এক সময় পরিবার পরিকল্পনা দপ্তরের খুব জনপ্রিয় একটা শ্লোগান ছিল – ছোট পরিবার, সুখী পরিবার। ভারতবর্ষের বিপুল জনসংখ্যার কথা মাথায় রেখে পরিবার সীমিতকরণে প্রোৎসাহিত করতেই তৈরি করা হয়েছিল এমন বাক্য বন্ধ। সেই সময় আমরা সবাই পেরিয়ে এসেছি অনেক অনেক কাল। কথা মেনে আমাদের শহরাঞ্চলের পরিবারগুলো এখন অনেকটাই ছোট হয়ে এসেছে – আড়াই জনের পরিবার। পরিবারতো ছোট হলো কিন্তু সুখ এলো কি? এই মুহূর্তে এমন প্রশ্নই বারংবার ঘুরে ফিরে সামনে আসছে নানান ঘটনার অনুষঙ্গে।
আসুন আমরা আজকে , দেশের উদীয়মান স্মার্ট সিটি গুরুগ্রাম থেকে ঘুরে আসি। সপ্তাহের একটা কাজের দিন। খানিক আগেই সূর্যদেব পাটে বসেছেন। সন্ধ্যা নামতেই শহরের পট রীতিমতো বদলে গেছে। আলোয় আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছে শহরের বাড়িঘর, দোকানপাট, রেস্তোরা, মাল্টিপ্লেক্স – সব কিছু। আকাশ ছোঁয়া সোসাইটি বিল্ডিংগুলোর আট তলার একটা ফ্ল্যাটে আমরা এখন নজর দেবো। এই ফ্ল্যাটটিতেই থাকে আরভ ও তার মা – বাবা। আরভের বয়স দশ। পড়াশোনার ব্যাপারে এখনই বেশ আগ্রহী। এখনও কোনো টিউটর নেই। আরভের মা ই তার পড়াশোনার দেখভাল করেন। তিনি নিজেও উচ্চ শিক্ষিতা। আরভকে তিনি নিজের মনের মতো করে গড়ে তুলতে চান। ছেলেকে নিয়ে কতো স্বপ্ন তাঁর!
বই খাতা নিয়ে আরভ স্টাডি টেবিলে বসতেই আরভের মা পাশে এসে বসেন। আজকাল স্কুলে স্কুলে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ তৈরি হয়েছে। সারাদিন স্কুলে কী পড়াশোনা হলো তার খবরাখবর এই গ্রুপ পেজ থেকেই পাওয়া যায়। আরভের মায়ের এতে ভারি সুবিধা হয়েছে। ছেলের সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজেকেও বেশ আপ টু ডেট রাখতে পারেন। তিনি জানেন আজকাল এই প্রবল কম্পিটিশনের যুগে অভিভাবকদের সবসময় সচেতন থাকতে হয়, নাহলেই পিছিয়ে পড়তে হয়। বারবার হোয়াটসঅ্যাপ খুলে খুলে দেখতে থাকেন তিনি।
সন্তানের প্রতি মায়ের বাৎসল্য বা ভালোবাসা নতুন কোনো আলোচনার বিষয়ই নয়। তবে এই অতি ভালোবাসা যে বিড়ম্বনার সমতুল তা খুব স্পষ্টভাবেই জানিয়েছেন মনোবিজ্ঞানীরা। তাঁদের মতে এই অতিরিক্ত সচেতনতার বিষয়টিকে Snowplow Syndrome বলা হয়। নিজের সন্তানের সামনে আসা যে কোনো সমস্যাকে, তা সে হোমওয়ার্ক করা হোক, বইপত্র গুছিয়ে নেওয়া হোক — সবেতেই আগবাড়িয়ে আগুয়ান মায়েরা। সন্তানের বিকাশমান সত্তাকে উপেক্ষা করেই মায়েরা এগিয়ে যান ভালোবাসার দোহাই দিয়ে। মায়ের দেখাদেখি বাবারাও সামিল হন সন্তানদের সামনের যেকোনো ধরনের সমস্যার সমাধানে। একালের প্যারেন্টিং এর এমনটাই নাকি দস্তুর!
আগবাড়িয়ে সন্তানের কাজটা করে দেন। মনোবিজ্ঞানীদের মতে এই প্রবণতাটিই হলো আধুনিক Snowplow Syndrome 
প্রশ্ন হলো, কেন এক শ্রেণির অভিভাবকদের মধ্যে এমন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে? মনোবিজ্ঞানীদের মতে এর পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে যা Snowplow Syndrome এর বাড় বৃদ্ধির মূল কারণ। তাঁদের মতে –
- অণু পরিবারের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া
সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, ভারতের মহিলাদের জন উৎপাদিকা হার ( fertility rate) ১৯৯০ সালের ৩.৪ থেকে কমে ২.০ তে এসে ঠেকেছে। এরফলে বিগত সময়ের তুলনায় পরিবারের আয়তন ক্রমশই কমছে। এরফলে বাবা মায়ের সমস্ত ভালোবাসা, আবেগ, নজর এখন ঐ সবেধন নীলমণির ওপর। তাকে আগলে রাখতে গিয়ে নিজেরাই বুলডোজার হয়ে উঠেছেন বাধা সরাতে।
- সামাজিক স্তরে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়া
“এটা কম্পিটিশনের যুগ। একটুও পিছিয়ে পড়া চলবে না। পিছিয়ে পড়লেই চাপা পড়তে হবে। তুমি না পারলে আমরা আছি।”– এই মানসিকতার কারণেই অভিভাবকদের ছুটে চলা, সন্তানটিকে ছুটিয়ে নিয়ে যাওয়া। আজকাল সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাবা মায়েরা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে শুরু করেন– নামীদামী স্কুল, জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় সফলতা,আই আই টি অথবা মেডিকেল কলেজ, …….। এই সবই ওই সন্তানের হিতার্থে। ফলে চিন্তা আর পিছু ছাড়ে না। সন্তানের সামনে কোনো বাধা যাতে না আসে, তারজন্য নিরন্তর বুলডোজার চালিয়ে যান বাবা মা। নিজেদের অজান্তেই এক সময় তাঁরা Snowplow Syndrome এর শিকার হন।
- সামাজিক মাধ্যমের প্রবল চাপ
একালে আমাদের জীবনে সোশ্যাল মিডিয়া বা সমাজ মাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম। আমাদের সন্তানেরা কী খাবে, কতটা খাবে ,কী পরবে, কোথায় পড়াশোনা করবে , কোন্ স্ট্রিম বেছে নেবে ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠার জন্য?– সেইসব ঠিক করে দিতে আজকে সমাজ মাধ্যমের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। অভিভাবকরা এগুলোর দ্বারা পরিচালিত হন। আজকাল অনেক অনেক এডুকেটর, এডুকেশন ইনফ্লুয়েন্সার মঞ্চে হাজির হয়েছেন। তাঁরাই ঠিক করে দিচ্ছেন সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার জন্য কেমনভাবে পড়বে,প্রোজেক্ট কীভাবে তৈরি হবে,
কোন্ বিষয় নিয়ে প্রজেক্ট করলে মার্কস বেশি মিলবে এসব খুঁটিনাটি বিষয়। এইসব দেখে শুনে অভিভাবকরা সক্রিয় হয়ে উঠবেন তাতে আর আশ্চর্য কি! হচ্ছেনও তাই।
- অতিমারি পরবর্তী সময়ের প্রভাব
অতিমারির ভয়ঙ্কর সময়টা কাটিয়ে উঠলেও তার দুঃস্বপ্ন থেকে আমরা সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হতে পারিনি। অতিমারির দীর্ঘায়িত পর্বটি আমাদের মধ্যে এক অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করেছে। স্কুলের প্রাত্যহিক জীবন থেকে দূরে সরে থাকা, অনলাইনে পঠনপাঠনের কাজ চালানো, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে বেড়ে যাওয়া বিচ্ছিন্নতা – এসবের ফলে কেবলমাত্র শিক্ষার্থীরা নয় তাদের অভিভাবকদের মধ্যেও গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি হয়। ছেলেমেয়েদের যাতে আরও কঠিন লড়াইয়ের মধ্যে পড়তে না হয় সেজন্য অভিভাবকরাই তাঁদের প্রতি আরও আবেগঘন হয়ে ওঠেন।
“সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাল মিলিয়ে অভিভাবকদের উপলব্ধির স্তরেও গভীর পরিবর্তন এসেছে। বাবা মায়েরা সন্তানের সাফল্য কামনা করবেন,এটাই স্বাভাবিক । কিন্তু এখন অভিভাবকরা চাইছেন যে তাঁদের সন্তানরা যাতে কোনোরকমেই ঈপ্সিত সাফল্য থেকে বঞ্চিত না হয়। এজন্য তাঁরা যতদূর সম্ভব ছেলেমেয়েদের আগলে আগলে রাখছেন। তাঁরা বুঝতে চাইছেন না যে সন্তানদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি হলে,তারা ভবিষ্যতে কঠিন পরিস্থিতিতে নিজেদের সামলে নিতে পারবেনা। অতিরিক্ত আরাম আয়েশে রাখলে সন্তানদের মধ্যে কখনোই বাস্তব জীবনের প্রতি স্বচ্ছ ধারণা গড়ে উঠবে না। এমনটা তাদের ব্যক্তিত্বের বিকাশের অন্তরায়।” – এমনটাই মনে করেন দিল্লির শিশু মনোবিদ্ ডাঃ সঙ্গীতা ভাটিয়া।
সঙ্গীতা দেবীর মতে, “ কখনো কখনো এই অতিরিক্ত দেখভাল
নজরদারির জন্য কড়া মনোস্তাত্বিক মাশুল দিতে হতে পারে সন্তানদের।” জার্নাল অফ চাইল্ড এন্ড ফ্যামিলি স্টাডিজ – এ প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রের সূত্রে জানা গিয়েছে যে স্নোপ্লাউ গোছের অভিভাবকতার দরুণ ভবিষ্যতে সন্তানদের মধ্যে উচ্চ মাত্রার উদ্বেগ, কোনো কিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারার অক্ষমতা ও সিদ্ধান্তহীনতার মতো সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
সঠিক তথ্য না থাকলেও, অনুমান করা হয় যে এই মুহূর্তে এ দেশের শহুরে পরিবারগুলোর ৫% – ১৩% পরিবারে একটিমাত্র শিশু রয়েছে। “ এইসব পরিবারের শিশুরা বাবা – মা ছাড়া আর কারও সঙ্গে নিজেদের পড়াশোনার পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়ে কথা বলতে পারে না। ভাই বোন কেউ না থাকায় তাদের মধ্যে স্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতার পরিবেশটিও সম্পূর্ণ অনুপস্থিত থাকে। তাদের ঘিরে থাকা বাবা মা যতটা অতিসক্রিয় থাকেন সন্তানেরা ঠিক ততটাই নিষ্ক্রিয়তার শিকার হয়। কারণ তারা জানে যে,বাবা মা ই সব করে দেবেন। এইভাবে এই সব সন্তানেরা এক সময় ভাবতে শুরু করে যে বাবা মা ছাড়া তাদের পক্ষে কোনো ধরনের পরিস্থিতির মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।”– ডাঃ সঙ্গীতা ভাটিয়া এমনটাই মনে করেন।
২০২২ সালে অশোকা ইউনিভার্সিটি থেকে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায় যে, পরিবারে একটিমাত্র সন্তান থাকলে সে পড়াশোনার ব্যাপারে অন্যদের তুলনায় এগিয়ে থাকলেও, পরিণত বয়সেও সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে তারা তাদের অভিভাবকদের ওপরেই নির্ভর করে থাকে।
জাতীয় জীবনে এর নীট প্রভাব :– বাবা মায়ের নিবিড় ছত্রচ্ছায়ায় অতি প্রশিক্ষিত, অতি যত্নে প্রতিপালিত একদল নতুন প্রজন্মের নাগরিকদের নিমগ্ন নির্মিতির পর্ব চলছে,যারা বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ে জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ লিখতে পারবে কিন্তু নিজেদের জীবনে বয়ে আসা সমস্যার উষ্ণতা সামলাতে পারবে না।
তাহলে উপায়? অভিভাবকরা কী করবেন? মনোবিজ্ঞানীরা মাননীয় অভিভাবকদের উদ্দেশ্য করে কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, এগুলো অনুসরণ করলে এক পরনির্ভরশীল প্রজন্মের হাত থেকে খানিকটা হয়তো মুক্তি মিলবে। কী বলেছেন তাঁরা?
- ওদের স্বাধীনতা দিন। স্বাধীনতা মানে স্বেচ্ছাচারিতা নয় –এটা ওদের বুঝিয়ে দিন। বয়সপোযোগী কাজের দায়িত্ব পালনে ওদের উদ্বুদ্ধ করুন। ওদের ছোটখাটো সমস্যার সমাধান করতে দিন। ভুল করলে আগবাড়িয়ে তার সমাধান করতে ঝাঁপিয়ে পড়বেন না। ওদের ভুল থেকে ওদের শিখতে দিন।
- সন্তানের সঙ্গে কথা বলে তার ইচ্ছা, অনিচ্ছা, ভয়, সংশয় ইত্যাদি বিষয়ে জানার চেষ্টা করুন। নতুন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে চাইলে প্রথমেই না বলে তাকে নিরুৎসাহিত করবেন না। ওকে ময়দানে নামতে দিন। লক্ষ রাখুন ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কিনা। ব্যস্, এইটুকুই হবে আপনাদের ভূমিকা।
- ওদের ভুল করতে দিন। মনে রাখবেন ভুল থেকে শিক্ষা নিতে নিতেই মানুষ অতীত থেকে আজকের এই পর্যায়ে এসে হাজির হয়েছে। মনে রাখবেন ওদের আজকের ভুল আগামী দিনে ওদের সাফল্যের নতুন সোপান গড়ে দেবে। ওদের সমর্থন করুন, সমাধান ওদের খুঁজে নিতে দিন।
- নিজেরা ওদের সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন। ওরা তাতে উদ্বুদ্ধ হবে, অনুপ্রেরণা পাবে। বৃহত্তর জীবনে ওদের অনেক প্রতিকুল পরিস্থিতির সামনে পড়তে হবে।
- ওদের প্রাণখুলে প্রশংসা করুন। প্রতিতুলনা করবেন না। মনে রাখবেন, সাফল্য মানে কোনো পরিচিত পরিণতি নয়। সাফল্য মানে পায়ে পায়ে চলতে চলতে তারা নিজেদের মতো করে কতটা পথ এগিয়ে এলো তাকেই বোঝানো হয়। কাজটা কতটা নিখুঁত ভাবে করতে পারলো তার ওপর জোর না দিয়ে, কতটা আগ্রহ নিয়ে নিজে কাজটা করলো তার মূল্যায়ন করতে শিখুন।
পথটা কঠিন। শুধু আপনাদের সন্তানদের জন্য নয়, আপনাদের জন্যও। বরফ জমা রাস্তা থেকে বরফ সরিয়ে নিলেই সমস্যার সমাধান হবে না । এরফলে আপনারা বুঝতেও পারবেন না ভবিষ্যতে বরফের সামনে পড়লে কীভাবে তা অতিক্রম করবে?
আসুন আমরা সবাই মিলে নতুন করে ভাবতে বসি।
নভেম্বর ১৩. ২০২৫.
** লেখাটি গুরুচন্ডালি ই- পত্রিকার সৌজন্যে প্রাপ্ত।
















Bah. Bes valo laglo.
খুব সত্যি কথাও অনেক সময় বেশ ভালো লাগে।
ছড়িয়ে পড়ুক।
Sokoler pora o bhoja uchit, khuub I prasongik.