা গল্প মনে পড়ে গেল। সেটা অবশ্য হাতঘড়ি নিয়ে নয়, ডাক্তারির আরেক অনিবার্য চিহ্ন, স্টেথোস্কোপ, নিয়ে। আমাদের একজন মেডিসিনের স্যার ছিলেন। একটু আপনভোলা টাইপের। রোগী এলেই পিঠে স্টেথো ঠেকিয়ে গম্ভীর ভাবে বলতেন – ‘শ্বাস’। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ শুনে আবার স্টেথো খানিক সরিয়ে বলতেন – ‘শ্বাস’। কিন্তু মুশকিল হলো, এই শোনার প্রক্রিয়ায়, মাঝেমধ্যেই, তিনি স্টেথোস্কোপের আরেক প্রান্তটি কানে লাগাতে ভুলে যেতেন। আমরা, অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা, ছাড়া এ নিয়ে ভিড়ে ঠাসা আউটডোরে কোনও পক্ষই বিশেষ বিচলিত হতেন বলে মনে পড়ে না। তবে একদিন এক স্মার্ট রোগিনী প্রশ্ন করেই বসলেন, ডাক্তারবাবু, আপনি তো শোনার যন্ত্রটা কানে লাগালেনই না, তাহলে? একটুও অপ্রস্তুত না হয়ে স্যার বললেন, বুঝলেন মা, অভিজ্ঞতার একটা লেভেলের পরে রোগ বুঝতে স্টেথো কানে লাগাতে হয় না।
কিন্তু এই স্টেথোর গল্পটা, বোধহয়, এই লেখায় তেমন প্রাসঙ্গিক নয়। তাহলে হাতঘড়ি আর ডাক্তারি পরীক্ষা নিয়েই আরেকখানা গল্প বলি। মিষ্টি গল্প। নিজের ছাত্রজীবনের গল্প। মেডিকেল পরীক্ষার সিট পড়ত কলেজ থেকে একটু দূরে। আমাদের কলেজের প্রথা ছিল, মেডিকেল জীবনের প্রথম ইউনিভার্সিটি পরীক্ষার সময় সিনিয়ররা জুনিয়রদের হল অবধি পৌঁছে দেবে। এখনকার উজ্জ্বল সময়ের তুলনায় সেসব সুদূর অতীতের দিন খুবই ম্যাড়মেড়ে। সেকালে জুনিয়রদের পরীক্ষার সময় সিনিয়র হিসেবে নিজেদের ভূমিকা বলতে আগের রাত্তিরে হস্টেলের ঘরে ঘরে গিয়ে টেনশন করিস না ইত্যাদি বলা, সম্ভব হলে একটু-আধটু পড়িয়ে দেওয়া, আর পরীক্ষার দিন হল অবধি পৌঁছে দিয়ে পাশে আছি এই ভরসাটুকু জোগানো। এখন তো শুনি, মেডিকেল শিক্ষায় ক্ষমতাবান সিনিয়রদের ভূমিকা অনেক বিস্তৃত, কিন্তু আপাতত সে প্রসঙ্গ ছেড়ে মূল গল্পে ফিরি। তো, সেদিনও গেছি পরীক্ষার হলে অনুজদের পৌঁছে দিতে। পৌঁছে দিয়ে বেরিয়ে আসছি। এমন সময় পরীক্ষার্থী ব্যাচের সবচাইতে সুন্দরী মেয়েটি আমায় আচমকা ডাকল। সুন্দরী হিসেবে মেয়েটি কিঞ্চিৎ বাড়তি নজর পেত অনেকের কাছেই – কারও কারও ‘ব্যথা’-ও ছিল তার প্রতি – সে বাবদে মেয়েটি অল্পবিস্তর উন্নাসিক ছিল বলেও সাধারণ ইম্প্রেসন। যদিও উন্নাসিকতা বলতে তখন যা ভাবতাম, তা আদতে, সম্ভবত, অন্তর্মুখী স্বভাব। যা-ই হোক, সে মেয়ে আমার মতো এলেবেলেকে ডাকছে, এ একেবারে অভাবনীয় ঘটনা। কারণটা অবশ্য নেহাতই আটপৌরে। সে ঘড়িটা হস্টেলে ফেলে এসেছে, এখন ফিরে গিয়ে নিয়ে আসার সময় নেই, আমার ঘড়িখানা পরীক্ষার সময়টুকুর জন্য ধার চায়। বেশ মনে পড়ে, সে ঘড়ি যখন ফেরত পেলাম, তখন পরের অন্তত কয়েকটা দিন সেই ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময়ের চাইতেও বেশি কিছু দেখতে চাইতাম। সবাইকে ছেড়ে আমার কাছেই চাইল কেন! নাহ্, হুট করে আমার মতো মফস্বলির প্রেমে যে সে পড়ে যেতে পারে না, সেটুকু কাণ্ডজ্ঞান আমার তখনও ছিল – কিন্তু ভাবতাম, মানে বিশ্বাস করতে চাইতাম, আমাকে দেখে হয়ত তার বেশ নির্ভরযোগ্য মনে হয়েছে, সেটাই বা কম কী!!
নাহ্, এতখানি গল্প ফেঁদে বসে শেষমেশ মনে হচ্ছে, ডাক্তারির সঙ্গে হাতঘড়ির সম্পর্ক প্রসঙ্গে এ গল্পখানাও তেমন একটা জুতসই হলো না। তাহলে একেবারে শুরুতে ফেরা যাক। অর্থাৎ সেকেন্ডের কাঁটা। দেখুন, হাতঘড়িতে সেকেন্ডের কাঁটার ব্যাপারটা কিন্তু অত সহজ নয়। মানে, শুরুর দিকে, প্রযুক্তির আদি পর্বে সেটা খুব সুলভ ছিল না। তার আগে ডাক্তারবাবুরা নাড়ির গতির আঁচ পেতেন কী করে? বা আরেকটু আগে?? সুশ্রুত-চরক-হিপোক্রেটিসদের সময়ের কথা ছেড়েই দিন, গ্যালিলিও যখন মেডিকেলে ভর্তি হলেন, তখন? কিন্তু সেসব জটিল প্রশ্ন ছেড়ে একটা বিশেষ হাতঘড়ির কথা বলি। ১৯২৮ সালের কথা৷ বিশ্ববিখ্যাত ঘড়ির কোম্পানি রোলেক্স এবং আমেরিকান কোম্পানি গ্রুয়েন একটি হাতঘড়ি বাজারে আনলেন। বিজ্ঞাপন হিসেবে জানানো হলো, ঘড়িটি বিশেষ করে ডাক্তারদেরই জন্য। রোলেক্স-এর প্রিন্স এবং গ্রুয়েন-এর টেকনি-কোয়াড্রন। একখানা কার্যকরী ও ব্যবহারযোগ্য সেকেন্ডের কাঁটা সহ ঘড়ি। পৃথিবীতে হয়ত সেই প্রথম। সুইজারল্যান্ডের ইগলার কোম্পানির তৈরি ক্যালিবার-৮৭৭ টেকনোলজি, তার ভিত্তিতেই সম্ভব হয়েছিল এই নির্ভরযোগ্য সেকেন্ডের কাঁটা। তখনও ইগলার-কে রোলেক্স পুরোপুরি কিনে নেয়নি, কাজেই দুটি বিভিন্ন ঘড়ি-নির্মাতা কোম্পানিকে প্রযুক্তি বিক্রি করতে কোনও বাধা ছিল না। রোলেক্স প্রিন্স এবং গ্রুয়েন টেকনি-কোয়াড্রন – প্রথমটি, প্রত্যাশিতভাবেই, অনেক বেশি দামি – দুটি ঘড়িতেই ব্যবহৃত হয়েছিল ক্যালিবার-৮৭৭ প্রযুক্তি। ডাক্তারদের বিশেষ প্রয়োজন মেটাতেই ইগলার এমন প্রযুক্তি খুঁজে চলেছিল বলে খবর নেই, কিন্তু দুটি ঘড়িই বিজ্ঞাপিত হয়েছিল ‘ডাক্তারদের ঘড়ি’ হিসেবে। হাতঘড়িতে তখন চৌকো ডায়ালের প্রবণতা – গোল করে ঘুরে চলা ঘড়ির কাঁটাকে মাপসই করে আঁটিয়ে ওঠা কম কিছু চ্যালেঞ্জ নয় – ইগলারের প্রযুক্তি চৌকো খোপে আঁটালো দুখানা ডায়াল, একটি ঘণ্টা ও মিনিটের, আরেকটি সেকেন্ডের। ডাক্তারদের ঘড়ি – এ সেই সময়ের গল্প, যখন সমাজে ডাক্তারবাবুদের বিশেষ সম্মানের চোখে দেখা হতো। আবার এ এক এমন সময়েরও গল্প, যখন হাতঘড়ির বিজ্ঞাপনে, আনুষঙ্গিক বিবিধপ্রকার ‘সুযোগসুবিধে’ নয়, ঘড়ি হিসেবে তার কার্যকারিতাই মুখ্য বিচার্য হতো।
সময় বদলে গিয়েছে। রোলেক্স প্রিন্স-এর এক তৃতীয়াংশ দামে ঘড়ি বিক্রি করেও গ্রুয়েন কোম্পানি ব্যবসা গুটিয়েছে। সেদিনকার ইগলার কোম্পানি এখন রোলেক্স-এর অংশমাত্র। হাতঘড়ির মডেল হিসেবে রোলেক্স প্রিন্স বারবার ফিরে ফিরে এসেছে – শেষ এই ২০১৫ সালেও – তবে এখন আর সে ঘড়িকে ডাক্তারদের ঘড়ি হিসেবে বিজ্ঞাপিত করা হয় না। আসলে, ওই যে, সময়টাই বদলে গিয়েছে।
তলিয়ে ভাবতে গিয়ে বুঝি, হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে নাড়ির স্পন্দন বুঝতে চাওয়াটা তো উপলক্ষ মাত্র। আদতে সময়টাকেই বুঝতে চাওয়া। মানুষ হয়ে মানুষকে ছুঁয়ে থাকতে পারা, চিকিৎসক হয়ে রোগীর উৎকণ্ঠা ছুঁতে পারা, সেও কি কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ? এই মুহূর্তটিতে দাঁড়িয়ে সামনের মানুষটার বর্তমান শারীরিক পরিস্থিতি এবং অনতিদূর সময়ে তাঁর শারীরিক অবস্থা কেমন দাঁড়াতে পারে, বুঝতে চাওয়া একইসঙ্গে দুইই। নতুন প্রযুক্তি এসে হাতের আঙুল দিয়ে নাড়ি-স্পন্দন দেখার প্রয়োজনীয়তা কমিয়েছে, আর মানবিক স্পর্শ, সে তো এ পেশা থেকে ক্রমশই হারিয়ে যাচ্ছে। নাড়িস্পন্দন দেখতে দেখতে ডাক্তারবাবুর মনেও তো উৎকণ্ঠা জাগতে থাকে – অবিশ্বাস, মামলা-মোকদ্দমা, ভাঙচুর ইত্যাদি প্রভৃতি। আর টেবিলের উল্টোপারে বসে থাকা অসুস্থ মানুষটির মনে… নাহ্ থাক। আসলে, ছুঁয়ে থাকা, ওই ডাক্তারির হাতঘড়ির মতোই, যেন এক হারিয়ে যাওয়া সময়ের স্মৃতিচিহ্ন মাত্র। এক বিখ্যাত কবির ততোধিক বিখ্যাত লাইনকে একটু বদলে নিয়ে বলা যায় – সময় দেখা, বস্তুত অভ্যাশবশত…