১
স্বাধীনতার এত বছর পরেও দেশে এমন একটা জায়গা আছে, সত্যিই না দেখলে বিশ্বাস করতে পারতাম না। বাস স্টেশনে হেডমাস্টার আর তাঁর সঙ্গীদের দেখেই থমকে গেছিলাম। এ দৃশ্য না দেখলে ভাবতাম ওদের ওয়েবসাইটের মাস্টারমশাইদের ছবি আমার ছোটোবেলায় পড়া সেই ইংরিজি বইয়ের বোর্ডিং স্কুল থেকে নেওয়া। এই সবে মাথা থেকে মর্টার বোর্ড আর কাঁধ থেকে স্কলার্স গাউন নামিয়েছেন। এরকম স্কুল এখন ইংল্যান্ডেও কি আর আছে? আমার জিনস আর সারা রাত বাসজার্নি করা শার্টের দুর্দশার দিকে না তাকিয়ে এগিয়ে গেলাম।
করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন চারজনের মধ্যে যিনি আধ পা এগিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। অভ্যর্থনা জানালেন। না বললেও বুঝতে অসুবিধে হত না, তবে নিজের পরিচয় দিলেন — চিত্রেশ আলোক, হেডমাস্টার। জানতে চাইলেন যাত্রা আরামদায়ক ছিল কি না। পথে কোনও অসুবিধে হয়নি তো? সঙ্গীদের পরিচয় দিলেন। কার্লটন সোমস্, প্রিতপাল সিং, মাকেনা কিমাঙ্গী — যথাক্রমে ইংরেজি, কমার্স আর সায়েন্সের হেড। সকলেই হ্যান্ডশেক, সকলেরই ইংরেজি চোস্ত। চিঠির বয়ানে ভালো ইংরেজি একরকম, কিন্তু এ আলাদা। ইংল্যান্ড ছাড়ার পরে এমন সাহেবি ইংরেজি আর আদবকায়দার একত্রিত সমাহার আর দেখিনি। এবার বুঝলাম, সৌমিকদা কেন বলেছিল, ওরে বাবা! ওখানে… আর তারপরে বলেছিল, অবশ্য কেউ যদি মানিয়ে নিতে পারে, তুই-ই পারবি। ওদেশে জন্ম কি না!
আমার জন্ম কোন দেশে আমি জানি। কিন্তু তার সঙ্গে নতুন চাকরির কী সম্পর্ক হবে তখন বুঝিনি। ক্রমে বুঝতে পারলাম। প্রথমে করমর্দনের ঘটা দেখে ভাবছিলাম, এঁরা কি করোনার নাম শোনেননি? কিন্তু দেখলাম সবার সঙ্গে আমার হ্যান্ডশেক শেষ হওয়ামাত্র সায়েন্সের হেড কিমাঙ্গী পকেট থেকে স্যানিটাইজারের বোতল বের করে বাড়িয়ে ধরলেন। বললেন, “এই এক জ্বালা হয়েছে। কিন্তু উপায় তো নেই, নিন…” আর ইংরেজির হেড বললেন, “তবু ভালো এতদিন পরে মাস্ক পরার জ্বালাতনের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছি। আপনাদের ওখানেও শুনলাম মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক নয় আর?”
আমি বাসে মাস্ক পরেই ছিলাম, তবে নামার আগে খুলে নিয়েছি, সে ওঁরা জানেন না। বললাম, “হ্যাঁ, তবে বলা হচ্ছে পাবলিক প্লেসে মাস্ক পরে থাকাই বাঞ্ছনীয়।”
ওঁরা চারিদিকে তাকালেন, যেন করোনা গুঁড়ি মেরে আসছে কি না দেখছেন। তারপরে হেডমাস্টার বললেন, “চলুন, যাওয়া যাক?”
২
ওঁরা বলেছিলেন, ইন্টার্ভিউয়ের আগে কিছু সময় কাটানোর জন্য হাতে দিন দুয়েক নিয়ে এলে ভালো হয়। বলেছিলেন, স্কুল সানন্দে আমার থাকা-খাওয়ার দায়িত্ব নেবে, এবং যথোপযুক্ত কম্পেনসেশনও দেবে। আমি বলেছিলাম দু’ দিন ঠিক আছে, কিন্তু তার মধ্যেই ইন্টারভিউ হলে ভালো হয়। তাহলে আমি আগের দিন সকালে পৌঁছে, পরদিন ইন্টার্ভিউ দিয়ে আবার সন্ধের বাসে বেরিয়ে যাব। উত্তরে যখন ওঁরা জানালেন ইন্টার্ভিউ রবিবার হলে কি আমার আপত্তি হবে? তাহলে শনিবার পৌঁছে, রবিবার ইন্টার্ভিউ দিয়ে সেদিনই ফিরতে পারব। সানন্দে রাজি হয়েছিলাম। তা হলে আমার ছুটি খরচ হবে না।
চারজনে দুটো গাড়িতে এসেছেন। হেডমাস্টারের গাড়িতে আমি, বাকি তিনজন অন্য গাড়িটায় উঠলেন।
চলতে চলতে বললেন, যদিও স্কুলের নামটা এই শহরেরই নামে, আদতে কিন্তু স্কুলটা এখানে নয়। এখান থেকে প্রায় বাইশ কিলোমিটার দূরে। সেটা অন্য গ্রাম। রাস্তা ভালো — আধঘণ্টা থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিটে পৌঁছে যাব।
ছোট্ট গ্রাম। বরং বসতি বলাই ভালো। পাহাড়ি রাস্তা এঁকেবেঁকে উঠেছে স্কুলের গেট অবধি, তার আগে গোটা দশ-বারো বাড়ি। অবাক হয়ে দেখলাম, এ আমার পরিচিত ভারতীয় পাহাড়ি গ্রাম নয়। এ যেন ছবিতে আঁকা একটা ইউরোপীয় গ্রাম তুলে আনা হয়েছে! যেমন বাড়িঘরের গঠনসৌষ্ঠব, তেমনই সুন্দর বাগানের পরিচর্যা। আমার অব্যক্ত প্রশ্নের উত্তর দিলেন হেডমাস্টার। বললেন, “এখানে আসলে আমাদের স্কুলের সঙ্গে যুক্ত আছেন, বা ছিলেন, এমন মানুষই থাকেন। যেমন রিটায়ার্ড টিচার, বা সিনিয়র নন-টিচিং স্টাফ। তাই বাড়িগুলো ব্যতিক্রমী। চলুন, স্কুলের ভিতরটা দেখে বুঝবেন।”
স্কুল দেখে আমি সত্যিই চমৎকৃত হয়ে গেলাম। বিশাল মাঠ, আর গাছের সারি, সত্যিই একেবারে ইংল্যান্ডের মেডো যেন। তার মধ্যে পুকুর, দিঘী, বাগান। ছাত্রদের হস্টেল, টিচারদের কোয়ার্টার, সবই যেন গল্পের বইয়ের ছবি। দেশ বিদেশের নানা বোর্ডিং স্কুল দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে, কিন্তু সত্যি বলতে কী, এখানকার আবহে যেন আরও কিছু আছে, যা সঙ্গে সঙ্গে আকর্ষণ করে।
গাড়ি থামল টিচারদের কোয়ার্টারের কমপ্লেক্সের ভিতরে হেডমাস্টারের বাড়ির সামনে। অন্য গাড়িটাও পিছনে এসেছে। সিটে রাখা আমার ছোটো সুটকেসটা নিতে যাচ্ছি, হেডমাস্টার বাধা দিলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে এল ভেতর থেকে উর্দিপরা বেয়ারা, সকলকে সেলাম করে হেডমাস্টারের অল্প মস্তকান্দোলনের নির্দেশেই বোধহয় বাক্সটা নিয়ে ভেতরে গেল।
“ইট ইজ মাই প্লেজার টু হোস্ট ইউ ফর ইওর স্টে।” হেডমাস্টার বাড়ির দিকে হাত দেখালেন, দেখলাম ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন একজন মহিলা, আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, “হেলো।”
“সুমেধা, মাই ওয়াইফ,” পরিচয় করিয়ে দিলেন হেডমাস্টার। আবার করমর্দন, আবার স্যানিটাইজার। হেডমাস্টার বললেন, “আপনার থাকার ব্যবস্থা আমার বাড়িতে, কিন্তু খাওয়ার ব্যবস্থা টিচার্স ডাইনিং রুমে। ছুটির দিন না হলে টিচাররা ওখানেই খাই, তাহলে নিজেদের মধ্যে আলোচনা, কথাবার্তার সময় পাওয়া যায় বেশি। আজ ছুটির দিন হওয়া সত্ত্বেও আমরা ওখানেই খাবার ব্যবস্থা করেছি, যাতে আপনি সবটার একটা আন্দাজ পান।” তারপরে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “হ্যাভিং সেড দ্যাট, মাই ওয়াইফ হ্যাজ ইনসিস্টেড দ্যাট ইফ ইউ আর স্টেইং ইন আওয়ার হোম, ইউ মাস্ট হ্যাভ সাম অফ দ্য মিলস উইথ আস। তাই, আপনাকে দুটো ব্রেকফাস্ট আমাদের সঙ্গে এ বাড়িতেই খেতে হবে।”
আমি এর সদুত্তর দেবার আগেই ইংরেজির হেড সোমস মাথা নিচু করে সুমেধাকে অভিবাদন জানিয়ে বললেন, “এবং সেই সুবাদে আজ আমাদেরও সৌভাগ্য হয়েছে ম্যামের অসাধারণ ব্রেকফাস্ট খেতে পাবার।” বলে আমাকে বললেন, “তবে ভাববেন না উনি আপনি এসেছেন বলেই আমাদের ডেকেছেন। আমরা প্রায়ই নিমন্ত্রিত হই।”
‘আমি নিজেকে ভাগ্যবান এবং ধন্য মনে করছি,’ জাতীয় কথা বলতে বলতে থমকে গেলাম। এটা হেডমাস্টারের কোয়ার্টার? এ তো পশ্চিমী সিনেমার বিলিওনেয়ারের বাড়ি! বাপরে! কথা বলতে বলতে আমরা একটা বসার ঘরের মধ্যে ঢুকেছি। বাড়িটা আদ্যিকালের হলেও আজকালকার ওপেন প্ল্যান। বসার ঘরের ওদিকে একটা সাইডবোর্ডের ওপর দিয়ে, কিছু ইনডোর গাছগাছালির ওপারে খাবার ঘরের কিছুটা দেখা যাচ্ছে। বসার ঘরের জানলায় পর্দা টানা, কিন্তু খাবার ঘরের জানলা খোলা, দেখে মনে হয় ফ্রেঞ্চ উইন্ডো। তার ভিতরে কী, দেখা যাচ্ছে না।
হেডমাস্টার বললেন, “জার্নির পরে ব্রেকফাস্টের আগে নিশ্চয়ই ফ্রেশ হয়ে নিতে চাইবেন? আমরা অপেক্ষা করব। সুমেধা আপনাকে দেখিয়ে দেবে… সুমেধা?”
“আসুন, প্লিজ…” বললেন সুমেধা। আমি বাকিদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওঁর পেছনে রওয়ানা দিলাম। বসার ঘরের পরে আর একটা বসার ঘর — এটা আর একটু প্রাইভেট। সেটা পার করে প্রথম দেওয়াল আর দরজা। তারপরে বাড়ির ভেতর দিকটা। তাক লেগে যাবার মতো। বললাম, “হোয়াট আ বিউটিফুল হাউস।”
সুমেধা বললেন, “সত্যিই। আপনি আসলে দেখবেন, অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টারের কোয়ার্টারও প্রায় এতটাই বড়ো, এবং সুন্দর। আর থাকলে তো আপনিই তিন বছর পরে হেডমাস্টার হবেন। তখন এই বাড়িই আপনার হবে। এবং অনেক দিনের জন্য — এখানে রিটায়ারমেন্ট পঁয়ষট্টিতে। যার অর্থ আপনি — কত, বছর বাইশ…? — এই বাড়িতে থাকবেন” লম্বা করিডোর দিয়ে হেঁটে এসে একটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উনি প্রশ্নটা করে আমার দিকে তাকালেন।
মহিলা আমার বয়স জানার চেষ্টা করছেন। আমি কি এক কথায় বলে দেব? না। কথার খেলায় আমিও দড়। মাথাটা ঝুঁকিয়ে বললাম, “ম্যাম, এই অসাধারণ স্কুলের হেডশিপ আমার কপালে থাকলে আমি পাঁচ বছরের জন্যেও এই বাড়িতে থাকতে পেলে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করব।”
সুমেধা কথা না বাড়িয়ে কোনটা বাথরুমের দরজা, কোন সুইচ বাজালে গৃহকর্মীরা আসবে এরকম প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে বিদায় হলেন। আমিও সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি তৈরি হতে শুরু করলাম। দাঁত মাজা, দাড়ি কামানো, স্নান করা — সবই বাকি।
সমস্যা হলো পোশাক পরতে গিয়ে। সৌমিকদা বলে দিয়েছিল, তিনটে সুট নিয়ে যাস। আমিই অবাক হয়ে বলেছিলাম, দু-দিনের জন্য কেউ তিনটে সুট নেয়? আমি কি রাজা-গজা নাকি? ভেবেছিলাম, ইন্টার্ভিউয়ের জন্য একটা আর যদি আগের দিন কোনও ফর্মাল ডিনার থাকে তাহলে আর একটা — সবসুদ্ধ দুটোই যথেষ্ট। এখন দেখছি এরা সকাল থেকে সবাই সুট পরে রয়েছে। তাহলে তো আমারও সুট-টাই পরেই ব্রেকফাস্টে যাওয়া উচিত। তাহলে একটাই সুট পরে আজ পুরোটা আর কাল অর্ধেক দিন — আমার ইন্টার্ভিউ তো দুপুরে — কাটাতে হবে?
সুট পরব না। আমি বাইরে থেকে এসেছি। আমার পক্ষে একরাশ সুট নিয়ে একরাতের সফরে আসা সম্ভব না হওয়াই স্বাভাবিক। সবচেয়ে বড়ো কথা — বিদ্যাসাগরের মতো আমার পরিচয় যদি আমার পোশাকে হয়, তবে সত্যিই আমি এই চাকরি চাই না।
সাত-পাঁচ ভেবে সুটকেস খুলে দুটো সুট-ই বের করে আলমারিতে ঝুলিয়ে কেবল শার্ট-প্যান্ট পরেই ব্রেকফাস্টে গেলাম। গিয়ে দেখি অন্যরাও সুটের ভারমুক্ত হয়ে বসেছেন। আমাকে দেখে সকলে উঠে দাঁড়ালেন। প্রীতপাল সিং প্রায় নিশ্চিন্দির সুরে বললেন, “যাক, আপনি দেরি করেন না। আমরা ভাবছিলাম — আপনাকে যাবার আগেই তাড়া দেওয়া উচিত ছিল কি না।”
আমি বললাম, “আপনারা ভুলে গেছেন, যে আমি সারা রাত বাস জার্নি করে এসেছি। সকালে খাইনি কিছু। আর তাছাড়া এসেই শুনলাম আপনারা সকলে ম্যামের ব্রেকফাস্টের সুখ্যাতি করছেন। সুতরাং দেরি করি কী করে?”
প্রাতরাশ সেরে — সত্যিই মিসেস সুমেধা চিত্রেশের খাবারের স্বাদ অতুলনীয় — বেরোলাম স্কুল পরিদর্শনে।
হেডমাস্টারের কথায় প্রাথমিক পরিদর্শন। এখন ওপর ওপর দেখেশুনে নিতে হবে। যদি চাকরি পাই, তাহলে আরও ভালো করে দেখাবেন।
সঙ্গে চললেন সকলেই। এঁরাই স্কুলের সিনিয়র শিক্ষক, শিক্ষিকা। এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড ছাড়া সকলেই উপস্থিত। উনি চিকিৎসা করাতে গেছেন স্বদেশে। স্বাস্থ্য ভালো নয় বলেই কাজ ছেড়ে চলে যাবেন। ওই পদের জন্যই আমার কাল ইন্টার্ভিউ।
প্রাথমিক দেখাতেই লাগল লাঞ্চ অবধি। বিরাট ক্যাম্পাস, তার এ-কোনে ও-কোনে ছড়ানো ছাত্রদের নানা কর্মক্ষেত্র। এইখানে জিমনেশিয়াম, তো ও-ও-ও-ওইখানে হর্স রাইডিং, আবার বহু চলে যেতে হবে কোন কর্মশালায় — যেখানে ছাত্রদের হাতের কাজ শেখানো হয়। এ ছাড়া ছাড়া একাধিক ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, আর ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড-এর মাঠ। গাড়ি বিনা, শুধু পায়ে হেঁটে এ রাজত্ব পরিদর্শন সম্ভব নয়। হেডমাস্টার আমাকে দেখালেন, এই জন্যই উনি ব্যাটারিচালিত গাড়ির ব্যবস্থা করেছেন। ছুটির দিন বলে আজ সেগুলি মেইন্টেনেন্স হচ্ছে, তাই উনি নিজের গাড়ি বের করেছেন।
শিক্ষকদের ডাইনিং রুমে দ্বিপ্রাহরিক ভোজনশেষে গেলাম অভ্যন্তর পরিদর্শনে। লাইব্রেরিতে আরও কয়েকজন সিনিয়র শিক্ষক শিক্ষিকা উপস্থিত, সেখান থেকে বিভিন্ন বিভাগীয় লাইব্রেরি এবং ল্যাবরেটরি, ইত্যাদি শেষ করতে করতে বিকেল। ততক্ষণে আমি বেশ ক্লান্ত। ভাগ্যিস সুট-টা পরিনি!
হেডমাস্টারের বাড়িতে ফিরলাম কেবল আমরা দুজনই। বাকিরা অনুমতি এবং বিদায় নিয়ে গেলেন যে যার বাড়ি। বলে গেলেন, ডিনারে দেখা হবে।
চা খেতে খেতে আলোক আর সুমেধার কাছে স্কুল সম্বন্ধে আরও কিছু জানলাম, তারপরে দম্পতি আমাকে অনুমতি দিলেন, ঘরে গিয়ে বিশ্রাম করার। ডিনার রাত আটটায়, সেখানে সুমেধাও যাবেন, এবং আমি যেহেতু গেস্ট অফ অনার, তাই আমার ওখানে আটটা বাজার দু’মিনিট আগে পৌঁছলেই হবে। বাড়ি থেকে আমরা বেরোব আটটা বাজতে দশে।
সুমেধা বললেন, “সন্ধে ছটায় উনি অল্প ড্রিঙ্ক করেন। আপনি চাইলে…”
মদিরারসে আমার কোনও উৎসাহ নেই বলে বিদায় নিলাম।
৩
আর একবার স্নান করতে হলো সারা দিনের ক্লান্তি দূর করতে। পাজামা পরে খাটে লম্বা হয়ে ভাবছি অভিজ্ঞতার কথা, এমন সময় মনে হলো অনেকক্ষণ ধরে একটা গান যেন গুনগুন করছি? গানটার কথাগুলো মাথায় আসতেই মনে হলো, আসলে কেবল এক্ষুনি না, দুপুর থেকেই গানটা মাথায় ঘুরছে। গাঁদাফুল সম্বন্ধে। কথাগুলো মনে করে গানটা গাইবার চেষ্টা করলাম। বাংলা আধুনিক গানে আমার কখনোই খুব ইন্টারেস্ট ছিল না, তাই ‘হলুদ গাঁদার ফুল দে এনে দে…’ আর তারপরে একটা কী ঝুমকোলতা আর কে যেন চুল বাঁধবে না — এইটুকু বাদ দিয়ে আর কিছুই মনে পড়ল না। কেন এই গান মাথায় ঘুরছে সারা দিন? এটা তো আমার প্রিয় গানও নয় — বস্তুত গানের কথাগুলোও জানি না ঠিক করে।
কিন্তু যতই চেষ্টা করি, না পারি গানটা বের করতে, না পারি বুঝতে কেন গানের ওইটুকু মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।
সন্ধে ছ-টার কয়েক মিনিট পরে হেডমাস্টারকে সুরাপাত্র হাতে ভেতরের ড্রইং রুমে পেলাম। অনুমতি নিয়ে ওঁর সঙ্গে বসলাম। আমার জন্য কফি এল, সুরাপাত্র খালি হতে শুরু করল, এবং একটুক্ষণের মধ্যেই হেডমাস্টারের জিভ ঢিলে হয়ে গেল, আগামীকালের ইন্টার্ভিউয়ে আমাকে কী কী জিজ্ঞেস করা হবে এবং তার কোন উত্তরটা আমার দেওয়া উচিত বলতে শুরু করলেন।
আমি থামিয়ে বললাম, স্যার, এটা কি আপনার উচিত হচ্ছে? আপনি কাল নিশ্চয়ই ইন্টার্ভিউ বোর্ডে থাকবেন। সেই বোর্ডের ক্যান্ডিডেটকে এ ভাবে সাহায্য করছেন?
হেডমাস্টার মিষ্টি হেসে বললেন, আহ, দেয়ার ইউ আর মিস্টেকেন। আই উইল নট বি ইন দ্য বোর্ড টুমরো।
এটাও আশ্চর্য। তাই মেনে নিয়ে ভাবলাম সবচেয়ে বড়ো জিনিসটা জেনে নেওয়া ভালো। বললাম, একটা কথা জানতে চাই, যদি আপনি অনুমতি করেন।
উনি ঘাড় নেড়ে অনুমতি দিলে বললাম, এরকম একটা প্রতিষ্ঠানে হেড চলে গেলে সাধারণত অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড-ই দায়িত্ব নেন। আপনাদের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড আপনার আগেই চলে যাবেন, কিন্তু সিনিয়রদের মধ্যে এমন কেউ কি নেই, যিনি দায়িত্ব নিতে পারেন? বাইরের লোক কেন চাইছেন আপনারা?
উনি বুঝেছি, গোছের মাথা নাড়লেন। বললেন, জানেন, সত্যিই নেই। অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডের পরেই যিনি সিনিয়র টিচার, তিনি আর্ট টিচার। অভিষেক। লম্বা মতন, ঢিলে চশমা — লাল জামা আর নীল জিনস পরে এসেছিলেন লাঞ্চে।
মনে আছে। লাঞ্চে কেউই সুট পরে আসেননি, কিন্তু ওঁকে দেখেই একটু নিশ্চিন্ত বোধ করেছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই অবশ্য বুঝেছিলাম, যে অভিষেকের মধ্যে বিদ্রোহী মনোভাব নেই, আছে কেবল খ্যাপাটে-পনা। টিচাররা তো ধর্তব্যের মধ্যেই আনেন না, ছাত্ররাও বোধহয় খুব মানে না।
হেডমাস্টার বলে চলেছেন, এ বাদে আর কারওর অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার হবার মতো অভিজ্ঞতা নেই, এবং যে দু জন এক-দেড় বছরের মধ্যে অ্যাসিস্টান্ট হবার সিনিয়রিটি পাবেন, তাঁরা আবার কেউই আগামী তিন বছরের মধ্যে হেড হবার মতো বাড়তি অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবেন না। ফলে আমাদের বাইরে থেকে কাউকে আনতেই হত। তাই…
বুঝলাম। কিন্তু ওঁর কথা এখনও শেষ হয়নি।
বলছেন, আমরা অনেক আলোচনা করে ঠিক করি, যে গত সাতজন হেডমাস্টার স্কুলেরই টিচার ছিলেন, এবারে বাইরের লোক আনা হোক না? আপনার নাম আমিই দিই। এডুকেশন, এক্সপিরিয়েন্স, মানসিকতা — সব দিক থেকেই আইডিয়াল হবেন, এ-ই আমার বিশ্বাস।
বললাম, এবং সেইজন্যই কি আপনি ইন্টার্ভিউ বোর্ডে থাকছেন না?
উনি হেসে মাথা নাড়লেন। না। আমার নিকটাত্মীয় আপনার কম্পিটিটর। তাই।
এবার আমি সত্যিই অবাক হলাম। নিকটাত্মীয়র চেয়ে বেশি আমাকে চাইছেন অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডের পোস্টে? আশ্চর্য! উনি আমার মুখের ভাব দেখলেন না। বলতে থাকলেন, নিকটাত্মীয় আমার বড়ো মেয়ে। ও-ও এই স্কুলের না। ছাত্রীও না, শিক্ষকও না। এখান থেকে কিছু দূরে আর একটা স্কুলের সিনিয়র টিচার।
বাবা মেয়ের মধ্যে কোনও সমস্যা? থাক, এত কথায় আমার কী কাজ?
ক্রমশঃ