চন্দ্রধর দাসকে আপনারা চিনবেন না। অবশ্য কেউ কেউ চিনতেও পারেন, যারা অসমের ডিটেনশন ক্যাম্পে ছুঁড়ে ফেলা তথাকথিত ‘বিদেশি’দের নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, সম্পূর্ণ নিরপরাধ হওয়া সত্ত্বেও যে ভয়াবহ শাস্তি তাদের ভোগ করতে হয়েছে, তার জন্য যন্ত্রণা অনুভব করেছেন। ২০২০ সালের ১৪ ডিসেম্বর যখন জন্মের যন্ত্রণা থেকে অবশেষে তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন, তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ১০৪ বছর। বাবার নাম, প্রয়াত শিরিষ চন্দ্র দাস। সাকিন – বরাইবস্তি, ধলাই, জিলা কাছাড়।
১৯৬৬ সালে বাংলাদেশ থেকে এসেছিলেন ত্রিপুরা। রিফিউজি রেজিষ্ট্রেশন সার্টিফিকেট আছে। ফরেনার্স ট্রাইবুনাল থেকে ১৭/৩/২০১৭, ৫/৬/২০১৭, এবং ৬/৭/২০১৭ সালে নোটিশ দেওয়া সত্ত্বেও ফরেনার্স ট্রাইবুনালে কেস লড়ার চেষ্টা করেননি। একতরফা রায়ে চন্দ্রধর দাসকে শিলচর ছয় নম্বর ফরেনার্স ট্রাইবুনাল থেকে বিদেশি ঘোষণা করা হয় জানুয়ারি মাসের ২ তারিখ। সাল ২০১৮।
এবার তো প্রশ্ন জাগবে, নিশ্চিত জেলের হাতছানি সত্ত্বেও কেন চন্দ্রধর কেস লড়লেন না? বাঁচার চেষ্টা যে করে না, তাকে নিয়ে আবার এত কথা কেন? কথা এই কারনেই, কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, তিনি জাতিতে হিন্দু এবং ভারত বর্ষ তাঁর দেশ। এ দেশে তাঁর কোনো ক্ষতি হতে পারে না। একদিন প্রমাণ হবেই যে তিনি ভারতীয়। দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে তিনি বাবা বলে সম্বোধন করতেন। রেডিওতে প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শুনলেই কাঁপা কাঁপা হাত জোড় করে বলতেন, ‘মোদি আছেন বলেই আমি খাবার পাচ্ছি’। ডিটেনশন ক্যাম্পের অসহনীয় জীবন যাপন করতে করতেও এই শতবর্ষ পার করা বৃদ্ধ বিশ্বাস করতেন, যে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মত একজন মহাপুরুষ, সে দেশে তিনি ভারতীয় প্রমাণিত হবেন না, এ হতেই পারে না। নিজের মনে বিড়বিড় করে বলতেন, ‘আমার কাছে ত্রিশটি ভোট আছে। আমি মোদিকে সব ভোট দেব’। কিন্তু হায়! কোনো মহাপুরুষ তাঁকে বাঁচাতে আসেন নি। অবশেষে, ১৪ ডিসেম্বর ২০২০ সালে চন্দ্রধর দাস বিদেশি তকমা নিয়েই এই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন।
৩১ মার্চ ২০১৮ সালে চন্দ্রধর দাসকে ওরা শিলচর ডিটেনশন ক্যাম্পে ঢোকায়। শিলচরের কমল চক্রবর্তী ও তাঁর সমাজকর্মী বন্ধুরা ২৬ জুন কাছাড়ের জেলাশাসককে তাঁর ছবি দেখিয়ে মানবিকতার কারণে তাঁকে ছাড়ার অনুরোধ করেন। অনুরোধে জামিন মেলে। কিন্তু, এর পরেও এই অসুস্থ বৃদ্ধকে ট্রলিতে শুইয়ে রেখে ফরেনার্স ট্রাইবুনালে হাজির করাতে হত। সারাদিন সেখানে তাঁকে রেখেই চলত কোর্টের কাজ। তাঁর কাছে যে রিফিউজি রেজিষ্ট্রেশন সার্টিফিকেট ছিল, তা ভেরিফিকেশনের জন্য ত্রিপুরায় পাঠানো হয়েছিল। যার উত্তর তাঁর মৃত্যুর পরও আসে নি।
অতিবৃদ্ধ চন্দ্রধর ও তাঁর স্ত্রী দু’জনেই ছিলেন পুরোপুরি শয্যাশায়ী। তাঁদের স্বামী পরিত্যক্তা মেয়ে তাঁদের দেখাশোনা করতেন। মনে তীব্র বিশ্বাস থাকলেও ‘বিদেশি’ বদনাম তাঁর ঘোচে নি। শেষ দিন পর্যন্ত আক্ষেপ করে গেছেন চন্দ্রধর। যে দেশে জন্মেছেন, ঘামে শ্রমে যে মাটিতে অবদান রেখেছেন, সেই দেশ তাঁকে নাগরিকের স্বীকৃতিটুকু দিল না!
ওপার বাংলা থেকে সীমান্তে প্রহরা থাকা সত্বেও যারা নানা অবৈধ উপায়ে এদেশে এসে বসবাস করছেন, তারা যদি কোনো অপরাধ করে থাকেন, তাহলে সেই অপরাধের অংশ এই সীমান্তপ্রহরা তথা স্বরাষ্ট্র দপ্তরের ওপরেও বর্তায়। এই অপরাধে তথাকথিত “অনুপ্রবেশকারী” যদি শাস্তি পায়, তাহলে অপরপক্ষ কী শাস্তি পাচ্ছে, সেটাও জানার অধিকার তথ্যের অধিকার আইনে থাকা উচিত। এই কাঁটাতার পার হয়ে আসা মানুষদের একটা বড়ো অংশ মুসলমানবিরোধী, হয়তো প্রতিবেশী দেশের সংখালঘুনীতির কারণে, ফলে বিজেপির ভোটার। তারা ২০১৯ এর সিএএ অনুযায়ী নাগরিকত্ব পাবেন এই প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করে আজ চন্দ্রধর দাসের মত পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছেন। এছাড়াও ওদেশে নানা অপরাধ করে নাম বদলে এদেশে অনেকে পালিয়ে আছেন, (উল্টোটাও সত্যি হতে পারে) যা দু-দেশের পক্ষেই ক্ষতিকর। এই সমস্ত মানুষের অগাধ নিশ্ছিদ্র বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে তাদের ভুল বুঝিয়ে নাগরিকত্ব দেওয়ার নাম করে শিবির করে তাদের দিয়ে লিখিয়ে নেওয়া হয়েছে যে তারা বাংলাদেশ থেকে অবৈধ পথে এসেছে। এখন বেনাগরিক হওয়া ছাড়া তাদের আর কোনো পথ নেই।
এই যে হিমালয় সম প্রতারণা, তার কি দরকার ছিল? সহজ সরল আইনি সমাধান থাকলে মানুষ অপরাধ কম করে। ভারত সরকারের কি আদৌ কোনো বর্ডার পলিসি আছে? ভারতের সীমান্তবর্তী দেশগুলির মধ্যে সাতটি স্থল প্রতিবেশী রয়েছে, যেমন পাকিস্তান, চীন, নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ, মায়ানমার এবং আফগানিস্তান এবং দুটি সমুদ্র প্রতিবেশী, শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপ। এই নয়টি দেশ ভারতের আন্তর্জাতিক সীমান্তের অংশ, যা স্থল এবং অন্যান্য সামুদ্রিক সীমানা প্রায় ১৫,১০৬ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত। এর মধ্যে ভারত বাংলাদেশ সীমানা হল ৪০৯৬.৭ কিলোমিটার। এত বিস্তৃত আন্তর্জাতিক সীমানার মধ্যে কেন ভারত বাংলাদেশ সীমানায় এই সংঘাত বন্ধ করা যায় না? অথচ বহু খোলা বর্ডার আছে। সেখানে অপরাধের তো এমন অভিযোগ আসে না। কেন যেখানে কাঁটাতার সেখানেই গোলমালের অভিযোগ সবচেয়ে বেশি? আর সবার ওপরে আজও সর্বোচ্চ সত্য হল আমাদের সংবিধানের নাগরিকত্ব আইনের ছয় নম্বর ধারা, যেখানে বলা হয়েছে ১৯৩৫ সালের ভারতবর্ষের মানচিত্র থেকে বিচ্ছিন্ন অংশের কোনো অধিবাসী নিজে, বা তার বাবা- মা, বা ঠাকুরদা ঠাকুরমা, বা, দাদু দিদা যদি অবিভক্ত ভারতে জন্মগ্রহণ করে থাকেন, তবে তিনি যদি বিভক্ত ভারতে এসে বসবাস করতে চান, তাহলে তিনি ভারতের নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হবেন।
আইন কারো মুখের কথায় পরিবর্তিত হয় না। ভারতের সংবিধান বইয়ের ২০২৫ এডিশনের থেকে এর ছবি দিলাম। এর পরেও ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে বাংলা ভাষায় কথা বলে কাউকে বাংলাদেশী বলা যায় কি? বাঙালিকে ঘুসপেটিয়া বলা কেন অপরাধ বলে গণ্য হবে না? বিদগ্ধ মহলের উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।










