সদ্য দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রকের একটি ঘোষণায় কিঞ্চিৎ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
ডাক্তারি পঠনপাঠন সংক্রান্ত ঘোষণা – ডাক্তারির ক্ষেত্রে চিকিৎসকের গাফিলতি ও অর্থলিপ্সা, এই দুই ব্যাপার নিয়ে সার্বিক সহমত্য বর্তমান, এবং এই দুই বিষয় বাদে, সাধারণত, কেউই বিচলিত হন না – সেকারণেই চাঞ্চল্য ‘কিঞ্চিৎ’-এ সীমাবদ্ধ। নতুবা, এমন ঘোষণা রীতিমতো বড়সড় শোরগোলের সৃষ্টি করতে পারত। অন্তত, করাটা উচিত ছিল।
ঘোষণাটি কী? স্বাস্থ্যমন্ত্রক ন্যাশনাল মেডিকেল কাউন্সিল-কে এই মর্মে বার্তা পাঠিয়েছেন, যাতে পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট মেডিকেল এন্ট্রান্স পরীক্ষার যোগ্যতামান কমিয়ে শূন্য পার্সেন্টাইলে নামিয়ে আনা হয়। পূর্বতন মেডিকেল কাউন্সিল, যা নির্বাচনের মাধ্যমে তৈরি হতো, তাকে সরিয়ে বর্তমানের এই মেডিকেল কমিশন, যেখানে অধিকাংশ সদস্যই সরকার কর্তৃক নির্বাচিত, সুতরাং, প্রত্যাশিতভাবেই, সরকারের বশংবদ – অতএব, এই নির্দেশ যে যথাবিহিত গুরুত্বসহকারে পালিত হবে, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।
গত কয়েক বছরের মধ্যে একাধিকবার এই যোগ্যতামান কমিয়ে আনা হয়েছে। তখন যোগ্যতামান কমানোর চাইতে সংরক্ষিত শ্রেণীর যোগ্যতামান কেন বেশি কমানো হলো, এই প্রশ্নের বেশি বড় কোনও আপত্তির ঢেউ দেখা যায়নি। এবারে সরকারবাহাদুর ল্যাঠা চুকিয়ে দিলেন। নির্বিকল্প সাম্য প্রতিষ্ঠিত হলো। শূন্য পার্সেন্টাইল-ই যথেষ্ঠ।
অনেকে বিচলিত হচ্ছেন এই ভেবে, যে, পরীক্ষায় শূন্য পাওয়া ছাত্রছাত্রীরাও এরপর এমডি/এমএস করবে! ঠিকই, কিন্তু তাঁদের আশ্বস্ত করে জানাই, ব্যাপারটার ভয়াবহতা আরেকটু বেশি। সকল পরীক্ষার্থীর পরীক্ষায় প্রাপ্ত মার্কস বেশি থেকে কম এই ক্রমানুসারে সাজিয়ে কষা হয় পার্সেন্টাইল-এর হিসেব। এই হিসেব অনুসারে নব্বই(তম) পার্সেন্টাইল-এর অর্থ এমন নয়, যে, সংশ্লিষ্ট ছাত্র/ছাত্রী পরীক্ষায় নব্বই শতাংশ মার্কস পেয়েছেন – এর অর্থ, নব্বই শতাংশ পরীক্ষার্থীই সংশ্লিষ্ট ছাত্র/ছাত্রীর চাইতে কম মার্কস পেয়েছেন। জিরো পার্সেন্টাইল-এর অর্থ, কেউই তাঁর চাইতে কম মার্কস পেতে সক্ষম হননি। পোস্টগ্র্যাজুয়েট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় যেহেতু ভুল উত্তরে চড়াহারে নেগেটিভ মার্কিং-এর বন্দোবস্ত থাকে, সেহেতু সেরকম সেরকম পরীক্ষার্থীর প্রাপ্ত মার্কস শূন্যের নিচেও নেমে যেতে পারে। এবছর যেমন, একেবারে নিচে রয়েছেন যিনি – জিরো পার্সেন্টাইল – তাঁর প্রাপ্ত মার্কস মাইনাস চল্লিশ। সরকারি নির্দেশানুসারে তাঁর সামনেও খুলে যাচ্ছে বিশেষজ্ঞ হওয়ার দরজা।
এমন নির্দেশের তাৎপর্য নিয়ে বিশদ আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। ন্যাশনাল মেডিকেল কমিশনের রাজত্বে চাইতেই মেডিকেল কলেজ তৈরির ছাড়পত্র মিলছে – সরকারি ও বেসরকারি, দুই ক্ষেত্রেই। প্রায় কোনও ক্ষেত্রেই পরিকাঠামোর দিকটা খুঁটিয়ে দেখা হচ্ছে না। সরকারের নতুন নতুন মেডিকেল কলেজ খোলার তাড়নায়, অনেক ক্ষেত্রেই যথেষ্ট পরিমাণ অধ্যাপক তো দূর, বাড়িঘরদোরই ঠিকঠাক নেই – হাসপাতালটিও মেডিকেল শিক্ষার উপযুক্ত মানের নয় – কিন্তু ছাত্রছাত্রী ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। বেসরকারি ক্ষেত্রে পরিস্থিতি তো আরও সরেস। স্বাভাবিকভাবেই, এই পরিস্থিতিতে ডাক্তারি শিক্ষার যে প্রত্যাশিত গুণগত মান, তা ব্যাহত হচ্ছে। পরিমাণ বাড়ানোর নামে মান-এর সঙ্গে সাঙ্ঘাতিক আপোস করা হচ্ছে – বা বলা ভালো, মান ব্যাপারটাকে ইদানীং ভুলেই যাওয়া গিয়েছে। আর, এই রাজ্যে, বর্তমান সময়ে, রাজনৈতিক দাদাগিরি ও দুর্নীতির চোটে, মান-রক্ষার যেটুকু সম্ভাবনা ছিল, সেসব জলে ভাসিয়ে দেওয়া গিয়েছে।
সঙ্কট শুধু এমবিবিএস পঠনপাঠনের স্তরে আটকে নেই। ন্যাশনাল মেডিকেল কমিশনের হুলিয়াক্রমে কলেজগুলোতে – পরিকাঠামো যেমনই হোক, অধ্যাপকের অভাব যে মাত্রারই হোক না কেন – এমডি/এমএস পড়াতে চাওয়ার ঢল নেমেছে। সুতরাং, সরকারি ও বেসরকারি, উভয় ক্ষেত্রেই এমডি/এমএস-এর আসনসংখ্যা হুলিয়ে বেড়েছে, বেড়েই চলেছে।
একদিকে এই নতুন ব্যবস্থার ফসল নব্য-চিকিৎসককুল, আরেকদিকে পোস্ট-গ্রাজুয়েট-এ অজস্র আসন – মেডিকেল কলেজগুলোর তরফে ছাত্রছাত্রী পাওয়ার আকুল চাহিদার সাপেক্ষে যোগ্যতামান পেরোতে পারেন, এমন ছাত্রছাত্রীর জোগান যে কম হবে, এ তো বলা-ই বাহুল্য। সুতরাং, চাহিদা-জোগানের মধ্যে সাযুজ্য আনার স্বার্থে, সরকারবাহাদুর যোগ্যতামান নামিয়ে আনলেন। না, অন্তত এই ঘোষণা-অনুসারে, যোগ্যতামান ব্যাপারটাই তুলে দিলেন। পরীক্ষায় বসলেই ভর্তি হতে পারার সুযোগ, ব্যাস!
মান-এর তোয়াক্কা না করে ঢালাও পরিমাণে উৎপাদনের কথা বললেই আমাদের সস্তার ‘চাইনিজ মাল’-এর কথা মনে পড়ে। সে ‘মাল’ ব্যবহার-এর অভিজ্ঞতা আমাদের সকলেরই অল্পবিস্তর আছে। অনেক সময়েই সে জিনিস ব্যবহারের অযোগ্য, কিন্তু মাঝেমধ্যে কয়েকখানা দিব্যি টিকে যায়। ডাক্তারির ক্ষেত্রে অনুরূপ অনুষঙ্গ ব্যবহার করতে হওয়াটা দুর্ভাগ্যজনক, কিন্তু এক্ষেত্রে উপায়ই বা কী! এই ব্যবস্থায় উৎপাদিত ডাক্তার, কিছু কিছু ক্ষেত্রে, মূলত সংশ্লিষ্ট ছাত্র/ছাত্রী-র ব্যক্তিগত উৎকর্ষের কারণেই, সুচিকিৎসক হবেন – কিন্তু সার্বিকভাবে চিকিৎসকের গুণগত মান নির্ভরযোগ্য হবে না, হতে পারে না।
আর, সস্তার ‘চাইনিজ মাল’-এর ক্ষেত্রে, যেটি খারাপ বেরোয়, তা দুদিনেই খারাপ হয়ে যায় ও ফেলে দিতে হয়। ডাক্তারির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের গুণমান যেমনই হোক, আদতে তিনি চিকিৎসার লাইসেন্স পান সারাজীবনের জন্যই। অতএব…
আদতে যা হবে – যা হতে চলেছে – উজ্জ্বল ছাত্রছাত্রীরা এই অসম্পূর্ণ ট্রেনিং-এ তুষ্ট না থেকে প্রথম বিশ্বের দিকে দৌড়াবেন সঠিক ট্রেনিং-এর আশায় – ট্রেনিং-এর পর অধিকাংশই রয়ে যাবেন প্রথম বিশ্বের দেশে, আর যাঁরা ফিরবেন, তাঁরা যুক্ত হবেন পাঁচতারা হাসপাতালে – আর মাইনাস তিরিশ-চল্লিশ মানের যাঁরা পড়ে থাকবেন, তাঁরা নিরুপায় (কেননা, এমবিবিএস বা এমডি/এমএস, কোনও পর্যায়েই তাঁদের সামনে ঠিকঠাক ট্রেনিং-এর সুযোগ ঘটেনি) হয়ে যোগ দেবেন সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় (অবশ্য সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা বলে তখনও যদি কিছুর অস্তিত্ব থাকে, তবে)।
এরপরও বলবেন, সরকারি এই নির্দেশে আপনার বিচলিত হওয়ার মতো কিছু নেই?