★
অমর পুরোনো জিনিস কেনাবেচার দালালি করে। যে কোনও দালালি ব্যবসার মতন তাকেও নিয়ম মেনে চলতে হয়। যত বেশি দাম ঠিক হবে ততই বেশি কমিশন পাবে সে।
ব্যবসার বেশিটাই ডলারে। ওইটাই সুবিধাজনক। তার পক্ষে আর যারা কেনে তাদের জন্যও।
তার কাজটা একটু অনভিজাত। এই কাজের শোভন রূপটাকে বলে অ্যান্টিক ডিলার। অবশ্যি তাদের কাজেও নানা রকম জটিলতা আছে। সে সব হল অভিজাত জটিলতা। অমরের কাজটা অভিজাত নয়। আইনি আর মিডিয়ার ভাষায় মূর্তিপাচারকারীর দালাল বলা যেতে পারে।
শুনলেই কেমন যেন অপরাধজগতের ব্যাপার বলে মনে হয়। অন্যদের আর দোষ কী? অমরের নিজেরই মনে হয়। নিজেকে বোঝায় সে, – ও কিছু না। নারী পাচার, শিশু পাচার, কয়লা-বালি পাচার, নিদেনপক্ষে গরুপাচারের মত জঘন্য কাজ তো না!
নিজেকে বোঝায় সে। শুধুই কিছু নিষ্প্রাণ ধাতু পাথর কিম্বা মন্দিরের টুকরোটাকরা। কারওর কোনও কাজে লাগে না যেই জিনিসগুলো তা’ হাতবদল হলে অমরের অন্তত কোনও মনোবেদনা হয় না।
কিন্তু এই নিয়ে সরকারি নিয়মের বাড়াবাড়ি আছে। আছে আবার নেইও। ঠিক ঠিক জায়গায় পুজো চড়ালে নিয়ম হাপিস।
★
আজকে সে শেয়ালদা’র কাছে একটা হোটেলের রিসেপশনে বসে রয়েছে। হোটেলের নানা রকম তারকা বিন্যাস আছে। ফাইভ স্টার অবধি জানে অমর। তার কাস্টমারেরা ওই সব হোটেলে ওঠে। উঠে অমরকে খবর পাঠায়। এখন লোকমুখে শুনে জেনেছে সেভেন স্টারও হয় নাকি হোটেল।
এই হোটেলটা সেই হিসেবে মাপলে কোনও স্টারই না। বরং নেগেটিভ মার্কিং দেওয়া যেতে পারে। মাইনাস ওয়ান বা মাইনাস টু স্টার হোটেল, এই গোছের কিছু।
মনে মনে হাসল অমর। হায়ার সেকেন্ডারিতে সায়েন্স ছিল তার। স্টার পেয়েছিল। মার্কশিট হারিয়ে গেছে। সেই হিসেবে সেও স্টার।
অমল আজ এই হোটেলের রেটিং করল। মাইনাস ফাইভ স্টার। তারকার রেটিংয়ে এইটা একটা ব্ল্যাকহোল হোটেল, কৃষ্ণ তারকা।
তফাত একটাই। কৃষ্ণ তারকার মধ্যে একবার ঢুকলে কিছুই বেরিয়ে আসতে পারে না। কিন্তু এটার ভেতরে ঢোকা যায়। বেরোনোও। এখান থেকে কাজ সেরে বেরিয়ে আসে ঘণ্টাপিছু শরীর বেচা মেয়েরা। এখানে আসে কলকাতায় কাজ সারতে আসা হরেক রকম মানুষেরা। কেউ ব্যবসায়ী। কেউ চাকুরে। কেউ ফেরেব্বাজ। একদিন, দু’দিন বা কয়েকদিনের ধান্দার অতিথি তারা।
অমর যার কাছে এসেছে সেই আসিফও ওইরকম একজন। ও অমরের সাপ্লায়ার। উত্তর বাংলা থেকে আজ এসে পৌঁছোবে। ট্রেন লেট করছে। বিরক্তির একশেষ।
আসিফ আসবে আসবে জলপাইগুড়ি টাউন আর বেরুবাড়ির মাঝামাঝি তরলপাড়া নামের এক জায়গা থেকে। সেইখানে তার বর্তমান আস্তানা।
★
রাজসাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আসিফ এই মূর্তি জোগাড় করেছে।
সীমান্তের কাঁটাতার আসিফের কাছে কোনও ব্যাপার না। সে বাতাসের মত। ইচ্ছামত চলাচল তার।
ওই চাঁপাইনবাবগঞ্জেরই ভোলাহাট বলে এক গ্রামে পুকুর কাটতে গিয়ে এক কষ্টিপাথরের মূর্তি পায় চাষী নাজিম শেখ।
আসলে একটা না। নাজিম পেয়েছিল দুটি মূর্তি। একটি বড় একটি ছোটো। বহুদর্শী নাজিম শেখ জানে বিপদে পড়লে অর্ধেক ত্যাগ করতে হয়। এই অর্ধেক ত্যাগের বিদ্যাটি তার পারিবারিক। বিদ্যাটি সে জেনেছিল তার নানা কিয়ামতের ইতিহাস থেকে। পারিবারিক গল্প অনুযায়ী কিয়ামত পাকিস্তানি মিলিটারির হাতে ধরা পড়েও বেঁচে গেছিল এই অর্ধেক ত্যাগ করে।
একাত্তরের অস্থির সেই পরিস্থিতিতে মিলিটারির কাছে অশুদ্ধ উর্দুতে কিয়ামত নিজেকে রাজাকার বলে ঘোষণা করে বেঁচে গেছিল। যদিও পাছায় জোর এক লাথি খেয়েছিল। সামনের দুটো দাঁত ভেঙে রক্ত লালায় মুখ যদিও ভেসে যায়, রাজাকার সেজে তার প্রাণটা রক্ষা পায়। কিন্তু কিয়ামতের নিজের ভাতিজিকে ধরে সেই দিনই নিয়ে গেছিল পাকিস্তানিরা। আর ভাইপোকে চোখের সামনে গুলি করেছিল।
সেই অর্ধেক ত্যাগের শিক্ষা মেনে একবিংশ শতকের নাজিম বড় ও ওজনে ভারি মূর্তিটিকে সবার সামনে সাফ করে। কাদা পরিষ্কার করে। লোকজনেরা ভিড় করে দেখে। পরিষ্কার করাকালীন নাজিমের স্বগতোক্তিও শোনে তারা, – সকলে দেখুক, আমার সাদা মনে কাদা নাই…
সবাই বলাবলি করে, এইবারে আল্লার রহমতে প্রচুর টাকায় এই মূর্তি বিক্রি হবে। বাংলাদেশে মাঝে মধ্যেই এই রকম ঘটনা তারা শুনেছে।
বাঙালি কখনওই প্রতিবেশীর এই প্রাপ্তিতে খুশি হবে না।
কাজেই মূর্তি পাবার খবর পেয়ে পরদিন পুলিশ এল, এবং তারা সেই একটা মূর্তি নিয়েই ফেরত গেল।
দ্বিতীয় মূর্তিটি রাখা ছিল পুকুরের পাড়ে জড়ো করা মাটির মধ্যে। নাজিমই মাটিচাপা দিয়ে রেখেছিল। সেটিকে সে রাতের অন্ধকারে তুলে আনে।
এই রকমের খবর পেলেই আনিস সেই অঞ্চলে যায়। অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে আসলেই কী ঘটে থাকতে পারে। অবস্থা থিতিয়ে পড়লে যোগাযোগ করে।
এ’বারেও তাই করেছে। খুবই আলগোছে। নাজিম প্রথমে অস্বীকার করেছিল। পরে নিপুণ খেলোয়াড় আনিস পাঁচ হাজার টাকা কবুল করে মালটাকে গস্ত করেছে। আরও কোন না নশো হাজার যাবে বিডিআর বিএসএফ সামলাতে।
দিনকে দিন খরচ বাড়ছে। আর কদ্দিন চালানো যাবে এই কারবার কে জানে।
★
মূর্তিটা পাবার পরে একবছর কেটে গেছে। এক বছর আগেই এই কষ্টিপাথরের মূর্তিটি সে যাচাই করিয়েছে ঢাকায়। আবদুস সালেক ঢাকা মিউজিয়ামের এক কিউরেটর। প্রাক্তন ইতিহাসের প্রফেসর সালেক সাহেবের সাইড বিজনেস এই মূর্তি যাচাই। তিনি মূর্তি যাচাই করে বলে দেন। সেই যাচাইয়ের ওপরে দাম নির্ভর করে। এই মূর্তিটি তিনি বলেছেন, কোনও দেবীমূর্তি না। এটাকে যক্ষিণী মূর্তি বলে বিক্রি করতে হবে।
যদিও পাথর পাথরই। তার হিন্দু মুসলমান হয় না। তবু প্রফেসর সালেক মূর্তি যাচাইয়ের ফি পকেটে ঢুকিয়ে পান চিবোতে চিবোতে বলেন, – এই হিন্দু মূর্তিটারে বেইচা ভালোই দাম পাইবা। বুঝছনি?
হিন্দুদের তেত্রিশ কোটি দেব দেবী আছে। আফশোস এইটি সেই তাদের একজন না। লোয়ার ক্যাটেগরির। তাই বলে দাম কম হবে এমন না। কেনার পরের হাত বদলে এটির দাম কত হতে পারে তার কোনও স্থিরতা নেই। পুরোটাই নির্ভর করে ক্রেতার কেনার আর বিক্রেতার বিক্রির গরজের ওপর।
এই প্রসঙ্গে ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সংবাদপত্রের খবর উদ্ধৃত করা যেতে পারে।
“পুলিশ সদর দপ্তর থেকে কষ্টিপাথরের মূর্তি বা অন্যান্য প্রত্নসম্পদ উদ্ধারের কোনো পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে সর্বশেষ গত ৮ নভেম্বর জয়পুরহাট সদর উপজেলার আমাদই ইউনিয়নের পূর্ব সুন্দরপুর গ্রাম থেকে একটি মূর্তি উদ্ধার করা হয়। এর দাম এক কোটি টাকা হতে পারে বলে তখন জানায় পুলিশ।”
হতেও পারে এটা এতটাই মূল্যবান। ঠিকঠাক ক্রেতা পেয়ে এই মূর্তি বিক্রি করতে গেলে আসিফের দেরি হবে। যদিও এর মধ্যে তার পুরোনো অন্যান্য জিনিস বিক্রির যে ব্যবসা, তা’ চলতে থাকবে।
এই যক্ষিণী নামের হিন্দু মূর্তিটা গত এক বছর ধরে আসিফের সঙ্গে সঙ্গে থাকছে। এই একবছরে আসিফ ঢাকায় নিজের বাড়িতেও যায়নি। তার কাজের যা ধরণ তাতে এক জায়গার বাসায় থাকা তার পক্ষে মুশকিল। আপাতত সে থাকছে ইন্ডিয়ায়। জলপাইগুড়ি টাউন আর বেরুবাড়ির মাঝামাঝি। তরলপাড়ায়। ভাড়া নেওয়া এক বাসা।
এই মূর্তি হাতে আসার পর থেকে আসিফ এক রহস্যময় মনের রোগে জড়িয়ে পড়েছে। মনের রোগই। তার মনে হয় সে যেন এমন কিছু কাহিনি জানে, যা তার জানবার কথা নয়। জানে শুধু নয়, সে নিজে যেন সেই সব ঘটনার একটি চরিত্র। জলপাইগুড়ি টাউনের ডাক্তার তাকে বলেছে, এইগুলি দিবাস্বপ্ন। এই আজেবাজে দিবাস্বপ্ন দেখাটা তার মনের রোগ। ওষুধও দিয়েছে কিছু।
যক্ষিণীকে পেয়ে অবধি তাকে এক দিনের জন্যেও কাছছাড়া করতে ইচ্ছা করে না আসিফের। সেই প্রথম দিনের পর থেকে। কেনাবেচার কাজে দুএকদিন বাসায় চাবি দিয়ে এ’দিক ও’দিক যেতে হয় বটে। কিন্তু মন টেকে না।
ঢাকার বাসায় যায়নি কতদিন। তার বউ সালেমার অ্যাকাউন্টে টাকা অবশ্য ঢোকায় নিয়মিত, ফোনেও কথা বলে রোজই। কিন্তু ওইদিকে যাবার মন নেই তার। বরং মন পড়ে থাকে এই তরলপাড়ার বাসায়।
চুরি হবার সম্ভাবনা খুবই কম। কিন্তু তার মনে হয়, সে না থাকলে যক্ষিণী মূর্তিটির মন খারাপ করে। মূর্তির ঘাড়টা একটু বাঁ দিকে ফেরানো। প্রথম দিকে একবার টানা দু’দিন ছিল না। পরে বাসায় ফিরে স্পষ্ট মনে হল যেন মূর্তি অভিমানে ঘাড় ফিরিয়ে আছে। – রাগ করলি নাকি? আরে ব্যবসার অবস্থা ভালো না। ধরপাকড় চলছে।
আসিফ নরম গলায় মূর্তিকে বোঝায়, – যেন ইন্ডিয়া বাংলাদেশের মানুষ সবাই সাধু, শুধু আমিই একা চোর! সাবধানে কাজ করতে হয়। তাও তো তোকে ছেড়ে তত দূরে যাই না। আমার ব্যবসার আসল কাস্টমাররা সবই কলকাতার। বুঝলি তো?
পাথর মূর্তিকে সে এই সব বোঝায়। নিশ্চয়ই এটা পাগলামিরই লক্ষণ। তাও তো এইটা জাগ্রত অবস্থার বিবরণ। ঘুমের মধ্যে অন্য ব্যাপার শুরু হয়।
একই স্বপ্ন ঘুরে ঘুরে দেখে। সেই স্বপ্নের সব কথা, সব জায়গার নাম, সব লোকের নাম ঘুম থেকে জেগে উঠে মনেও পড়ে না। কিন্তু কতকগুলো জিনিস মনে পড়ে ঠিকই। কেন না স্বপ্নের মধ্যে সেই নাম আর ঘটনাগুলি বারবার ঘটে।
★
আসিফ কোনও দিন সমুদ্র দেখেনি। এক বার সখ করে কক্সবাজার যাবার কথা বলেছিল সালেমা। কিন্তু যাওয়া হয়নি।
তখনই কিছু মাল হঠাৎ হাতে এসে গেছিল। ইন্ডিয়ায় কাস্টমারও রেডি। সালেমাকে বোঝাতে গিয়ে নাজেহাল অবস্থা।
অথচ স্বপ্নে আসিফ দেখতে পায় অপার সমুদ্রে ভাসা এক জাহাজ। জাহাজের খোল ভর্তি হাতে পায়ে শিকল বাঁধা মানুষ। সে নিজেও সেই জাহাজে।
তার কাজ সেই বন্দী লোকগুলিকে খেতে দেওয়া। এর আদ্ধেকই বোধ হয় মরে যাবে। বাকি যে কটা বাঁচবে জাহাজের মালিক পেড্রো সেইগুলোকে বিক্রি করবে চট্টগ্রামের দাস বাজারে।
সুন্দরবনের গ্রামে হানা দিয়ে তুলে আনা হয়েছে মানুষগুলিকে। আর্মাডা মানে হার্মাদদের এই জাহাজের আসল লোকেরা প্রায় সবাইই ক্রিশ্চান। শুধু তার মত ক’জন বাদে।
তারাও দাসই। ফাইফরমাশ খাটাবে বলে শক্তপোক্ত কিছু মানুষকে দাস বাজার থেকে কিনে পুষেছে পেড্রো। ডাকাতদের সঙ্গে থাকতে থাকতে সেও একরকম ডাকাতই হয়ে গেছে।
পেড্রো চোখ পাকিয়ে তাকে বলল, – ঠিক ভাবে রাখছিস তো জানোয়ারগুলোকে? ওদের যে ক’টা মরকুটে, খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখার কোনও দরকার নেই। ফেলে দিবি জলে। আর বাকিগুলোকে এ’বেলা দু’টো ও’বেলা দু’টোর বেশি রুটি দিবি না। বেশি যত্নের দরকার নেই। বিক্রি করে যে’কটা পয়সা আসে। এ’বারের বেচাকেনা শেষ হলে সোজা গোয়ায় গিয়ে উঠব। বিশ্রাম নেব ক’টা দিন।
হাই তুলে দুলে দুলে হাসে ক্যাপ্টেন।
বেশি যত্নের দরকার নেই বলল বটে, কিন্তু ওদের থেকে একদম আলাদা একটা খোপে একজনকে একটু আলাদা রকম যত্নে রাখতে হচ্ছে এই পেড্রোর হুকুমেই।
পেড্রো ডেকের ওপরে রাখা সেই খোপটার নাম দিয়েছে সাপের ঝাঁপি। কালো আয়ত চোখের এক সাপ। মেয়েটার নাম দিয়েছে কোব্রা ফেমিয়া। ওদের দেশের ভাষায়।
ফোঁস করে উঠেছিল ওকে আলাদা করে তুলে আনার সময়। ঘাড় বেঁকিয়ে সেই কালোমেয়ের বিদ্রোহিনী মূর্তি দেখে থমকে গেছিল ডাকসাইটে ডাকাত পেড্রোও।
তা সেই থেকে আজ অবধি ঘাড় ফিরিয়েই রইল সেই মেয়ে। তার জন্য খাবার যা বরাদ্দ, তা’ বন্দীদের খাবার নয়। ডাকাতদের নিজেদের যা খাবার তাইই দেওয়া হয় তাকে। খুব আহামরি যে কিছু তা না। কিন্তু বেশ আলাদা। রুটি ভাতের সঙ্গে মাছ মাংস। কখনও ফল।
পেড্রোর এক স্যাঙাত রাফায়েল।
সে চোখ মটকে বলে, – ক্যাপ্টেন ভাবছে এটাকে বেচলে কোন না একশটা সোনার কয়েন পেয়ে যাবে! বেচার আগে নিজে তো মেয়েটাকে খাবে একবার দুবার বটেই।
সে খাবার দিতে যায় যখন, দু একবার পিছু নিতেও চেয়েছে রাফায়েলটা। ওকে বলেছে, – তুই তো টিপেটুপে চেখেছিস মালটাকে। আমাকেও একটু চাখতে দিস।
এ’সব ইয়ার্কি শুনতেও ভয় লাগে। পেড্রো জানতে পারলে স্যাঙাত বলে রেয়াত করবে না। টুঁটি ছিঁড়ে ফেলবে।
এই সব নোংরা কথায় রুচি হয় না ওর। আশ্চর্য। সব কটা ডাকাতের বিয়ে করা বউ সংসার রয়েছে। না, ওই ফেলে আসা দূর স্বদেশ পর্তুগালে না। হাতের কাছেই সন্দ্বীপে। তবু মেয়ে মানুষের মাংস খোঁজে এ’গুলি সবাই।
পেড্রো নিজেও তাই। বিক্রি করার আগে চেখে দেখবেই। তেমন স্বাদের হলে হয় তো বেচলই না। ওই গোয়া না কোথায় যাবে, সে’খানেই নিয়ে গেল হয় তো।
এ’দিকে আর এক বিপদ। খাবার যথেষ্ট আলাদা বটে, কিন্তু মেয়ে মুখে তোলে না কিছুই।
ও নরম গলায় বোঝায়। – ওরে মেয়ে, না খেয়ে লাভ নেই। বাঁচতে তো হবে। না কি?
মেয়ে জেদ ধরে না খেয়ে বসে থাকে। পেড্রোকে এই সব খবর জানানো যায় না। পশু তো। জানলেই অগ্নিশর্মা হয়ে কী করবে কে জানে। তার চাইতে তোয়াজ করে যদি একে খাওয়ানো যায় সেই চেষ্টা করে ও।
এই করতে করতে জাহাজ এসে লাগে দাসবাজারের বন্দরে। হার্মাদ আর মগ ডাকাতদের এই বাজারে বেচাকেনা শেষ হতে কোন না এক দু মাস লেগে যাবে। রোজই পাঁচটা দশটা করে মেয়ে পুরুষ বিক্রি হচ্ছে। এ’বারে বাজার একটু মন্দা।
পেড্রো আর কারভ্যালহোর আলাপ কানে আসে ওর। কোন আরাকান রাজপুত্র, আসলে তো এই আরাকানগুলোই মগ ডাকাত, সে নাকি কিনতে চেয়েছে মেয়েটাকে। আসবে, যাচাই করবে। ঠিকঠাক পেলে তবেই বেচাকেনা।
এই ঠিকঠাক ব্যাপারটাতেই গোলমাল। মেয়ে মানুষ। তার মন রয়েছে। আবার শরীরও রয়েছে। সেই দুটোই ঠিকঠাক থাকলে তবে ওই ক্রেতার মন উঠবে।
এ’দিকে নতুন খবর এসেছে। খবর পেড্রোর জন্য বেশ কিছুটা খারাপ। পেড্রোর চাইতেও উঁচু থাকের ডাকাত গঞ্জালেসের জাহাজ নাকি ধরা পড়েছে মোগলদের হাতে। এবারে সেই মোগল সেনাবাহিনী আসছে চট্টগ্রামের দিকে। এই ঘাঁটিতে থাকলে কচুকাটা হতে হবে। কাজেই পালাতে হবে।
মোট নব্বই সুবর্ণ মুদ্রায় ওকে আর মেয়েটাকে বিক্রি করল পেড্রো। তার নিজের নোংরা ইচ্ছে মেটানোর আগেই। হাতে সময় নেই মোটে। বন্দর ছেড়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পালাবে পেড্রো।
একটু তাড়াহুড়োর মধ্যেই হাত বদল হল মেয়েটার। ফাউ হিসেবে দিতে হল ওকেও। আরাকানি ডাকাতটা খবর পেয়েছে এই দাসটার হাতে ছাড়া কিছুই খায় না ওই হিলহিলে সাপের মত রূপচ্ছটার সুন্দরী।
একদিন না একদিন বশ তো হবেই। কিন্তু তার আগে খাইয়ে টিঁকিয়ে রাখাটা জরুরি। বশ হবেই। আরাকান রাজপুত্রের তাড়া নেই। তার হারেমে মেয়ে মানুষের অভাব নেই।
কিন্তু যে খবর আর কেউ জানে না, বশ হবার আগেই মেয়ে নিজে অবশ হয়েছে। ওই ক্রীতদাসটার জন্যে। সেই দাস নিজেও জানে না কখন নিঃশব্দে তার এই সর্বনাশ ঘটেছে গত কয়েকমাসে।
আরাকানে এখন খুব অশান্তি। রাজপুত্রের সওদা লুকোনো থাকবে চট্টগ্রামের কাছেই এক দ্বীপে। অবস্থা শান্ত হলে হারেমে তুলবে।
তা অবস্থা শান্ত হলও। মাস আষ্টেক কেটেছে এর মধ্যে।
আজ মেয়েকে নিয়ে যেতে লোক পাঠিয়েছে তার মালিক মানে সেই রাজপুত্র। সেই নিয়ে যাবার লোকও আরেক আরাকানি ডাকাত। নৌকোয় করে প্রায় একলাই এসেছে। বেশি লোক লস্কর সঙ্গে নেই।
মেয়ে দাসকে জানিয়ে দিয়েছে, – দরকারে আমি নিজের গলায় ছুরি বিঁধিয়ে মরব কিন্তু ওই মগ বাঁদরটার হারেমে যাব না। তুই আমাকে নিয়ে পালা।
ক্রীতদাস নিরুপায়। ব্যবসার নিয়মে মেয়েকে দিয়ে দেবারই কথা। যদিও তার মন সায় দিচ্ছে না। আপত্তি করলে তাকে কেটে টুকরো করে ফেলবে মগ ডাকাতের দল। থিরি-থু-ধাম্মার এই অনুচরদের মানুষ মারতে হাত কাঁপে না।
বিকেল সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত নেমে এলো নদীতে।
ডাকাতটা ঘাটের পাশের বাড়িতে ঢুকে মেয়েটার হাত ধরে জোর করে নিজের নৌকোয় তুলল। দাপাদাপি করছে সেই মেয়ে। কী করে সেই দাপাদাপির মধ্যে, গলুইয়ে বাঁধা জ্বলন্ত মশাল থেকে আগুন লেগে গেল ডাকাতটার পোষাকে। সে নিজেকে বাঁচাতে ব্যস্ত হয়ে হাত আলগা করতেই মেয়েটা পাগলের মত নৌকোর কিনারায় পৌঁছে ঝাঁপ দিল জলে।
সরসর করে তীব্র স্রোতে বয়ে যাচ্ছে নিকষ কালো জল। নৌকোর বাকি সবাই আগুন নিভিয়ে ডাকাতটাকে বাঁচাতে ব্যস্ত।
ক্রীতদাস মেয়েকে ঝাঁপাতে দেখে নিজেও ঝাঁপ দিল জলে।
আসিফের ঘুম ভেঙে যায় এই অবধি দেখে। রোজই। শেষে কী হল?
★
কলকাতায় আসিফের আসল কাজটা এর পরের। শেয়ালদার এক নোংরা হোটেলে সে আজ উঠবে। তার নাম হবে কানুলাল। তার যা কাজ তাতে নিজের একই নাম বারবার রাখা যায় না। আজকাল পাতি হোটেলে উঠতে গেলেও আধারটাধার জমা দিতে হয়। তা সেসবও আছে বই কি কানুলালের। কেরেস্তান আর বৌদ্ধ নামেরও আছে। ফ্রান্সিস গোমেজ আর কেশবলাল বরুয়া।
ফোনে কথা হয়ে গেছে। আজ অমর, মানে সেই দালাল যক্ষিণীর কাস্টমারের কাছে নিয়ে যাবে তাকে। দাম ঠিক হবার পর হাত বদল হবে।
শেয়ালদায় নেমে, হোটেলে পৌঁছে দেখে অমর আগেই এসে গেছে।
★
অমর বলল, – ট্রেন লেট করে মহা ঝঞ্ঝাটে ফেললে তুমি। সাহেব বেরিয়ে না পড়ে।
ক্রেতা রয়েছে তার নিজের পাঁচতারা হোটেলে। সে’খানে মাল দেখিয়ে দর ঠিক হবে। রুম নাম্বার, নাম এইসব খবরই হোয়াটসএপে দিয়ে রেখেছে ক্রেতা সাহেবটি।
উবেরে যেতে যেতে অমর তাকে চুপিচুপি বলে, এই সাহেবকে সে আগের থেকেই ভজিয়ে রেখেছে। মাল পছন্দ হলে বিশ হাজার ডলার অবধি দেওয়া অসম্ভব না।
মাল পছন্দের আবার হ্যাপা অনেক। পাথরের গ্রেইন দেখবে। তা’তে নাকি বোঝা যাবে কদ্দিনের পুরোনো। সঙ্গে কী সব মেশিনটেসিনও থাকে। মোটমাট দাম কমানোর মেলা প্যাঁচ পয়জার জানে এই লালমুখো সাহেবগুলো।
কিন্তু আসিফকে ঢাকার সেই প্রফেসর সালেক বলে দিয়েছেন, অন্তত পাঁচশ বছরের পুরানো তো বটেই।
কাজেই বিশ হাজার ডলার, দাম হিসেবে উচিতমূল্যই। চিন্তা নেই। অমর আছে। টেন পার্সেন্ট কমিশনের লোভে সে আবার পাঁচশোরও বেশি পুরোনো না বলে বসে।
আহা, তার আশ্রয়ে ছিল মূর্তিটা এতদিন। আজ কোন পরের হাতে চলে যাবে সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে। আর দেখা হবে না আসিফের সঙ্গে যক্ষিণীর। গত কয়েকদিনে তরলপাড়া থেকে রওনা হয়ে অবধি যত্ন করে কাপড়ে প্যাঁচানো মূর্তিটা ব্যাগ থেকে বার করে সে খুলে দেখেনি। আজই শেষ দেখা।
ক্যাব ছেড়ে সাহেবের হোটেলের সামনে নামল দু’জনে। আসিফের কাঁধে কাপড়ের ব্যাগে, সেই যক্ষিণী।
বাইরের কড়া রোদ থেকে এসে ঠাণ্ডাঘরের নরম সোফায় বসতে দিব্যি লাগছিল।
অমর কাউন্টারে গিয়ে সাহেব কে খবর দিতে বলল। আসিফ জানে, এ’বারে হোটেলের রিসেপশনিস্ট হাতের কাজ সামলে সাহেবকে ফোন করবে। কিছু পরে মিষ্টি হেসে বলবে,
– ইয়েস, ইউ মে গো নাও…
★
ঠিক এমন সময়ে হঠাৎ আসিফের মনে হল, না এই যক্ষিণীকে সে বেচবে না। বেচা তার পক্ষে সম্ভবই না। আসিফকে প্রায় দৌড়ে বেরোবার দরজার দিকে যেতে দেখে অবাক অমর। চারপাশে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল সন্দেহজনক কেউ আছে কি না। আসিফ অমন দৌড়ুলো কেন? পুলিশ বা খোচর, সে’রকম কিছুই তো চোখে পড়ল না। তবে?
অমরের গরজও কম না। বিশ হাজারের টেন পার্সেন্ট মানে দু’হাজার। ডলার কত করে যাচ্ছে এখন? ভাবতেই মাথায় আগুন ধরে গেল। এ’খানে তো চেঁচামেচি করা যায় না। সেও দৌড়ুলো দরজার দিকে।
আসিফ এতক্ষণে বড় রাস্তায় পৌঁছে দৌড়ে পেরোচ্ছে। সিগন্যাল ট্রাফিক ছেড়ে দিয়েছে।
উল্টোদিকে কোনও ক্রমে পৌঁছে শেয়ালদার বাসটায় লাফিয়ে উঠতে না উঠতেই উল্টোদিকে গেল গেল রব আর ক্যাঁ-অ্যা-অ্যা-চ করে তীব্র ব্রেক টেপার আওয়াজ উঠল। ব্যস্ত অমর চালু ট্রাফিকের মধ্যে দিয়ে রাস্তা পেরোতে গেছিল।
★
রাত এগারোটা। আসিফ এখন ছুটতে থাকা দার্জিলিং মেলের জেনারেল কমপার্টমেন্টে। গতকাল থেকে ধকল গেল কম না। আজও সারারাত ট্রেনে প্রায় দাঁড়িয়েই। কিম্বা কপাল ভালো হলে মেঝেতে বসে বসে যেতে হবে।
সে পরম স্নেহে কাপড়ের ব্যাগে মুড়িয়ে রাখা তার যক্ষিণীর গায়ে হাত বোলাল। – সোনামণি গো, কী ভুলটাই না করতে যাচ্ছিলাম আজ। সেই বারেও তোর জন্য জলে ঝাঁপিয়েছিলাম। আর আজও মরণের রাস্তা পেরোলাম…ওই তরলপাড়ার বাসাতেই তুই থাকবি। কত লোকেরই তো দুই সংসার থাকে। থাকে না? ঢাকায় সালেমা আর এইখানে তুই, কোব্রা ফেমিয়া। সালেমা জানতেই পারবে না। আর সালেমা জানলেই বা কী, তুই তো পাথর!
অতি চমৎকার