চুম্বক
বিখ্যাত সাহিত্যিক ঋচিক মহেশ্বরের মৃত্যুর পরে তাঁর ছেলে ঋতবাক বাবার ব্যক্তিগত কাগজপত্রের মধ্যে প্রমাণ পেলেন যে সাহিত্যিক নিজের লেখা ছাপতেন না, ছাপতেন এক অনামা লেখকের লেখা – নিজের নাম দিয়ে। অমিত মুখোপাধ্যায় নামে এই লেখকের সঙ্গে ঋতবাক দেখা করবেন স্থির করলেন।
~সাত~
সকাল সকাল বেরিয়েও তিনটে বাস বদলে মাতোড় পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এল। আসতে আসতে মনে হচ্ছিল ফিরতে অসুবিধে হবে, দু’একবার ভেবেছিলেন ফিরে যাবেন, কিন্তু কী একটা অদম্য ইচ্ছার টানে চলতেই থেকেছেন। ফেরেননি।
দুপুরের ঝলসানো রোদ পড়ে এসেছে, বাস স্টপের চায়ের দোকানে অমিত মুখোপাধ্যায়ের নাম বলে পকেট থেকে কাগজটা বের করতে হলো না, তিন-চারজন একসঙ্গে বললেন, “মাস্টার মশায়ের বাড়ি যাবেন? ওই তো, সোজা রাস্তায় যান, বড়োপুকুর পার করে ডাইনে গিয়ে বাম দিকে গেলেই শীতলা মন্দির, তার দুটো বাড়ি পরেই। সবাই চেনে, দেখিয়ে দেবে। অ্যাই হারান, হারান রে, যা না, স্যারকে মাস্টারমশায়ের বাড়ি নিয়ে যা… লক্ষ্মী ছেলে।”
সাইকেল ঠেলতে ঠেলতে ঋতবাকের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে হারান জানতে চাইল, “আপনি কোত্থেকে এসেছেন? কী করেন? মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে কাজ আছে?” তারপরে বড়োপুকুরের ধার থেকেই আঙুল তুলে দেখাল, “ওই, শেতলা মন্দিরের পরেই বাড়ি — জবা গাছ দেখা যাচ্ছে।” তারপরে বলল, “আমার স্কুলের মাঠে ফুটবল ম্যাচ…”
ঋতবাক বললেন, “রওয়ানা দাও, নইলে দেরি হয়ে যাবে।”
ছেলেটাকে দু’বার বলতে হলো না। তড়াক করে সাইকেলে উঠে উধাও হয়ে গেল যে দিক থেকে এসেছিল সেদিকেই।
উঠোন থেকে কমবয়সী একজন মহিলা বিকেলের রোদ থেকে কুলোয় করে রাখা বড়ি তুলে নিয়ে যাচ্ছিলেন, ঋতবাককে দেখে ঘোমটা টানলেন। প্রশ্নের উত্তরে ঘাড় কাত করলেন — এটাই অমিত মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি বটে। তারপরে অতি অস্ফূটে বললেন, “আসুন…” প্রায় শোনা-ই গেল না। বাখারির গেট খুলে ঢুকলেন ঋতবাক। ছোট্ট বাগান, তাতে ফুলগাছেরই ভীড় বেশি। মহিলা বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেছেন। ঋতবাক কী করবেন বুঝতে না পেরে বাইরেই দাঁড়িয়েছিলেন। আবার বেরিয়ে এসে বললেন, “আসুন।”
বাড়ির ভেতরটা অন্ধকার। ঋতবাক ঢুকতে ঢুকতে কেউ আলো জ্বালিয়ে দিল। ছোটো ঘর। একটা টেবিল, একটা খাট — টেবিলে একজন বসে রয়েছেন, বাইরের দরজার দিকে তাকিয়ে। টেবিলের পাশে দুটো কাঠের ক্রাচ-ও নজরে পড়ল।
“কে?” ভদ্রলোকের গলায় অস্বস্তি। দেখে মনে হয় বয়স ঋতবাকের চেয়ে অন্তত বছর দশেক বা পনেরো বেশি। ঋতবাক নিজের নাম বললেন। “আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।”
বুঝলেন, আর কিছু বলতে হবে না। উনি বুঝেছেন। ভেতরের দরজায় একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা, বাইরের দরজায় যিনি ঋতবাককে ডেকেছেন। অমিত, উনিই অমিত, বললেন, “আমার স্ত্রী, সবিতা। আর ও — ” বলে বাইরের দরজায় যুবতীকে দেখালেন, “আমার ছেলের বউ।” তারপর বললেন, “তোমরা ভেতরে যাও। আমাদের কিছু কাজের কথা আছে। আপনাকে অনেকটা রাস্তা আসতে হয়েছে। খেয়েছেন?” শেষটা আবার ঋতবাককে উদ্দেশ্য করে।
ঋতবাক নিশ্চিন্ত করলেন। “খেয়েছি। আপনারা ব্যস্ত হবেন না।”
“চা চলবে? তবে আপনাদের মতো চা তো এখানে… গ্রামদেশের চা খান…” এবারে আর কিছু বলতে হলো না, দুজনই বেরিয়ে গেলেন, বাড়ির ভেতর দিকে।
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। অমিত মুখোপাধ্যায়ই প্রথম কথা বললেন। “আপনার বাবা কিন্তু আমার বাড়িতে চা খেতেন না। বলতেন, এই চা আমার চলবে না।”
বাবা নাক-উঁচু ছিলেন। ঋতবাক যেখানে খুশি চা খেতেন বলে বাড়িতে পেছনে লাগতেন। “আমার ছেলে হয়ে ফুটপাথের চায়ের দোকানে চা খাস? এ-সব কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ফল।”
ঋতবাকও ছাড়তেন না। বলতেন, “তুমি যাদবপুর বলে নাক উঁচু হয়েছ। আমি সব এনজয় করতে পারি…”
তখন এ কথাগুলোর মধ্যে মজা ছিল। এখন কেমন ঘেন্না হলো। এই লোকটার লেখা চুরি করে বাবা কাহিনিভাস্কর হয়েছে। এর বাড়ির চা-ও খেত না?
“অবশ্য ডাল-ভাত তৃপ্তি করে খেতেন… মানে খেয়েছিলেন…”
ও।
“বাবা প্রায়ই আসতেন?”
এতক্ষণে ঘরের আলো-আঁধারিতে চোখ সয়ে গেছে ঋতবাকের। অমিত মুখোপাধ্যায়কে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন। না কামানো দাড়ি, অবিন্যস্ত একমাথা কাঁচাপাকা চুল, আর চেয়ারের ওপরে হাঁটুর ওপরেই শেষ হওয়া একটা পা। মাথা নাড়লেন অমিত। “সবসুদ্ধ পাঁচ-ছ’বার এসেছিলেন। সে অনেক বছর আগের কথা… তারপরে তো দরকার হত না…”
“কী করে যোগাযোগ হয়েছিল?” ঔৎসুক্য আর চাপতে পারলেন না ঋতবাক। “কী ভাবে আপনার লেখা বাবার নামে…” ঋতবাক বাক্যটা শেষ করতে পারলেন না।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন অমিত মুখোপাধ্যায়। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, “আপনি এখানে এসেছেন, মানেই লেখাগুলোর বিষয়ে এ তো স্বাভাবিক। কিন্তু আমি ভাবিনি আপনি সে সম্বন্ধে কিছু জানেন। আমার সঙ্গে ঋচিকবাবুর যা কথা হয়েছিল…”
আবার থামলেন অমিত। ঋতবাক একদৃষ্টে তাকিয়ে। অমিত মুখোপাধ্যায় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার শুরু করলেন, “আমি ওঁর লেখার অন্ধ ভক্ত ছিলাম। প্রথমদিকে তো বড়ো ম্যাগাজিনে লেখা দিতেন না… নানা লিটিল ম্যাগাজিনে বেরোত। আমি তখন থেকেই যে ভাবে হোক ওঁর লেখা জোগাড় করে পড়তাম। পরের দিকে ঋচিকবাবু আস্তে আস্তে পরিচিত ম্যাগাজিনেও লেখা দিতে শুরু করলেন, জোগাড় করা সহজ হয়ে এল। লেখার অভ্যেস আমারও ছোটো থেকেই। তার একটা দুটো ছোটো ম্যাগাজিনে বেরিয়েছিল। কিন্তু কারও চোখে পড়েনি কখনও। একদিন কী মনে হলো, একটা লেখা দিলাম পাঠিয়ে। অনুরোধ করেছিলাম, যে যদি উনি সম্যক মনে করেন, যেন কোনও যোগ্য পত্রিকায় লেখাটা পাঠিয়ে দেন।”
“বাবা কোনও লেখা পড়তেন না…” বলতে চেয়েছিলেন, প্রায় কৈফিয়ত চাওয়ার মতো করে — যে মানুষটা কারও লেখা পড়তেন না, তিনি কেন হঠাৎ অমিত মুখোপাধ্যায়ের লেখা-ই পড়তে গেলেন? কিন্তু, শেষ মুহূর্তে কথাটা মুখ দিয়ে বেরোল না। থতিয়ে গেলেন।
অমিত মুখোপাধ্যায় মাথা নাড়লেন। বললেন, “সে পরেকার কথা। আমি যখন পাঠিয়েছিলাম, তখন পড়তেন। আমার লেখাও পড়েছিলেন। উত্তর দিয়েছিলেন। খুব যত্ন করে লেখা চিঠি। রাখা ছিল আমার কাছে বহু বছর… তারপরে সেই যে বন্যা হলো… সবই ভেসে গেছিল তখন।”
শরীরটাকে ঘুরিয়ে দেওয়ালের ওপরের দিকে প্রায় ছাদের কাছে একটা তাক দেখালেন। বললেন, “দামি কাগজপত্র সব ওইখানে রাখি, তবে বন্যা হলে কি আর ওতে বাঁচে, বাঁচে না।”
বাইরের আলো কমে এসেছে আরও। ঘরের আলোর উজ্জ্বলতা বেড়েছে বোধহয়। আজকালকার এল-ই-ডি বাতিতে এটা হয়, কিছুক্ষণ জ্বলার পরে আলোর রোশনাই বাড়ে। ঋতবাক জানতে চাইলেন, “কী লিখেছিলেন?”
অমিত মুখোপাধ্যায় বললেন, “খুব ভালো চিঠি লিখেছিলেন। বলেছিলেন, আমার লেখার প্রশংসার ভাষা নেই ওঁর কাছে। প্লট, কাহিনির বিন্যাস — সবই সুন্দর, তবে আজকালকার পত্রিকায় ঠাঁই পেতে গেলে বদলাতে হবে ভাষা। বলে দিয়েছিলেন, কী কী করতে হবে। তারপরে আমার পাণ্ডুলিপিতেই কিছু কিছু জায়গায় লিখে দিয়েছিলেন। আমি ওঁর নির্দেশমত আবার লিখেছিলাম। উনি সেটাও সম্পূর্ণ পছন্দ করেননি। তবু পাঠিয়েছিলেন কয়েকজনকে। পরে জানিয়েছিলেন, সম্পাদকেরা কেউই সেটা চাননি। তখন উনি প্রথম এসেছিলেন এখানে। প্রায় হাতে ধরে আমাকে দিয়ে লিখিয়েছিলেন। আমি বলেছিলাম, আমার লেখা ছাপা হবে না। উনি বলেছিলেন, হবে। আমি বলেছিলাম, এ লেখা যদি উনি লিখতেন, তাহলে শুধু লেখনশৈলীর জোরেই ছাপা হত। তখন একটা অদ্ভুত কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, উনি আজকাল লিখতে পারছেন না। গল্পের প্লট পাচ্ছেন না মাথায়। যা আসে সবই দুর্বল, তাই সেগুলি সম্পাদকদের দেন না। বহু মাস হয়ে গেছে, উনি লেখেননি কিছুই। এতবড়ো একজন লেখকের মুখে এরকম হাহাকারের সুর শুনে আমি বলেছিলাম, ‘ও গল্পটা আপনিই লিখে দেন না, সম্পাদককে? আমার লেখার মান এত ভালো নয়, যে ছাপার যোগ্য। আপনি অবশ্যই ওটা লিখলে ছাপবেন তাঁরা।’
“প্রথমে হেসেছিলেন। তারপরে আমি খুব জোর দিয়ে বলাতে কী ভেবে বলেছিলেন, ‘বেশ। লিখব। কিন্তু আপনার চেয়ে ভালো হবে বলে মনে হয় না।’”
এত সহজে? এত সহজে ব্যাপারটা হয়েছিল? কোথাকার এক অপরিচিত অ-লেখকের কেবল মুখের কথায় ঋচিক মহেশ্বরের মতো একজন লেখক চুরি করতে রাজি হয়ে গেলেন?
অমিত বলে চলেছেন, “হাতে পায়ে ধরতে বাকি রেখেছিলাম… বলেছিলাম, ‘আপনি কোনও দিন আমার কাছ থেকে কোনও অভিযোগ শুনবেন না। তবু আপনার হাত দিয়ে যদি আমার চিন্তা অমরত্ব পায়, তা-ই আমি পরম প্রাপ্তি মনে করব…”
“তারপর?”
“বলেছিলেন, বেশ, যদি এ লেখা ছেপে বেরোয়, তাহলে এর পারিশ্রমিক আপনাকে নিতে হবে।”
বাঃ, সুন্দর ব্যবস্থা। ঋতবাক জানতে চাইলেন, “দিয়েছিলেন?”
ঘাড় নাড়লেন অমিত। “দিয়েছিলেন। দুশো টাকা। লিখে পাঠিয়েছিলেন, পারিশ্রমিকের অর্ধেক মূল্য। পরবর্তীতেও তা-ই করেছেন। যখন যা লেখা বেরিয়েছিল, তা থেকে যা পেয়েছিলেন, তার অর্ধেক আমাকে দিতেন — বই থেকেও।”
যে কেউ বলবে, অমিত মুখোপাধ্যায়ের প্রাপ্যের অর্ধেক ঋচিক মহেশ্বর চুরি করেছিলেন। ঋতবাকও। জানতে চাইলেন, “কিন্তু সে লেখা, বা সে বই যদি আপনার নামে বেরোত, তাহলে তো তার সব উপার্জনই আপনারই হত?”
মাথা নাড়লেন অমিত। কী বলতে যাবেন, ভেতরের দরজা ঠেলে ঘরে এলেন অমিতর স্ত্রী এবং বৌমা। সবিতা বললেন, “একটু চা খেয়ে নিন।”
চায়ের কাপ হাতে নিলেন ঋতবাক। পাশে কাঠের টুল রেখে তাতে একবাটি মুড়ি রেখে সবিতা বললেন, “মুড়ি নারকোল। অল্পই দিলাম। রাতের খাবার খেতে পারবেন না নইলে…”
আঁতকে উঠলেন ঋতবাক। “রাতের খাবার? না না…”
অমিত বললেন, “কেন নয়? এখান থেকে আজ রাতে আপনি তো শহরে ফিরতে পারবেন না…”
প্রশ্নটা ঋতবাক করতেনই — সুযোগ পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কিন্তু চন্দ্রকোণা টাউনে তো রাতেও যেতে পারব। আমি আজ ওখানেই থাকব রাতে। ওখানে হোটেল আছে, খোঁজ নিয়ে এসেছি।”
মুখোপাধ্যায় দম্পতির সনির্বন্ধ অনুরোধ ঠেলে আজ কোনওভাবেই রাতে থাকবেন না, স্থির করতে পাক্কা পনেরো মিনিট লাগল। ছেলের বউকে অমিত বললেন, “মা আমার, ওই তাক থেকে আমার বইয়ের একটা কপি পেড়ে দিবি রে?” উত্তরে তিনি কিছু না বলে খাটে উঠে হাত বাড়িয়ে একটা বই বের করে অমিতর হাতে দিলেন। টেবিল থেকে কলম তুলে তাতে খসখস করে কিছু লিখে ঋতবাকের হাতে দিলেন বইটা। বললেন, “আপনাকে দিলাম। আপনার বাবাকেও দিয়েছিলাম, কিন্তু সে আর এতদিন পরে হয়ত নেই।”
বইয়ের নাম ‘পাণ্ডুলিপি ও অন্যান্য গল্প’। লেখক অমিত মুখোপাধ্যায়। ভেতরের ছিয়ানব্বই পাতায় সবসুদ্ধ ছ’টি গল্প। সস্তা কাগজ, বিশ্রী ছাপা। অমিত বলে চললেন, “এই বইটা আমার একমাত্র ছাপা বই। পড়ে দেখবেন। আমাদের ইস্কুলের একবার কিছু অর্থাগম হয় — এক প্রবাসী বাসিন্দা গ্রামের স্কুলে বেশ কিছু অনুদান দেন, লাইব্রেরির জন্য। হেডস্যারের অনুরোধে গ্রামবাসী হিসেবে লাইব্রেরি কমিটির সদস্য হয়েছিলাম। লাইব্রেরির প্রয়োজনেই এই পাবলিশারের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি বই কেনা হয়। আমার সিলেক্ট করা বইয়ের তালিকা দেখে মালিক আমাকে বইয়ের দামের ৩০% দিতে চেয়েছিলেন। আমি বলেছিলাম, সমমূল্যের বই যেন তিনি লাইব্রেরিকে দেন। উনি বলেন, আমার জন্য কিছু করে দিতে চান। তখন লজ্জার মাথা খেয়ে জানতে চেয়েছিলাম, আমি খরচাপাতি দিতে পারব না, আমার ছোটোগল্পের একটা বই কি উনি প্রকাশ করবেন? এ-ই সেই বই। তিনশো কপি ছাপা হয়েছিল। পাবলিশারের কাছ থেকে কিছুই পাইনি। পঁচিশটা বই দেবার কথা ছিল, তা-ও দেননি। বা, বলা ভালো, দেননি আপনার বাবা আমার হয়ে পাবলিশারের অফিসে হানা দেওয়া অবধি। এরও এক বছর পরে ঋচিকবাবুই খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন প্রায় দুশো কপি বই প্রকাশকের দপ্তরে পোকার খাদ্য হচ্ছে, এবং উনিই সবকটা কিনে আমাকে দেন। ঋতবাকবাবু, আপামর বাঙালি লেখকের এ-ই ভবিতব্য। ক’জনের লেখনিতে এমন জোর আছে, যে তিনি ঋচিক মহেশ্বর হতে পারেন?”
নামেই ভদ্রলোক এমন অভিভূত, যে আর কিছুই ভাবতে পারছেন না। ঋতবাক বললেন, “আপনার প্রথম দিকের লেখা পড়লে সে কথা মনে হতে পারে, অমিতবাবু। তখন বাবা আপনার লেখা অনেকটাই নিজের মতো করে সাজাতেন, প্লটে পরিবর্তন করতেন — মূল ধারাটা একই রেখে বদল করতেন অনেকটাই, বিশেষত ভাষা। কিন্তু গত বেশ কয়েক বছরে আপনার লেখা পাণ্ডুলিপি আর বাবার নামে প্রকাশিত লেখার মধ্যে ফারাক প্রায় নেই বললেই চলে…”
এবারেও বাক্যটা শেষ করতে পারলেন না ঋতবাক।
অমিত মুখোপাধ্যায় কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। তারপরে বললেন, “আপনি সিনেমা দেখেন, ঋতবাকবাবু?”
কেন? দেখেন তো বটেই, কিন্তু হঠাৎ এ কথা কেন?
“উত্তমকুমারের ছবিতে হেমন্ত মুখার্জির গান শুনেছেন? দুজনের গলা কেমন এক? মনেই হয় না অন্যের গাওয়া গানে উত্তমকুমার লিপ দিয়েছেন, তাই না? আবার অনেক জায়গায় এমনও হয়েছে, যে গানের মাঝে উত্তমকুমারের সংলাপ থাকার কথা — হেমন্ত সে-ও বলে দিয়েছেন। কোনও এক ইন্টারভিউয়ে হেমন্ত বলেওছিলেন। যত দিন গেছে তত দুজনের কণ্ঠস্বর যেন আরও একরকম হয়ে উঠেছে…”
কীসের উত্তরে কী কথা! ভদ্রলোকের কি মাথা খারাপ? গান গাইতে গাইতে সংলাপ বলা, আর নিজের লেখা অন্যের নামে ছাপানো, বা অন্যকে চুরি করতে দেওয়া এক হলো?
তা-ও ছাড়লেন না ঋতবাক। বললেন, “পরের দিকে যখন আপনার লেখা আমার বাবাকে পরিবর্তনও করতে হত না নিজের বলে চালাতে — তখনও কি আপনার লেখা নিজের জোরে ছেপে বেরোত না, অমিতবাবু?”
অমিত মুখোপাধ্যায় চুপ করে মাটির দিকে চেয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপরে বললেন, “বেরোত না, ঋতবাকবাবু। আপনার বাবা নিজেই সে চেষ্টা করেছেন বিভিন্ন সময়ে। শেষবার হয়ত এই বছর চার-পাঁচেক আগে। বহু সম্পাদক লেখা ফেরত দিয়েছেন। একজন তো বলেইছিলেন, ‘এ লেখা আপনার হলে আমি এখনই ছাপতাম, কিন্তু নতুন লেখকের লেখা ছাপব না।’ সে লেখা-ই নিজের নামে পাঠিয়ে অন্য ম্যাগাজিনে ছেপেছেন উনি। পরে সেই সম্পাদক ফোন করে বলেছিলেন, ‘আপনি অন্যের নামে লেখা পাঠিয়ে আমার পরীক্ষা নিচ্ছিলেন?’ শান্ত করতে ওঁকে ঋচিকবাবু আবার অন্য লেখা দেন।”
“টাকা পাঠাতেন নিয়মিত…” ঋতবাকের কোনও বাক্যই কি আজ সম্পূর্ণ হবে না?
উৎসাহভরে অমিতবাবু বললেন, “অবশ্যই। বলতেন সবসময় ৫০-৫০। অতি সজ্জন ব্যক্তি ছিলেন। পরের দিকে বলতেন, প্রকাশক যত দেবার কথা তত দিচ্ছে না বলে উনিও আমার সঠিক পারিশ্রমিক দিতে পারছেন না। ম্যাগাজিনে ছাপালে আর কতটুকু? বই হয়ে বেরোলেই তার রয়্যালটি কিছু নিয়মিত রোজগারের বন্দোবস্ত করে দেয়। সেটা হত না।”
দারিদ্রে মোড়া ঘরটার চারিদিকে চেয়ে দেখলেন ঋতবাক। সংসার কত বড়ো? উপরি রোজগারের ওপর কতটা নির্ভরশীল ছিলেন? বললেন, “কিছু মনে করবেন না, বাবার মৃত্যুতে আপনার কি খুব আর্থিক অনটন হবে?”
এতক্ষণ চুপ করে রইলেন অমিত মুখোপাধ্যায়, যে ঋতবাক ভাবতে শুরু করেছিলেন যে এবারে উনি ভদ্রলোককে রাগিয়েই দিয়েছেন। কিন্তু যখন উত্তর দিলেন, তখন একই রকম ভঙ্গিতে বললেন, “কী আর বলি — খুবই হবে। সত্যি বলতে কী, ওই রোজগারটাই আমার প্রধান রোজগার…”
অবাক হয়ে ঋতবাক বললেন, “আপনাকে সবাই মাস্টারমশাই বলে — আপনি কি এখানে স্কুলশিক্ষক নন? সরকারি স্কুলশিক্ষক কত মাইনে পান আমি জানি না। মাপ করবেন…”
আবার মাথা নাড়লেন অমিত মুখোপাধ্যায়। বললেন, “আমি স্কুলশিক্ষকতা করি না বহু বছর। এ গ্রামের স্কুলে তো নয়ই। এখান থেকে পনেরো কিলোমিটার দূরে একটা স্কুলে আমার অ্যাড-হক পোস্টিং হয় জীবনের শুরুতে। কয়েক বছর পড়িয়েছিলাম, পার্মানেন্ট হইনি। তার আগেই একদিন সাইকেলে স্কুলে যাবার পথে অ্যাক্সিডেন্ট হয়।” নিজের পায়ের দিকে দেখালেন অমিত। “বাস। তারপর থেকে তো অতদূরে সাইকেল করে যাবার উপায় ছিল না। আর সে ছাড়া যাতায়াতের আর কোনও উপায়ও ছিল না। অনেক তদ্বির করেও এখানকার স্কুলে স্থান হয়নি। গৃহশিক্ষকতা করেছি কিছুদিন। এসব ব্যাকওয়ার্ড গ্রামে পড়াশোনার প্রচলন বেশি ছিল না। তবু কিছু ছাত্র হত, কিন্তু পরের দিকে এবং এদান্তি স্কুলশিক্ষকরাই গৃহশিক্ষকতা করেন। ফলে সে-ও বন্ধ হয়ে গেছিল। ছেলেটারও পড়াশোনা হয়নি অর্থাভাবে। গ্রামে একটা মুদি দোকান চালায়। সেই দিয়েই চলতে হবে এখন।”
বাইরে সূর্যের আলো অনেকটাই ম্লান। এবার উঠতে হবে। অপরিচিত গ্রামদেশে রাতের অন্ধকারে পথ চলতে চান না। বিদায় নিতে হবে। কিন্তু বিদায়ের কথা কি এখনই বলবেন, না কি আরও কিছু বলার আছে ঋতবাকের?
হঠাৎ অমিত মুখোপাধ্যায় বললেন, “আপনাকে একটা প্রশ্ন করি আমি?”
ঋতবাক চমকে বললেন, “অবশ্যই। আমিই প্রশ্ন করেছি। আপনি কিছুই জানতে চাননি।”
অমিত বললেন, “আপনি কী জানতে এসেছিলেন? কোনও কাজ ছিল কি?”
ঋতবাকের হঠাৎ খেয়াল হলো, কেন এসেছেন, তা-ই তিনি জানেন না। কাজ? কাজ তো ছিল না, শুধু একটা রহস্যের শেষ দেখতে এসেছিলেন। কিন্তু শেষ হয়েছে কি? তা-ও জানেন না। তাই শেষ করতেও পারছেন না। নিজের অভিজ্ঞতার কথা বললেন। কী ভাবে, বাবার কাগজপত্রের মধ্যে ব্যাঙ্কের লকারের চাবি পেয়েছেন, আর তার ভেতরে অমিতবাবুর লেখা। এবারে আঁতকে ওঠার পালা অমিতবাবুর। “বলেন কী! উনি আমাকে বলতেন লেখা সম্পাদককে পাঠিয়ে দিয়েই আমার লেখা উনি নষ্ট করে ফেলতেন। যাতে কারও হাতে কখনও না পড়ে।”
হাসলেন ঋতবাক। বাবা পারতে জীবনে কোনও কাগজ নষ্ট করেননি, বা ফেলেননি। পঞ্চাশ বছরের পুরোনো ব্যাঙ্কের কাগজ, ইনকাম ট্যাক্সের রিটার্ন — সবই বাবার কাগজপত্রের মধ্যে সযত্নে সঞ্চিত পাওয়া গেছে।
“না না!” অমিতর কণ্ঠে অনুনয়। “এ কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না। ঋতবাকবাবু, আপনি আমাকে কথা দিন — ও লেখাগুলো আপনি একটাও রাখবেন না। সব নষ্ট করে দেবেন। পুড়িয়ে ফেলবেন।”
“বা, আপনাকে দিয়ে দেব?”
“আমি!” এবারেও অমিত মুখোপাধ্যায়ের অবাক হওয়া দেখার মতো। “আমি ও নিয়ে কী করব? আমি নিজেই তো সেগুলো নষ্ট করেছি। আমার কাছে কোনও লেখার কপি নেই। কে জানে, কোথায় কে দেখে ফেলবে, আর তারপরে পাঁচকান করবে! ভাবুন তো অত বড়ো একটা ব্যক্তিত্বের কী অপমানই না হবে তাহলে! না, আমি নেব না। আপনিই নষ্ট করবেন। কথা দিন।”
ঋতবাক বললেন, “তাহলে বলছেন, আপনার বাড়ির কেউ এ ঘটনা জানে না?”
মাথা নাড়লেন অমিত। “এমন কী সবিতাও না। দোহাই আপনার, কথা দিন।”
“বেশ,” রাজি হলেন ঋতবাক। “ফিরে গিয়ে আমি সবই নষ্ট করে ফেলব। কথা দিলাম। আজ আমি উঠি। আপনার অনেক সময় নষ্ট করে দিলাম।”
বিগলিত হাসলেন অমিত। বললেন, “কী যে বলেন, আপনি এসেছেন কষ্ট করে আমার বাড়িতে, এখন আবার এই ভর সন্ধেবেলা বেরিয়ে যাবেন… সত্যিই যেতে হবে? অবশ্য থাকতেই বা বলি কী করে, গরিবের বাড়িতে সত্যিই আপনার থাকার খুব অসুবিধে হবে।”
ঋতবাক বরাভয় দেবার সুরে বললেন, “না না, সে জন্য না। আসলে চন্দ্রকোণায় আমাকে যেতেই হত, তাই…”
চেয়ার ছেড়ে উঠলেন ঋতবাক। বিদায়ের শেষ কথাগুলো বলতে যাবেন, অমিত মুখোপাধ্যায় বললেন, “এলেন যখন, এত কথা হলো… সাহস করে একটা কথা বলি?”
ঋতবাক থমকে দাঁড়ালেন। আসার আগে বহুবার মনে হয়েছে, এই যাত্রাটা উচিত হচ্ছে না, এ থেকে ভালো কিছু হতে পারে না। নিঃসন্দেহে, যিনি নিজের লেখা অন্যকে দিয়ে দেন, এবং বছরের পর বছর শুধু কিছু টাকা পেয়েই সন্তুষ্ট থাকেন, তিনি আজ সুযোগ পেয়ে আরও কিছু দাবি করবেন…
অমিত মুখোপাধ্যায় ততক্ষণে টেবিল থেকে কী একটা তুলে নিয়েছেন। বিস্মিত ঋতবাক দেখলেন, একটা ব্রাউন পেপারের খাম। অতি পরিচিত খামের সিরিজের একটি। কী দিচ্ছেন অমিত ঋতবাককে?
কিন্তু কিন্তু করে অমিত বললেন, “আপনি এসেছেন বলেই কথাটা বলছি। আমি তো ভেবেছিলাম, আর সুযোগই হবে না। কিন্তু এখন যেহেতু বুঝলাম আপনি সবটাই জানেন, তাই সাহস করে বলছি। এটা আমার লেটেস্ট গল্প। ছোটোগল্প। সাত পাতার। ঋচিকবাবু চেয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘নির্ণায়ন’-এর সম্পাদকের সঙ্গে কথা হয়ে আছে। হুতাশন দেবনাথ… চেনেন আপনি?”
চেনেন ঋতবাক। বস্তুত এই হুতাশনই ঋতবাকের পেছনে লেগে আছেন, অসম্পূর্ণ লেখা পিতা-পুত্রের দ্বৈত প্রচেষ্টায় প্রকাশ করার জন্য।
এক পা দিয়ে চাকা লাগানো চেয়ারটা ঠেলে অমিত ঋতবাকের কাছে এসে গেছেন। হাতে ঠেলে দিচ্ছেন লেফাফাটা। বলছেন, “লেখাটা যেদিন ডাকে দেব, সেদিনই সকালে আমাকে ফোন করেছিলেন। বললেন, হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে আমাকে জানাবেন। তিন সপ্তাহ পরে টিভিতে দেখলাম উনি আর নেই…” নির্বাক কান্নায় গলা ধরে এল অমিতবাবুর। কোনও রকমে নিজেকে সামলে বললেন, “এ গল্প আমার কোথাও দেবার নেই। আপনি যদি ‘নির্ণায়ন’-কে দেন, আপনার বাবার শেষ লেখা খুঁজে পেয়েছেন বলে, ওরা অবশ্যই ছেপে দেবে। আপনার চিন্তা নেই — এ জন্য আমাকে কোনও পয়সাকড়ি দিতে হবে না।”
~আট~
কেন যে মুখবন্ধ খামটা নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলেন ঋতবাক জানেন না। রাত আটটা বেজে গেছিল চন্দ্রকোণা পৌঁছতে। বাস স্ট্যান্ডে জিজ্ঞেস করে রিকশওয়ালার সঙ্গে তিনটে হোটেল ঘুরে চার নম্বরে ঘর পেতে পেতে নটা পেরিয়ে গেছিল ঘড়ির কাঁটা। রাতে খেয়ে এসে হোটেলের খাটে শুয়ে ঋতবাক খামটা খুলেছিলেন।
গল্পটা পড়া শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ। মনের কোনে একটা দুঃখ আর একটা নিশ্চিন্তবোধ একই সঙ্গে খেলা করছে। এমন একটা গল্প যদি বাবার নামে ‘শেষ কাহিনি’ বলে প্রকাশিত হয়, তাহলে সাহিত্যজগতে আলোড়ন উঠবে সন্দেহ নেই। সেটা-ই দুঃখ। এ গল্পটা বাবা নিজের নামে বের করে যেতে পারলেন না। আর সেইসঙ্গে নিশ্চিন্ত এইজন্য, যে চুরির তালিকায় অন্তত এই গল্পটাও নেই।
এখন রাত এগারোটা বাইশ। শহরের প্রকাশনা দপ্তর এখনও খোলা। হুতাশন দেবনাথ তো বলেন এগারোটা সবে সন্ধের শুরু।
অনেক ভেবেছেন ঋতবাক। উচিত আর অনুচিত, সততা আর শাঠ্য — টানাপোড়েনের অন্ত নেই জীবনে। কিন্তু এ নিয়ে যত ভাবা, তত অনন্ত চিন্তা স্ফূরিত হতেই থাকবে। তাই, আর দেরি করা উচিত নয়।
মোবাইলের স্ক্রিনে আঙুল ছুঁইয়ে ঋতবাক ‘নির্ণায়ন’-এর সম্পাদকের উত্তরের জন্য অপেক্ষা করলেন। হুতাশনের প্রায়-মেয়েলি গলার, “বলুন…” শুনে বললেন, “বাবার শেষ লেখাটা চেয়েছিলেন, কিন্তু তারও চেয়ে ভালো…”