দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি বিশেষ ২১
অনেকদিন হলো ভোট-ফোট নিয়ে আর হাওয়া গরম হয় না। বাজারে নতুন কেচ্ছা-কেলেঙ্কারিও নেই। খুব বলার মত নতুন গান বা সিনেমা… উঁহু সেটাও নেই! একটা সময় শীতকাল মানেই ক্রিকেট ছিল। এখন সেরকম আদ্যন্ত ক্রিকেটপ্রেমী খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। বারো মাসে বারোশো খেলা আর আইপিএল সহ হাজার একটা পিএল আসার পর খেলাটার গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটেছে। অর্থাৎ কিনা, বাজারে নতুন খবর নেই। সম্বৎসরের ক’টা দিন মাত্র শীত; তারও দেখা নেই। কুয়াশা আর খেজুর গাছ ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে ছবি তোলার ধুম নেই। চতুর্দিকে শুধু নেই আর নেই। ওই এক নতুন ওমিক্রন এসেছে। সে খানিক হাওয়া গরম করার চেষ্টা করছে বটে, তাতে কারো কিছু আসে যায় বলে মনে হয় না। এমনিতেই করোনা নিয়ে কেউ আর নতুন করে কিছু শুনতে রাজি নয়। সবাই সবকিছু জেনেবুঝে গেছে। অগত্যা সতর্কীকরণের মত ক্লিশে জিনিস দিয়ে লেখাটার রসভঙ্গ করবো না। আরেকটা কাজের দিনের গল্প শোনাই বরং…
রফিক মোল্লা। বয়স তিন বছর। শেষ ছ’মাসে বার পাঁচেক সমস্যাটা হয়েছে। হাত-পা কেমন যেন কাঁপতে থাকে, মুখ বেঁকে যায়, গ্যাঁজলা বেরোয়। চোখটা উল্টে যায়। অন্তত মিনিট দশ-পনেরো অজ্ঞান থাকার পর মাথায় চার-পাঁচ বালতি জল ঢাললে জ্ঞান ফেরে। সাংঘাতিক সমস্যা। এমনিতেই লোকে বলে রফিকদের বাড়ির জায়গাটা নাকি খুব একটা ভালো নয়। সন্ধের পর ওখানে কী সব বিজাতীয় আওয়াজও শুনেছে কেউ কেউ। বাড়ির পেছনেই অত বড় অশ্বত্থ গাছ। গোটা গাছ থেকে ঝুরি নেমেছে। বিকেল গড়ালেই গাছের গোড়ায় চাপ চাপ অন্ধকার। তেনাদের জন্য পুরো আদর্শ জায়গা। রফিকের বাবা অনেক খরচাপাতি করে বড় ইমাম ডেকে এনে ঝাড়িয়েছে। ইমাম বলে গেছে পুরোপুরি ঝাড়াতে অনেক সময় লাগবে। বাড়ির পেছনের আশুথ গাছের মগডালেই নাকি তেনার বাস। ছয় মাসে অনেকবার ঝাড়ানোর পরও যখন কোনও সুফল পাওয়া গেল না তখন নিতান্ত বাধ্য হয়েই রফিককে নিয়ে হাসপাতালে আসতে হ’ল। প্রায় ফিসফিসিয়ে পুরো বৃত্তান্ত বলে যখন শেষ করল তখন রফিকের বাবা রীতিমত হাঁফাচ্ছে। এই শীতেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
– যিভাবে পারেন একটু ঝাড়ি দিবার বেবস্তা করি দিন ডাক্তারবাবু… ছিলাটার কী যে হই গেল…
মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই। একবিংশ শতাব্দীর একুশ খানা বছর অতিক্রান্ত। এখনো খিঁচুনির রোগে ভূত ঝাড়ানো চলে। শহরের উজ্জ্বল আলোর বৃত্তের বাইরে এখনো কী প্রচন্ড অন্ধকার…
কিছুক্ষণ বাদেই এলো মহম্মদ ইসমাইল। বয়স সবে সতেরো দিন। ইসমাইলের বাবা সম্পর্কে তার বউয়ের মাসির ছেলে। এর আগে চারটে মেয়ে আছে। শ্বশুরবাড়ি থেকে চাপ আসছে ছেলে একখানা দিতেই হবে। নইলে বংশে বাতি দেবার কেউ থাকে না যে… এদিকে ছেলেগুলো কিছুতেই বাঁচে না। এর আগেও দু’টো ছেলে হয়েছিল। একটা ঊনিশ দিন আর একটা একমাস বয়সে মারা যায়। একইরকম রোগ ছিল দু’জনের। বারবার বমি, পেট ফুলে যায়। ইসমাইলেরও পেটটা ফুলে জয়ঢাক। অনেকক্ষণ ধরে বোঝালাম- বমি, পেট ফুলে যাওয়ার চিকিৎসা তো চলবেই; সেই সাথে জীনঘটিত কোনও রোগ আছে কিনা তার জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। ইসমাইলের বাবা সমস্ত উপদেশ খুব মনোযোগের সাথে শুনলো। তারপর গলাটা খাদে নামিয়ে এনে খুব ধীরে ধীরে বলল-
– জ্বীন-ভূতের ব্যাপার… সে তো তাহলে খুব ভয়ের ব্যাপার ডাক্তারবাবু… ঝাড়ানোর সব ব্যবস্থা এখানেই হয়ে যাবে তো?
নেহাত মাস্ক পরে থাকি। নইলে হাঁ হয়ে যাওয়া মুখে খান চার-পাঁচেক মাছি ঢুকে যাওয়ার কথা। এসব গল্প করতে করতে বড্ড দেরি হয়ে যাচ্ছে। এবার দ্রুত হাত চালাতে শুরু করলাম। আর বেশি দেরি হ’লে এবার লাইনে চেঁচামেচি শুরু হয়ে যাবে।
সাত বছরের বাচ্চাকে ইঁদুরে কামড়েছে। সব উপদেশ দিয়ে-টিয়ে প্রেসক্রিপশনটা ধরাতে যাচ্ছি…
– মানে, ইয়ে ডাক্তারবাবু…
– হুঁ…
– ঘরোয়া ইঁদুর না বনেদী ইঁদুর; ঠিক খেয়াল করিনি
– কী? কী ইঁদুর?
– ওই যে স্যার যেগুলো বনে থাকে না… বড় বড় সাইজ… বনেদী ইঁদুর কামড়ালে নাকি খুব খারাপ হয় শুনেছি…
‘বনেদী’ কথাটার নতুন একটা মানে শিখলাম। রোজ শিখতে শিখতে আরও একটা বছর শেষ হ’তে চললো। মারীর দেশে আরো কত কী শেখা বাকি…
ছবিঃ গুগল