বর্তমান যুগে ‘হলুদ সাংবাদিকতা’ শব্দটি আমাদের সমাজে অতি পরিচিত একটি শব্দ হইলেও উহার জন্ম হইয়াছিল শতাধিক বৎসর পূর্বে। সাংবাদিকতা জগতের অন্যতম দুই ব্যক্তিত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জোসেফ পুলিৎজার এবং উইলিয়াম রুডল্ফ হার্স্টের পারস্পরিক পেশাগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফসল এই হলুদ সাংবাদিকতা। ১৮৯৫ সালে এই দুই সম্পাদক নিজ নিজ পত্রিকার ব্যবসায়িক স্বার্থ চরিতার্থ করিবার জন্য এবং নিজেকে অপেক্ষাকৃত যোগ্য সাংবাদিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য এক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামিয়াছিলেন। অধিক পারিশ্রমিকের প্রলোভন দেখাইয়া প্রতিপক্ষের দপ্তর হইতে দক্ষ কর্মচারী ভাঙাইয়া লইবার ঘৃণ্য চক্রান্তে মগ্ন হন দুইজনই। উভয়েই প্রতিপক্ষের ব্যক্তিগত কুৎসার চাঞ্চল্যকর সংবাদ ছাপাইয়া পত্রিকার বিক্রয়বৃদ্ধি করিবার চেষ্টা করেন। পুলিৎজারের নিউ ইয়র্ক ওয়ার্ল্ড এবং হার্স্টের নিউ ইয়র্ক জার্নালের মধ্যে এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা এমন অরুচিকর পর্যায়ে চলিয়া যায় যে, সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতার পরিবর্তে পত্রিকার বাহ্যিক চাকচিক্য এবং পাঠকদিগের উত্তেজনা প্রদানই মুখ্য হইয়া দাঁড়ায়। হলুদ রঙের নৈশকালীন পোষাক পরিহিত এক বালকের ব্যাঙ্গচিত্রের সহিত নানাবিধ ক্যাপশন যুক্ত করিয়া একে অপরের বিরুদ্ধে টানা তিন বৎসর কুৎসাপ্রচার চালাইয়া যান। এই হলুদ বালক (yellow kid) তখন এত জনপ্রিয় হইয়াছিল যে পরবর্তীকালে তাহা হইতেই ‘হলুদ সাংবাদিকতা’ (yellow journalism) নামক বিশেষ শব্দটির উৎপত্তি হয়।
হলুদ সাংবাদিকতা বলিতে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ভিত্তিহীন রোমাঞ্চকর সংবাদ পরিবেশন বা উপস্থাপনকে বুঝাইয়া থাকে। এই ধরনের সাংবাদিকতায় পর্যাপ্ত গবেষণা অথবা তথ্যসন্ধান না করিয়াই দৃষ্টিগ্রাহী এবং আকর্ষক শিরোনাম সহযোগে সংবাদ পরিবেশন করা হইয়া থাকে। হলুদ সাংবাদিকতার মূল উদ্দেশ্য হইল সাংবাদিকতার কোন রীতিনীতি না মানিয়াই যেন তেন প্রকারেণ পত্রিকার বিক্রয় অথবা টেলিভিশন চ্যানেলের দর্শকসংখ্যা বৃদ্ধি করা। ভিত্তিহীন সংবাদ পরিবেশন, দৃষ্টি আকৰ্ষণকারী শিরোনাম ব্যবহার করা, সাধারণ ঘটনাকে একটি সাংঘাতিক ঘটনা বলিয়া প্রতিষ্ঠা করিবার চেষ্টা করা, কেলেংকারির খবর গুরুত্ব সহকারে প্রচার করা, অহেতুক চমক সৃষ্টি সমস্তকিছুই হলুদ সাংবাদিকতার বিবিধ বিকৃতরূপ।
ফ্র্যাঙ্ক লুথার মট হলুদ সাংবাদিকতা প্রসঙ্গে পাঁচটি মূল বৈশিষ্ট্য তুলিয়া ধরিয়াছেন:
১. সাধারণ ঘটনাকে কয়েকটি কলাম জুড়িয়া বড় আকারের ভয়ানক একটি শিরোনাম করা।
২. ছবি এবং কাল্পনিক নক্সার অপরিমিত ব্যবহার।
৩. ভুয়ো সাক্ষাৎকার, ভুল ধারণার জন্ম দিতে পারে এমন শিরোনাম, ভুয়ো বিজ্ঞানমূলক রচনা।
৪. তথাকথিত বিশেষজ্ঞ কর্তৃক ভুল শিক্ষামূলক রচনার ব্যবহার।
৫. স্রোতের বিপরীতে চলা অপ্রগতিশীল রাষ্ট্রনায়কদের প্রতি নাটকীয় সহানুভূতি।
বস্তুনিষ্ঠতা, নিরপেক্ষতা, নৈতিকতা এবং সত্যপ্রকাশের সাহস এই চারটি গুণাবলীর সম্যক উপস্থিতি হইল আদর্শ সাংবাদিকতার চারটি মূলস্তম্ভ। যাহার কোন একটির অভাব হইলে সাংবাদিকতা আর সাংবাদিকতা থাকে না; দুর্বল হইয়া যায় শক্তিশালী গণমাধ্যমের কাঠামোখানি, ধীরে ধীরে ভাঙিয়া পড়ে বিশ্বাসের ছাদ।