বেশ কয়েকটা বড় বড় আন্দোলন দেখেছি, কয়েকটাতে অংশগ্রহণও করেছি। কিন্তু অভয়ার বিচারের দাবিতে যে আন্দোলন নয় আগস্ট ২০২৪ থেকে শুরু হয়েছে তার মত বড় আন্দোলন যাতে মানুষের বিপুল অংশগ্রহণ এমনটা দেখিনি আগে।
৯ আগস্ট নৈহাটিতে স্বাস্থ্য শিক্ষা নির্মাণের ক্লিনিকে ছিলাম। খবর পেলাম আর জি কর মেডিকেল কলেজের চেস্ট ডিপার্টমেন্টের সেমিনার রুমে একটি মৃতদেহ পাওয়া গেছে। আর কলেজ কর্তৃপক্ষ একেকবার একেক কথা বলছে।
সিনিয়র চিকিৎসকদের সাতটি সংগঠনের যৌথ মঞ্চ সংগঠন গুলির সদস্যদের আহ্বান জানালো বিকেল বেলা আরজি করে জমায়েত করতে। যেসব মেডিকেল কলেজগুলোতে যোগাযোগ আছে তাদের ছাত্র-ছাত্রীদের এবং জুনিয়র ডাক্তারদের খবর দেয়া হলো আসবার জন্য।
তারপর থেকে আন্দোলনের পথে আছি আজও। সিনিয়র ডাক্তার, জুনিয়র ডাক্তার, মেডিকেল ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে সাধারণ মানুষও।
শুরুতে আমাদের দাবি ছিল ধর্ষক হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া, যারা ধর্ষক হত্যাকারীদের আড়াল করছে তাদের অপসারণ ও শাস্তি এবং চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা।
একটা কথা বলে নেওয়া যাক। সুরক্ষা বলতে আমরা নিরাপত্তা রক্ষী, সিসি টিভি আর আলো লাগানো বুঝি না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সামনের সারির চিকিৎসা কর্মীরা আক্রান্ত হন রোগীর আত্মীয়-স্বজনদের দ্বারা। হাসপাতালে সব পাওয়া যাবে, সব চিকিৎসা হবে এই আশা নিয়ে তারা রোগীদের নিয়ে আসেন, তাদের আশা ভঙ্গ হলে ক্ষোভ আছড়ে পড়ে সামনের সারির কর্মীদের ওপর। আমরা মনে করি আমাদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা তাই রোগীর স্বাস্থ্যের অধিকারের সঙ্গে সম্পর্কিত।
এই পর্যায়ে কত মিটিং মিছিল হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। বড় কর্মসূচি গুলোর মধ্যে থেকেছে মেডিকেল কলেজগুলিতে কর্ম বিরতি ও অবস্থান মঞ্চ, লালবাজার অভিযান, স্বাস্থ্য ভবন অভিযান এবং স্বাস্থ্য ভবনে অবস্থান… এরপরে মুখ্যমন্ত্রী ও মুখ্য সচিবের সঙ্গে কথাবার্তা হয় কিছু দাবি-দাওয়া মেনে নেওয়া হয়। জুনিয়র ডাক্তাররা কাজে ফিরে যান। অথচ তাদের ওপর আক্রমণ কমে না–সাগর দত্ত মেডিকেল কলেজে সিসিইউ তে বেড নেই তাই আর আক্রান্ত হন মহিলা পিজিটি ও মহিলা ইন্টার্নরা। কোনখানে এক্সরে মেশিন খারাপ, কোনখানে এম্বুলেন্স নেই–সবের দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হতে থাকে ডাক্তারদের উপর। তারা আবার কর্ম বিরতিতে যেতে বাধ্য হন। পুজোর মুখে মানুষের অসুবিধার কথা ভেবে কর্ম বিরতি প্রত্যাহার করা হয়, শুরু করা হয় অনির্দিষ্টকালীন অনশন কর্মসূচি। ১৭ দিন অনশন চলবার পর নবান্ন সভাঘরে বৈঠক হয়। লাইভ স্ট্রিমিং-এর দৌলতে সেই সভায় কি কি হয়েছিল তা সবাই জানেন।
কিছু মানুষ প্রশ্ন তুলছেন এই আন্দোলনে কি পাওয়া গেল। পাওয়া গেল অনেক কিছুই।
১। আন্দোলনের চাপে হাইকোর্ট সুয়ো মোটো মামলা শুরু করল, তদন্তের ভার রাজ্য পুলিশের হাত থেকে নিয়ে দেওয়া হল সিবিআই এর হাতে।
২। প্রথমে আর জি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে সরাতে রাজ্য সরকার রাজি ছিল না। কিন্তু আর্থিক দুর্নীতির মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পর তাকে সরাতে বাধ্য হল রাজ্য সরকার।
৩। অপরাধীদের আড়াল করা এবং প্রমাণ লোপাটের অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে সেই কলকাতা পুলিশের প্রাক্তন কমিশনার বিনীত গোয়েল এবং ডিসি নর্থ অপসারিত হলেন।
৪। অভিযুক্তদের আড়াল করার দায়ে দোষী ডিরেক্টর অফ হেলথ সার্ভিসেস দেবাশীষ হালদার ও ডিরেক্টর অফ মেডিকেল এডুকেশন কৌস্তভ নায়েককে সরাতে বাধ্য হলো সরকার
৫। জুনিয়র ডাক্তারদের ১০ দফা দাবীর মধ্যে অধিকাংশ অন্তত কাগজে-কলমে মেনে নিতে বাধ্য হল সরকার।
৬। আর সবচেয়ে বড় পাওনা মানুষের অকুন্ঠ সমর্থন–রাত দখল অধিকার দখল এর রাত থেকে শুরু করে আন্দোলনকারীদের পাশে মানুষ ছিল লালবাজার অভিযানে, স্বাস্থ্য ভবনের অবস্থানে এবং অনশন মঞ্চে।
১লা অক্টোবর কলেজ স্কোয়ার থেকে একাডেমি অফ ফাইন আর্টস, ২ রা অক্টোবর কলেজ স্কোয়ার থেকে ধর্মতলা এবং ১৫ই অক্টোবর দ্রোহের কার্নিভাল ও দ্রোহের মানববন্ধন আলাদা করে উল্লেখের দাবি রাখে।
এই আন্দোলনের কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করা দরকার।
১। প্রথমে বলব জুনিয়র ডাক্তারদের দাবি সনদের কথা। এর আগে ১৯৮৩ সালে এবং ১৯৮৭ সালে অল বেঙ্গল জুনিয়র ডাক্তার ফেডারেশনের ডাকে যে আন্দোলন চলেছিল তার অধিকাংশ দাবি মানুষের স্বার্থে হলেও তাতে ভাতা বৃদ্ধির দাবিও ছিল। এবারের আন্দোলনে জুনিয়াররা নিজেদের জন্য কিছু চান নি।, না ভাতা বৃদ্ধি, না কাজের সময় কমানো। প্রথম দাবি অভয়ার ন্যায় বিচারের দাবি আর বাকি দাবিগুলো আসলে আরো অভয়াদের যাতে প্রাণ হারাতে না হয় সেই সব দাবি–স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পরিকাঠামো উন্নয়নের দাবি, স্বাস্থ্যক্ষেত্রকে দুর্নীতিমুক্ত করবার দাবি।
২। এবার আসি সিনিয়র ডাক্তারদের ভূমিকার কথায়। সিনিয়র ডাক্তারদের পাঁচটি সংগঠন– অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিস ডক্টরস, ডক্টরস ফর ডেমোক্রেসি, হেলথ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন, শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ এবং ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস ফোরাম ১৯১৭ থেকে একসঙ্গে কাজ করে চলেছে। ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষের একসঙ্গে পেশার স্বার্থে কাজ করার নিদর্শন কম। এই আন্দোলনে তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে প্রদেশ কংগ্রেস মেডিক্যাল সেল এবং ডক্টরস ফর পেশেন্টস বা ডোপা।
১৯৮৩ র আন্দোলনে সিনিয়র ডাক্তারদের একটা অংশ জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনের পাশে ছিলেন। এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই সরকারি ডাক্তারদের তৎকালীন একমাত্র সংগঠন হেলথ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনে ভাঙ্গন ধরে গঠিত হয় অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিস ডক্টরস। ১৯৮৭ সালের আন্দোলনে সিনিয়র ডাক্তারদের একটা অংশ আন্দোলনের সমর্থনে ছিলেন, অন্য অংশ বিরোধিতায়। এইবারে কিন্তু শাসক দলের গুটিকয়েক ধামাধারী ছাড়া সমস্ত চিকিৎসক আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন। জুনিয়র ডাক্তাররা ৯ আগস্ট থেকে কর্ম বিরতিতে যান প্রায় এক মাস। ডাক্তাররা কর্মবিরতি করলে রোগী পরিষেবা পান না, এই সুযোগে মানুষকে ডাক্তারদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে পারে শাসক দল। এবার কর্ম বিরতির পুরোটা সময় অতিরিক্ত অনেকটা কাজ করে পরিষেবা চালু রাখেন। আউটডোর, ইনডোর, ইমার্জেন্সি চালু থাকে। শাসক দলের পক্ষে তেমনটা করা সম্ভব হয় না। তাছাড়াও সিনিয়র ডাক্তারদের সংগঠনগুলো অর্থ সংগ্রহ করে ময়দানের লড়াই এবং আইনের লড়াই এ জুনিয়রদের সাহায্য করার জন্য। মিটিং মিছিল, স্বাস্থ্য ভবনের অবস্থান, অনশন মঞ্চ সব জায়গায় সিনিয়র চিকিৎসকদের এমনকি অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের অংশগ্রহণ ছিল দেখবার মতো।
৩। অল বেঙ্গল জুনিয়র ডাক্তার ফেডারেশনের আন্দোলনের সময় সরকারি মেডিকেল কলেজ ছিল সাতটা বেসরকারি কোন মেডিকেল কলেজ ছিল না। এখন সংখ্যাটা সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে ৩৬। আন্দোলনের সিদ্ধান্তগুলো কিভাবে আমাদের জুনিয়ররা নেয় সে ব্যাপারটা জানা দরকার। কোন সমস্যা নিয়ে প্রথমে আলোচনা হয় একটি মেডিকেল কলেজের ছাত্র ও জুনিয়র ডাক্তারদের জেনারেল বডি মিটিং এ। সেখান থেকে প্রতিনিধিরা জান কেন্দ্রীয় মিটিং এ, যার নাম তাঁরা দিয়েছেন প্যান জিবি। প্যান জিবি-তে গৃহীত সিদ্ধান্ত আবার কলেজ গুলির জিবি,-তে রেটিফাই করে নেওয়া হয়।। এই প্রক্রিয়ায় সময় লাগে বটে, ঘন্টার পর ঘন্টা মিটিং চলে, কিন্তু অংশগ্রহণ অনেক ভালো হয়।
৪। জনসাধারণের অংশগ্রহণ নিয়ে এবার বলবো। আন্দোলনের শুরু থেকেই মানুষ চিকিৎসকদের সঙ্গে ছিলেন। মনে পড়ে ঘটনার তিনদিন পর ১২ ই আগস্ট আমরা যখন আরজি কর মেডিকেল কলেজের সামনে পথসভা করছি তখন বাগবাজারের একটি স্কুল থেকে স্কুল ইউনিফর্ম পড়া বালিকারা তাদের শিক্ষিকাদের সঙ্গে মিছিল করে এলেন আরজি করে। কেবল কলকাতার স্কুল কলেজ নয়, জেলার স্কুল কলেজগুলোতেও একই চিত্র দেখা গেল। এই আন্দোলনে বড় অংশগ্রহণ মহিলাদের। মুখ্যমন্ত্রী নারী চিকিৎসকদের সুরক্ষার জন্য তাদের রাতে ডিউটি বারণ করে এক নির্দেশিকা জারি করেন। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা বটেই সঙ্গে সঙ্গে মহিলারাও ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তারই ফলশ্রুতিতে রাত দখল রাস্তা দখলের কর্মসূচি। শুরুতে কর্মসূচি হওয়ার কথা ছিল যাদবপুর ৮ বি বাস স্ট্যান্ড, একাডেমি অফ ফাইন আর্টস ও কলেজ স্ট্রিটে। শেষে রাজ্যে ৫০০র ও বেশি জায়গায়, রাজ্যের বাইরে এমনকি দেশের বাইরে বিভিন্ন জায়গায় রাত দখলের কর্মসূচি পালিত হয় স্বাধীনতা দিবসের আগের রাতে। আমরা দেখলাম শাসক দলের আক্রমণ বা পুলিশি নিপীড়নে মানুষ দমিত হচ্ছেন না, বরং বেশি বেশি করে মানুষ সংগঠিত হচ্ছেন, গড়ে তুলছেন নাগরিক মঞ্চ, যৌথ প্রতিবাদী মঞ্চ…
অভয়ার সুবিচারের দাবিতে মানুষ আরো অনেক রাস্তা চলতে তৈরি আছেন। তাদের আকাঙ্ক্ষা অন্য প্রতিবাদী মানুষদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার। এই আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান জানিয়ে জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টরস উদ্যোগ নিয়েছে একটি সমন্বয় গঠনের। ২৮ অক্টোবর গঠিত হয়েছে অভয়া মঞ্চ, প্রথম দিন অংশগ্রহণকারী সংগঠনগুলি সংখ্যা ছিল মোটামুটি ৮০। ২৯ অক্টোবর ১০০ ছাড়িয়ে গেল সংখ্যা, প্রতিদিন নতুন নতুন সংগঠন আগ্রহ প্রকাশ করছেন অভয়া মঞ্চে যুক্ত হওয়ার।
গঠনের পর অভয়া মঞ্চের প্রথম আহ্বান ছিল ৩০ অক্টোবর ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টরস ফ্রন্ট এর ডাকা মেডিকেল কাউন্সিল থেকে সিজিও কমপ্লেক্স অভিযান সফল করার। একটি জঙ্গি মিছিল সল্ট লেকের রাস্তা দিয়ে এগিয়ে গেছে। পরের কর্মসূচি সুপ্রিম কোর্টের পরবর্তী শুনানির আগের দিন ৪ নভেম্বর রাতে ‘দ্রোহের আলো’ জ্বালানোর, বিকেন্দ্রিত এই কর্মসূচি রূপায়ণের উদ্যোগ শুরু হয়ে গেছে। এরপর অভয়ার হত্যার তিন মাস পর ৯ নভেম্বর অপরাধীদের চার্জশিট দেবে জনতা। নভেম্বরের শেষার্ধে জাঠা জয়নগর থেকে জয়গাও, যেখানেই ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়ন সেখানেই অভয়া মঞ্চ।
আমার ধারনা আজ যে বিপুল সংখ্যক মানুষ আন্দোলনে যুক্ত হচ্ছেন তার কারণ জুনিয়র ডাক্তাররা হুমকির সংস্কৃতি, ভয়ের রাজনীতির যে আওয়াজ তুলেছেন তাতে মানুষ রাজ্যব্যাপী ভয় আর হুমকির বিরুদ্ধে নিজের ভাষা খুঁজে পেয়েছেন।
এই লড়াই তাই শেষ হবে না, চলবে।
লেখাটির ঈষৎসংক্ষিপ্ত রূপ শ্রমজীবী ভাষা পত্রিকার ১৫ ই নভেম্বর ২০২৪ সংখ্যায় প্রকাশিত।