তখন সদ্য ডাক্তারি পাশ করেছি। সবকিছুতেই উৎসাহে টগবগ করে ফুটছি। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। মনে হত, এই তো দিব্যি সব রোগ সারিয়ে ফেলছি! দু-একজন রোগী সুস্থ হ’লে মনে হ’ত আকাশের চাঁদ পেড়ে এক্কা-দোক্কা খেলি! রাত-বিরেতে ইমার্জেন্সিতে যা রোগী আসে তাদের কাউকে ইঞ্জেকশন, ওষুধপত্র দিয়ে সুস্থ করি কিংবা খুব খারাপ অবস্থায় থাকলে ভর্তি করে দিই। জীবন কত সহজ ছিল! তখনও বুঝতে শিখিনি, জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা বাড়ার সাথে আত্মবিশ্বাসের সম্পর্কটা ঠিক ব্যস্তানুপাতিক।
এমবিবিএস পাশের পরেও পোস্ট গ্রাজুয়েশনের ট্রেনিং কিংবা বন্ড সার্ভিস মিলিয়ে অধিকাংশ সময়টাই বড় বড় হাসপাতালে কেটেছে। বড় হাসপাতালের ছাদের তলায় কাজ করলে কখনোই বোঝা যায় না, প্রান্তিক অঞ্চলে গিয়ে ডাক্তারি করাটা ঠিক কতটা কঠিন! তখন বিভিন্ন রেফার করা রোগী দেখলে মাঝেমধ্যেই মনে হ’ত, ইস! আরেকটু আগে পেলে… কিংবা, পাঠানোর আগে উমুকটা দিয়ে পাঠালে হয়তো… ইত্যাদি। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, কখনও কখনও এভাবে রেফার করা নিয়ে মনে মনে বিষোদগারও করেছি। বাইরে কাউকে বুঝতে দিই নি যদিও।
তারপর অনেকগুলো বছর কেটেছে। আজ বুঝতে পারি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তো আরও বেশি সতর্ক বা সচেতন হওয়ার দরকার থাকে কিন্তু অনেক সময়েই প্রান্তিক অঞ্চলে কাজ করা চিকিৎসক কোনোমতে তাড়াতাড়ি ‘ভাগিয়ে দিতে’ (শব্দবন্ধ শ্রুতিকটু লাগলে আমি দায় নিতে অপারগ) বাধ্য হন। অনেক সময় ডাক্তার হয়তো রোগীর ভালো চেয়েই অন্তত প্রাথমিক চিকিৎসাটুকু দিয়ে রেফার করতে চান। অথচ, মুমূর্ষু রোগীর অবস্থা আরও খারাপের দিকে গেলে (মৃত্যু হ’লে তো বটেই) তার দায় এসে পড়ে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের ঘাড়ে। মিডিয়ার কল্যাণে ‘ভুল ইঞ্জেকশন দিয়ে মেরে ফেলেছে’ জাতীয় কথাবার্তা এখন বেশ প্রচলিত। কাজেই, প্রান্তিক অঞ্চলে কাজ করা ‘নিধিরাম সর্দার’ চিকিৎসক যেনতেনপ্রকারেণ কাঁধ থেকে ঝামেলা ঝেড়ে ফেলতে চাইবেন, সেটাই স্বাভাবিক।ডাক্তারের ঘাড়েও একটিই মাথা এবং সেটা বেশ সহজলভ্য। ভাঙচুর, ডাক্তার-পেটানো এসব আজকাল জলভাত। খবরেও আসে না।
এত কথা বলার উদ্দেশ্য, গতকালের একটা ঘটনা। বছর চারেকের একটা বাচ্চা সাংঘাতিক শ্বাসকষ্ট নিয়ে চেম্বারে এসেছে। তখন চেম্বার শেষ করে বেরিয়ে গেছি। তাও বাচ্চাটার কথা ভেবে ফিরে এসে দেখে দিই। তাও বিনা পারিশ্রমিকে। আগে থেকেই হাঁপানির সমস্যায় ভোগে। যখন দেখি, বুকে হাওয়া প্রায় ঢুকছে না। শোঁ শোঁ আওয়াজ। বুকের হাঁপর অনেকটা করে উঠছে-নামছে। রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা ৮২। শেষ দু’দিন ধরেই ভুগছে। শেষ পর্যায়ে দৌড়ে এসেছে। চিকিৎসা শুরুর সাথে সাথে বাচ্চার আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি নিয়ে বাড়ির লোকজনকে বোঝাতে থাকি। ওষুধপত্র, নেবুলাইজেশনের সাথে শ্বাসকষ্ট কমানোর জন্য আপৎকালীন স্টেরয়েড ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়। যার ব্যবহার সারা পৃথিবীতে স্বীকৃত। হঠাৎই বাচ্চার মা চিৎকার করতে শুরু করে দেন, “হায় হায় কী হ’ল গো… বাচ্চাটা একদম ভালো ছিল। কীসব ইঞ্জেকশন দিতেই এরকম কষ্ট শুরু হয়ে গেছে…” তারপর চিৎকার চেঁচামেচিতে চারদিকে লোকজন জড়ো হয়ে যায়। যাইহোক, কোনোভাবে সবাইকে শান্ত করা যায়। বাচ্চাটার অবস্থাও অনেকটা স্থিতিশীল করে ভর্তির জন্য পাঠানো হয়। যখন পাঠানো হচ্ছে তখন শ্বাসকষ্ট অনেকটা কমেছে। প্রাথমিক চিকিৎসা না দিয়ে পাঠালে রাস্তায় খারাপ হতেই পারতো।
এবার, যদি বাচ্চাটা সত্যিই খারাপের দিকে যেত (যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল) তাহলে স্বাভাবিকভাবেই ‘ভুল ইঞ্জেকশন’ এবং ‘চিকিৎসার গাফিলতি’র জন্য গণ-আদালতে বিচার শুরু হয়ে যেত। তাহলে কী করণীয়? প্রশ্নটা পাঠকের ওপরেই রাখলাম।
১.
দেখেই রেফার। তাতে নিজের মাথা বাঁচে। রোগীর যা খুশি হোক।
২.
নিগ্রহের আশঙ্কা নিয়ে আপৎকালীন প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া।
চিকিৎসকের প্রতি বিশ্বাস তলানিতে এসে দাঁড়িয়েছে। এই সময়ে দাঁড়িয়ে উত্তর দিতে বললে আমি দোটানায় পড়ে যাবো। তবে যাঁরা সটান এক নম্বর বেছে নেবেন তাঁদের দোষ দেবো না কোনোমতেই। ওই যে বললাম, জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা বাড়ার সাথে আত্মবিশ্বাসের সম্পর্কটা পুরো ব্যস্তানুপাতিক… সময় শেখাচ্ছে, মানুষের ওপর নিঃশর্ত বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাস দুটোই ক্ষতিকর।