মেয়ে টা দাড়িয়ে ছিল নির্বাক। বেডে শুয়ে সদ্য খিঁচুনী হওয়া বর। নিস্তেজ। টেবিলের উপর পেপার ওয়েটের নীচে দুজনার রিপোর্ট। দুজনারই এইচ আই ভি পজিটিভ। স্বামীর ফুসফুসে অ্যাসিড ফাস্ট বাসিলি। গমগমে ক্লিনিকের ভেতরে নীরবতা থমথম। “আমরা ভালও হবো তো, ডাক্তারবাবু?”
কি বলতে হয় এসময় কোনও ডাক্তারী বই-এ লেখা নেই। একদিকে ড্রাগের ছোবলে ক্ষয়ে যাওয়া একটা শরীর।তার উপর ফুসফুসে টিবি। তারউপর এইডস। ড্রাগের সূঁচ ভরে দিয়ে গেছেই মারণ রোগ স্বামীর শরীরে। নিজেও সেই বিষ নিয়ে সাতাশ বছরের পরবর্তী জীবন টুকুতে ভালো থাকা যায়! কত টুকুই বা যায়!
এসময় তাকাতে নেই। এসময় খসখস রেফার লিখতে হয়। মিথ্যের ফুলঝুরি শোনাতে হয় রুগীদের।
অথচ তাদের প্রেগনেন্সি প্ল্যানিং ছিল।
অথচ ওদের যাবার কথাছিল তের পার্বণের ডিনারে।
অথচ ওদের প্ল্যান ছিল পুজো শপিং। প্যান্টটালুন্স।
কত দ্রুত পাল্টে যায় সব।
বিয়ের পরপরই জানতে পারে মেয়েটা। একটু আধটু নেশা আছে ছেলেটার। প্রাথমিক ধাক্কা সামলে লড়াইটা শুরু করেছিল দুজনেই। নেশা ছেড়ে কষ্ট হত। এ ক্লিনিক ও ক্লিনিক। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেখিয়ে ভালই ছিল ছেলেটা ।চেম্বারে এলে গল্প করতাম আমিও।
ধমক দিতাম। তুই ভাল আছিস। ডেঙ্গুর বাজারে আসিস কেন ফালতু।
কিন্তু হঠাৎ করে আসা জ্বর আর কাশি যখন সপ্তাহ ছাড়াল সন্দেহতটা দানা বাঁধল তখনই। তারপর x-ray, কফ, রক্ত পরীক্ষা।
এবং এক অসীম শূন্যতা।
যে সময় নিয়ে আজীবন ফ্যান্টাসির পাখনা সাজায় যৌবন, সে সময় ভাঙ্গা ডানা, ভাঙ্গা পা-এর দিন কাটানোর, টিকে থাকার গল্প।
যেহেতু সামান্য মানুষ আমি, যেহেতু ফেসবুকে আগডুম বাগডুম লেখা ছাড়া কিছুই ক্ষমতা নেই আমার, তাই আরও একটি গল্প শোনাই আসুন।
এ এক মায়ের লড়াই-এর গল্প। এ এক জিততে জিততে হেরে যাবার গল্প।
আমার সাথে তার মুলাকাত এক বর্ষার সন্ধায়। তখনও ডেঙ্গু আসেনি এদিকে। করোনা বিদায় নিয়েছে বেশ কিছুদিন। চেম্বারে গুটি কয়েক পেশেন্ট দেখে যখন বাড়ি ফিরব আগেভাগেই তখনই ফোনটা এল। যাবার পথে একটা হোম কল।
মূল রাস্তায় গাড়ী রেখে হাফ ভিজে যখন পৌঁছালাম রুগীর বাড়ি ততক্ষণে বৃষ্টি নেমে গেছে ঝমঝম। মূল পেশেন্ট একজন বৃদ্ধা। হাঁপের টান। পাড়ার ছেলেরাই ডেকে এনেছে আমাকে। নেবুলাইজেশন, স্টেরয়েড, অ্যান্টিবায়োটিক, লিখে যখন ব্যাগ গোছাতে যাব, প্রথম মুখ খুললেন বৃদ্ধা। বয়স সত্তর। মলিন থান। তক্তপোষের সাথে প্রায় মিশে থাকা শরীর।
আমার ছেলেটাকে একটু দেখে দেবেন বাবু।
এমনিতে কলে গেলে বাড়ী শুদ্ধ সব্বাইকে দেখতে বল্লে রাগ হয় খুব। কিন্তূ এক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা।
দেখলাম ছেলেটাকে। ওই দেখা মাত্রই।
ড্রাগ নিতে নিতে শেষ হয়ে আসা একটা পঁয়ত্রিশের প্রাণ। ধুকধুক চলছে মাত্র। সাথে ধুম জ্বর।
ভর্তি করার পরামর্শ দিয়ে কিছু ওষুধ লিখতে হয় লিখে যখন বাইরে আসছি, বারান্দায় শুয়ে থাকা সত্তরের মা হাফরের মত শ্বাস নিতে নিতে জানতে চাইল, কি বুঝলেন ডাক্তারবাবু?
এ সময় কি বলতে হয় জানা নেই।
এ সময় চুপ থাকতে হয়।
এ সময় পালিয়ে যেতে হয় । চুপচাপ।
অথচ এমন হবার ছিল না। স্বামী মারা যাবার পর অনেক কষ্টে মানুষ করেছিল ছেলেটাকে। সেলাই করে, রূপোর রিং গেঁথে পড়িয়েছে ছেলেকে। খুব ভালো ফুটবল খেলত ছেলেটি। স্কুল পাশ করে চাকরীও পেল দৌড় ঝাঁপ করে। আর্মিতে। সমস্যা বাঁধলো একবছর পর।এক পুজোয় বাড়ী এসে জড়িয়ে গেল হেরোইনের নেশায়। সেই যে এল, চাকরিতে আর যায়নি। চাকরী গেছে। শরীরও। সাথে শেষ হয়ে গেছে সঞ্চয়। এখন বাড়িটুকু ছাড়া নেই কিছুই।
পুরোনো স্যাঁতসেঁতে দেওয়াল। মলিন তক্তপোষ। দেওয়ালে সেলাই করা আসনের হাতের কাজ। মিটকেসের উপরে কয়েকটা ওষুধ।
আর প্রায় আবছা হয়ে আসা একটা ফটো ফ্রেম।
কালো চশমা পরা একজন মানুষ। পাশে তার স্ত্রী।আর ছটফটে একটা ছেলে। এই ষোলো বছর। হাতে একটা বল।
ফেলে আশা স্বপ্নের মত সেই ফটোফ্রেমের সামনে, একটা কালী মূর্তি। স্টিলের প্লেট। কয়েকটা নকুলদানা ভিড় করে খেয়ে যাচ্ছে কালো মোটা ডেঁওপিপড়ের দল।
(পৃথিবীতে মানুষ যা কিছু অর্জন করে তার মধ্যে সবচেয়ে উদ্বায়ী হল টাকা। আজ আছে কাল নেই। সামান্য কটা টাকার জন্য এইসব ড্রাগ কারবার বন্ধ হোক। ওই মেয়েটি সুস্থ হয়ে সেলফি তুলুক শপিং মলে। ওই বৃদ্ধার হাঁপের টান কমে আসুক ইনহেলার নিয়ে। ওই ছেলেটা একটা দোকান দিক চৌরাস্তার মোড়ে। এই স্বপ্নটুকু কী দেখা যাবেনা?
ছবি: গুগল)