দুলালী
ভোরের আলো ফোটার আগেই আলতো করে মশারির ধারটা উঠিয়ে বাইরে আসে দুলালী। রোজ এমন সময়েই উঠে পড়ে সে, আসলে এই সময়েই তাকে উঠতে হয় । ঠিক পাশে শুয়ে তার মেয়ে আল্হাদি , খানিক তফাতে সুদর্শন। পাশের ঝুপড়ি ঘরে দুলালীর শাউরি যমুনা শুয়ে আছে। দুলালী এখন গিয়ে তাকে ডেকে তুলবে। তারপর দুজনে মিলে বেরিয়ে পড়বে নীলগঞ্জের ফুল হাটের উদ্দেশ্যে। গ্রীষ্ম বর্ষা শরৎ শীতের কোনো বালাই নেই। এমনই তাদের বারমাস্যা। কখনো কখনো সুদর্শনও ওদের সঙ্গে যায়। দলে একজন মরদ মানুষ থাকলে চাষি কিংবা পাইকারদের সঙ্গে দরাদরি করতে খানিকটা সুবিধা হয় বটে, তবে এখন শাউরি আর বউ মিলেই সেই হ্যাপা সামলে নেয়। এ লাইনে নেহাৎ কমদিন তো হলোনা!
গাঁয়ের মেঠো পথ ছেড়ে জেলা পরিষদের ঢালাই রাস্তায় উঠতেই অনেকের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় – মালতি, যূথিকা, স্বপ্না, ইন্দ্রানী আরও অনেকের সাথে। তবে সবাই যে ফুল কিনতে যাচ্ছে এমন নয়। হাট থেকে মোচা,থোড়, কচুর লতি,
কচুর শাক,ঘ্যাটকোল এসব কিনে কেটে কুটে শহুরে বাবুদের বাজারে বিক্রি করে কেউ কেউ । আজকালকার ফ্ল্যাট বাড়ির বিবিরা বটি পেতে সবজি মাছ এসব কাটতে জানেনা। শহরতলির মালতি, চাঁপারাই এ কাজটি করে। কাটাকুটিতে খাটনি যেমন আছে তেমনই আছে বাড়তি কামাইয়ের হাতছানি। ওদের টানাটানির সংসারে তাকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
ঘোষেদের বাগান বাড়িকে বাঁয়ে রেখে নীলগঞ্জের হাটের রাস্তায় পড়তেই যমুনা দুলালীর হাত টেনে ধরে। দুলালী অবাক হয়। এখন তাদের তাড়াতাড়ির সময়। এই অসময়ে হাত ধরলো কেন?
– কি গো! হাত টেনে ধরলে যে বড়! শরীল খারাপ করতিছে নাকি? তাহলে একটু সবুর কর।
– নারে বউ, সেসব কিছু নয়। বড় করে শ্বাস নে , টের পাবি।
– এতো ভোরের শিউলি ফুলের গন্ধ। কই , এ কদিন তো পাইনি?
– কী করে পাবি? তিনি জানান না দিলে কি টের পাওয়া যায় রে পাগলি? তেনার যে আসার সময় হয়েছে। সে খবর আকাশ পায়, বাতাস পায় , মাঠের ঘাসেরা পায় , টলটলে জলে ভরে থাকা দীঘি আর পুকুরেরা পায় । আমরাও পাই ওদের কাছ থেকে। এই যে গাছ ভরে থাকা শিউলিরা আমাদের খপর দিল , তিনি আসতেছেন।
– সত্যিই তাই। পেটের লড়াই লড়তে লড়তে এসব যে বেবাক ভুলতে বসেছি। ভাগ্যিস তুমি ডাকলে ! দুলালীর আক্ষেপ।
আবেগ আর আনন্দে দুলালী যমুনাকে জড়িয়ে ধরে। শাউড়ি আর বৌমা মিলে ভোরের বাতাসে বুক ভরা শিউলি শ্বাস নেয়।
এমন ছোট ছোট সুখের মুহূর্তগুলো জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। তাকে আজ হঠাৎ বুঝি ফিরে পায় ওঁরা। চোখের কোণে চিকচিক করে ওঠা জল আঁচলে মুছে যমুনা বলে – চল, ওদিকে আবার দেরি হয়ে যাবে। দুগ্গা, দুগ্গা।
কমলা
‘ও নিবারণ কাকা! ঘরে আছো নাকি?’ – আশু হাঁক দেয়।
আকাশে এখনও জল ভরা মেঘেদের আনাগোনা। ভাদুরে গরমের জো কাটলেই ভোরের বাতাস শরীরে শিরশিরানি ধরাবে । আশু জানে এই সময় তাদের ব্যস্ত হয়ে ওঠার সময়। এমন তড়বড়ানি বছরের অন্য সময়ের থেকে একেবারে আলাদা। এসব দেখে দেখেই বড় হয়ে ওঠা আশুর। গতকালই প্রথম বায়নার খবর এসেছে আশুদের পাড়ায়। মাচা থেকে ঢাক ঢোল গুলোকে নামিয়ে হালকা রোদ্দুর গায়ে মাখিয়ে ঝেড়েপুছে রাখা শুরু হয়েছে বাদ্যকর পল্লিতে। নেই নেই করেও এখনও প্রায় কুড়ি টি পরিবারের বাস এখানে। বছর কয়েক আগে আরও অনেকেই ছিল এই ঠাঁয়ে। কালের নিয়মেই সংখ্যাটা অনেকটাই কমে এসেছে।এই জমানায় এসব কাজে সারাবছর আটকে থাকলে পেটের ভাত জুটবে না। ঠাকুর্দার মুখে আশু শুনেছে তাঁদের বাপ ঠাকুর্দার আমলে জমিদারের সেরেস্তা থেকে সম্বৎসরের খোরাক আসতো, পুজোআচ্চার সময় মিলতো উপরি পাব্বনি। সে সব দিন আশু দেখেনি, কেবল গপ্পো শুনেছে।
খাটের ওপর চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে ছিল নিবারণ। শরীর গতিক ভালো নেই। বেশ কিছুদিন ধরেই জ্বর আর ঘুসঘুসে কাশি। একটুতেই কেমন হাঁপিয়ে যায় আজকাল। নিবারণ বুঝতে পারে এখন ঘরের এককোণে রাখা যন্তরে কাঠি ঠুকে নতুন নতুন বোল ফোটানোর সময় এসেছে, কিন্তু শরীর যেন আর সায় দেয় না। ছেলেটা ও কাছে নেই। বাপ জ্যেঠার পেশায় বাঁধা হয়ে থাকলে পেট চলবে না বুঝেই সে পাড়ি দিয়েছে ভিন্ রাজ্যে। বাড়িতে সে আর মেয়ে কমলা।
– আরে আশু দা ! কতক্ষণ এমন দাইড়ে রয়েছো? এসো ঘরের ভিতরি এসো, যা রোদ্দুর বাইরে। কমলা আশুকে ভেতরে ডাকে।
– হ্যাঁরে কমলি , কাকা ঘরে নেই? আমি সেই থেকে ডাকাডাকি করছি!
– না না, বাবা ঘরেই আছে, শরীরটা তেমন ভালো যাচ্ছেনা। এসো। বাবা, আশুদা এসেছে। তোমার সঙ্গে কথা কইতে। ওঠো একবার। আশু দা তুমি বরং এই জলচৌকিটায় বসো।কতক্ষণ আর দাইড়ে থাকবে।” – কমলা জলচৌকিটা এগিয়ে দেয়।
– বলি কতদিন এমন হাল তোমার? আমিতো খবর পাইনি। জ্বর কাশি, বলি ডাক্তারের কাছে গেছিলে?” – আশুর গলায় উদ্বেগ ঝরে পড়ে।
– না রে বাপ, তেমন কিছু নয়। ঋতু বদলের সময় তাই।বলি, বৃন্দাবন কেমন আছে? হাঁটাচলা করতে পারছে একটু একটু? নিবারণ জিজ্ঞেস করে।
– তেমন উন্নতি এখনও হয়নি। এই তো গেল মাসে ডাক্তার দেখিয়ে আনলাম। আরও কিছুদিন দেখতে বলল। দেখা যাক। নিবারণ ক্ষীণ কন্ঠে উত্তর দেয়।
– তা বলছিলাম কি, মায়ের আসার দিন তো এগিয়ে এলো। বর্ধমানের সেই বাবুরা খবর পাঠিয়েছে দেখা করতে যাবার জন্য। কিন্তু তোমার শরীরের যা হাল দেখছি!” উৎকন্ঠা আশুর গলায়। একটা রেকাবিতে দু কাপ চা নিয়ে কমলা ঘরে ঢোকে।
– কোন চিন্তা করোনা আশুদা, তুমি বায়না ধরো। আমরা যাব। এই নাও একটু চা নাও। ভালো খবর নিয়ে এলে, শুকনো মুখে এসব কথা হয়? – কমলার ঝটিতি আবির্ভাব।
– আমি ভেবেছিলাম নিবারণ কাকা,আমি, গোকুল আর সর্বেশ্বর এই চারজন যাব। এখন তো দেখছি কাকার পক্ষে যাওয়া সম্ভব হয়তো হবে না। তাহলে…..? আশুর গলায় চিন্তার সুর।
– আমি যাব তোমাদের সঙ্গে। তুমি বায়না ধরো আশু দা।
– তুই !!! তুই যাবি ঢাক নিয়ে? নিবারণের কন্ঠে অপার বিস্ময়।
–তুই পারবি কমলি? আশুও কম অবাক হয়নি।
– কেন পারবো না? আমি নিবারণ বাদ্যকরের মেয়ে। জন্ম ইস্তক ঢাক ঢোলের বুলি শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। তাল আর লয় আমার রক্তে। ঠিক পারবো। কোনো চিন্তা করো না।–কমলার গলায় প্রত্যয়ী সুর।
ঘরের এককোণে রাখা নিবারণের ঢাকটা কাঁধে তুলে নেয় কমলা । নিবারণ আর আশুর পা ছুঁয়ে কাঠির ঘায়ে বোল তোলে। নিবারণের দু চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে আনন্দে। তাঁর ঘরের ভেতরে স্বয়ং মা দুর্গা যেন আজ নিজের পুজোর আয়োজনে মেতে উঠেছে। কমলা বোধনের বাজনা বাজায়।
শারদা
লকডাউনের পর্ব যখন শুরু হলো শারদা তখন ক্লাস সেভেনে। সে একটা ঝড়ের পর্ব। জুটমিলের ক্যাজুয়াল শ্রমিক জয়শঙ্কর যাদবের সামান্য চাকরিটা খারিজ হলো সবার আগে। এমনিতেই চটকলগুলোর হাঁপানি রোগীদের মত শ্বাস টানাটানির সমস্যা। তার ওপর কোথাথেকে এক উটকো রোগ এসে সবকিছু ওলোটপালট করে দিল। আতান্তরে পড়লো জয়শঙ্কর। কুলি লাইনের ভিজে স্যাঁতসেঁতে ঘরে যাওবা কোনো রকম ভাবে পাঁচ জনের সংসারটা টিকে ছিল ,এবার বোধহয় তাও গেল। শারদা তিন ভাইবোনের মধ্যে মেজ। দাদা ব্রজেশ ওর থেকে তিন বছরের বড়ো,আর ভাইয়া প্রিয়েশ তখন সবে জুটমিল লাগোয়া এফ পি এস স্কুলের তৃতীয় শ্রেণিতে। পরিস্থিতির শিকার জয়শঙ্কর যাদবের তখন একদম দিশেহারা অবস্থা।
এসব ক্ষেত্রে যা সাধারণত ঘটে তেমনি ঘটল জয়শঙ্করের সংসারে। নেহাত স্কুলগুলোতে তখন ছুটি, তাই স্কুল ছাড়ার কথা মাথায় এলোনা বটে, তবে কিছু একটা তো করতেই হবে। না হলে আলগা ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা সংসারটা একদম ভেসে যাবে। শারদা আর ব্রজেশ খুঁটি হবার লড়াইয়ে নামতে বাধ্য হলো। সাইকেলের হাতলে ব্যাগ ঝুলিয়ে পাড়ায় পাড়ায় সবজি বিক্রি শুরু করে ওরা । গৃহবন্দি মানুষজন দুয়ারে লংকা,লেবু,শাক পেয়ে খুশি।কচি মুখ দেখে অনেকেই সহানুভূতি দেখায়। দরদামে অভ্যস্ত নয় , তাই হয়তো একটু ঘাটতি হয়, তবে সবকিছুই বিকিয়ে যায় দিনের শেষে।
সেদিনও সবজি বিক্রি করে বাড়ি ফিরছে দুই ভাইবোন। মতিলাল সাউয়ের তেলকলকে ছাড়িয়ে একটু ডানদিকে ঘুরতেই দেখে তাদের ঝুপড়ি ঘরের সামনে বেশ কিছু মানুষজনের জটলা। শারদার মনে কু ডাকে। তাহলে কি ঘনশ্যাম সিং এসেছে ঘর থেকে তাদের বার করে দিতে? বেশ কয়েকমাসের বাড়ির ভাড়া বাকি পড়ে গেছে। বাড়ির কাছে আসতেই সব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যা ভেবেছিল তাইই । ঘনশ্যামই এসেছে দলবল নিয়ে জয়শঙ্করদের ঘর খালি করতে। ঘনশ্যামের লোকজন জয়শঙ্করকে টেনে হিঁচড়ে ঘরের বাইরে বের করার চেষ্টা করতেই রুখে দাঁড়ায় শারদা।
– ইয়ে সব ক্যায়া হো রহা হ্যায়? আপকা কিরায়া কাল হি মিল জায়গা। আভি বাপু কো ছোড়িয়ে।”
বছর তেরোর এক কন্যার থেকে এমন অভাবিত ভাবে বাধা পেয়ে একটু অবাক হয়ে জয়শঙ্করকে ছেড়ে দেয় ওরা।
– আভী সব ঘর ওয়াপস যাইয়ে। ম্যায় জব বোলি, তব সব মিল জায়েঙ্গী।” বেশ জোরের সঙ্গে শারদ সবাইকে আশ্বস্ত করে।
জয়শঙ্কর মেয়েকে কিছু বলতে যায়। হাত উঁচিয়ে শারদা তাকেও থামায়। পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছে বলে গজগজ করতে করতে ঘনশ্যাম বলে ,
– শুনলে গুড়িয়া, কাল মুঝে তিন মহিনা কি কিরায়া চাহিয়ে, নহী তো……
ওঁরা চলে যেতেই দাদাকে নিয়ে বেরিয়ে যায় শারদা। যখন ঘরে ফিরে এলো তখন বেলা গড়িয়ে গেছে। বাপুর হাতে কিছু টাকা তুলে দিতে দিতে বলে , – কাল উসে দে দেনা । ডরনে কা কোই ফায়দা নহী। আপনি আওয়াজ খুদ কো হী উঠানি হ্যায় ।আভরণহীন হাতদুটোকে ওড়নার নিচে আড়াল করতে করতে শারদা বলে –মুঝে সচমুচ শারদা বন্ নী হ্যায় ।
দূর, অনেক দূর থেকে শাঁখের শব্দ ভেসে আসে।
সকাল বেলা এই তিন কন্যার কথা পড়তে খুব ভালো লাগলো।দুলালী, কমলা আর শারদা আমাদের খুব চেনা। তাদের মতো প্রান্তিক মানুষের কথা তুলে ধরে লেখক আমাদের ভালো লাগাকে নতুন করে উসকে দিলেন। এমন সংগ্রামের কথা আরও বেশি করে পড়তে চাই।
আপনার ভালোলাগা আমাদের সবার সঙ্গে ভাগ করে নেবার জন্য ধন্যবাদ। এভাবে লড়াই করেই সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষেরা নিজেদের অবস্থান প্রতিষ্ঠা করেন।