নয়ই অক্টোবর, দু’হাজার পঁচিশ। অভয়ার বিচারহীন ১৪ মাস। রাষ্ট্রীয় মদতে সংঘটিত প্রাতিষ্ঠানিক যে হত্যাকাণ্ড- ধর্ষণের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল তামাম পশ্চিমবাংলা, আলোড়িত হয়েছিল গোটা দেশ ও বিশ্বের সভ্যসমাজ সেই নারকীয় হত্যাকাণ্ড- ধর্ষণের ন্যায়বিচার এখনও মেলে নি। শিয়ালদা ফৌজদারী আদালতে বিচার হয়েছে,কলকাতা উচ্চ আদালতে এখনও মামলা বিচারাধীন, ভারতের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ে মামলা এখনও মুলতুবি। তাই অভয়ার ন্যায়বিচারের দাবিসহ চারদফা বহ্নিমান দাবিতে অভয়া মঞ্চ ও জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টরস আবারও রাজপথে নেমেছেন। ডাক দিয়েছেন, ‘প্রতিবাদী অনশন অবস্থান’ কর্মসূচীর। সকাল ৯ টা থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত টানা ১২ ঘন্টার অনশন অবস্থান কর্মসূচী। ‘অভয়া ও অভয়াদের বিচারের দাবিতে,রদুর্নীতি ও হুমকির অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে,’ ‘অপরাধী ও ষড়যন্ত্রীদের শাস্তির দাবিতে ‘ এবং ‘চিকিৎসকসহ প্রতিবাদীদের উপর চালানো সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে’ দিনভর উত্তাল হয়ে উঠল শ্যামবাজার আন্দোলন চত্বর।
এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড, এই ঘটনার পর রাজ্যজুড়ে একশয়ের বেশি শিশু,কিশোরী ও নারী ধর্ষণ-ন্যায়বিচার, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি, লাগামহীন সন্ত্রাস ও থ্রেট কালচারের অবসান, অপরাধী ও ষড়যন্ত্রকারীদের কঠোর শাস্তির দাবিতে এবং চিকিৎসকসহ প্রতিবাদীদের উপর চাপানো মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে দুই সংগঠনের প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতীকী এই অনশন অবস্থান শুরু হয় ঠিক সকাল ৯ টায়। শুরুতে ঘোষণার মধ্য দিয়ে কর্মসূচীর সূচনা করেন অভয়া মঞ্চ এর অন্যতম সংগঠক শ্রী সন্দীপ রায়। উপস্থিত ছিলেন জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টরস এর অন্যতম কনভেনর ডাঃ পুণ্যব্রত গুণ ও হীরালাল কোনারসহ অন্যান্য চিকিৎসকগণ, অভয়া মঞ্চ এর অন্যতম আহ্বায়কগণ ডাঃ তমোনাশ চৌধুরী, শ্রী মতী মনীষা আদক ও অপরাপর সংগঠক ও সদস্য অনশনকারীগণ।
এরপর সারাদিন ধরে এই অনশন মঞ্চে চলে দৃপ্ত শ্লোগান, ঝাঁঝালো বক্তৃতা। প্রতিবাদী সঙ্গীত, কবিতা পাঠ, আবৃত্তি, শ্রুতি নাটক যন্ত্র সংগীতে আন্দোলন চত্বর মুখর হয়ে ওঠে। মুহুমুর্হ শ্লোগানে – ‘ অভয়ার ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’, ‘পুলিশ/প্রশাসন তোমার কিসের ভয়, ধর্ষক তোমার কে হয়’, ‘অভয়া থেকে তামান্না, এই অনাচার আর না,’ ‘উই ওয়ান্ট জাসটিস’ স্পন্দিত হয় চর্তুদিক। পথচলতি বহু মানুষ এসে অবস্থান মঞ্চে যোগ দেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে। শ্লোগান গলা মেলান।অনশনকারীদের প্রতিবাদী গান, কবিতা শোনেন। আমন্ত্রিত ব্যক্তিত্বসহ অনশনকারীদের বক্তব্য শোনেন। কেউ কেউ নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা বলেন। মাঝে মাঝে বৃষ্টি এলেও অনশনকারীদের সুতীব্র আবেগ, বহু মানুষের অংশগ্রহণ, পথচারীদের কৌতুহলী উপস্থিতি এবং সামগ্ৰিক পরিমন্ডল এক ধরণের পরিবেশ রচনা করে। দিনের নানা সময়ে অনশনকারীদের উদ্দীপ্ত করতে, রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতি,কর্মসূচীর তাৎপর্য, বিগত এক বছরের লড়াইয়ের পরিপ্রেক্ষিত ও ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণে বক্তব্য রাখেন ডাঃ তমোনাশ চৌধুরী, ডাঃ হীরালাল কোনার, অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্র, বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, বিজ্ঞান আন্দোলনের বিশিষ্ট সংগঠক শ্রী শ্যামল চক্রবর্তী, আইনজীবী শ্রী দিবাকর ভট্টাচার্য, অভয়া মঞ্চ এর সংগঠক শ্রীধৃতিমান সেনগুপ্ত, সোমা মারিক, সুনেত্রা সেনগুপ্ত, শ্রীকান্ত মুখার্জী। বক্তারা তাঁদের ভাষণে প্রাতিষ্ঠানিক এই হত্যাকাণ্ড- ধর্ষণের মর্মান্তিক ঘটনা পরম্পরা, পুলিশ প্রশাসনের ষড়যন্ত্রমূলক রহস্যময় আচরণ ও দ্রুত তদন্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার তৎপরতা, রাজ্য প্রশাসনের অভিসন্ধিমূলক কার্যকলাপ, প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করতে ঘৃণ্যতম প্রয়াস, গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণাদি লোপাট, সিবিআই এর তদন্ত পদ্ধতি ও অনপনেয় ব্যর্থতা, বিচারালয়ের বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা প্রভৃতি বিষয়গুলি উল্লেখ করে তীব্র উষ্মা প্রকাশ করেন। উল্লেখ করেন নির্যাতিতার মা- বাবার প্রতিকারহীন যন্ত্রণার কথা। একই সাথে রাজ্যের অপশাসন, গণতন্ত্রের মৃত্যু, সর্বব্যাপী দুর্নীতি, সন্ত্রাস আর মানুষের অসহয়তার কথা ব্যক্ত করেন। সুতীব্র ক্ষোভের সাথে বক্তারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আইন মেনে আন্দোলন করা সত্ত্বেও জুনিয়র ডাক্তার, সিনিয়র চিকিৎসকদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর চেষ্টা, সমস্ত প্রতিবাদীদের নানাভাবে পুলিশী হেনস্থার ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ জানান এবং অবিলম্বে এসব প্রত্যাহার ও বন্ধের জোরালো দাবি জানান। তাঁরা বলেন, মানুষের কন্ঠস্বর দমন করার এই নীতি মানুষ মেনে নেবেন না। স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ জনজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে দুর্নীতি সর্বগ্ৰাসী চেহারা নিয়েছে। স্যাঙাৎতন্ত্র দখল নিয়েছে গোটা রাজ্য। মানুষ তা মেনে নেবেন না। ডাঃ তমোনাশ চৌধুরী জানান এখনও পর্যন্ত চিকিৎসকদের ২৩ টি মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে। দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে তিনি বলেন, ক্রমেই এই প্রতিবাদ আন্দোলন আরও তীব্র ও বেগবান হয়ে উঠবে। স্বৈরাচারী কখনো ইতিহাসে শেষ কথা বলে না।
সাড়া ফেলে দেওয়া প্রতীকি এই অনশন অবস্থান কর্মসূচীতে অংশ নেন ১১৮ জন। নানা সময়ে অবস্থানে অংশ নেন এবং নাম নথিভুক্ত করেন ২৮২ জন। এমনকি অপরিহার্য কারণে যাঁরা অফিস করে বিকেলে যোগ দিয়েছেন তাঁদের কেউ কেউ সারাদিন অনশনেই ছিল। এ এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা।
এই কর্মসূচী চলাকালীন অবস্থান মঞ্চে ‘অভয়া ক্লিনিক’ পরিচালিত হয়। উপস্থিত অনশনরত চিকিৎসকগণ ৯০ জনের চিকিৎসা পরিষেবা দেন। কর্মসূচী শেষ হওয়ার আগে একটি বড়ো মোমবাতি মিছিল সংগঠিত করা হয়। অনশন মঞ্চে উপস্থিত সবাইকে নিয়ে এই মিছিল অনশন স্থল (শ্যামবাজার মেট্রো স্টেশন ১ নং গেট সংলগ্ন রাজপথ) থেকে যাত্রা শুরু করে শ্যামবাজার নেতাজী মূর্তির পাদদেশে হয়ে অনশন মঞ্চে এসে উপস্থিত হয়। জনমানসে তা আলোড়ন ফেলে দেয়।
একটি আশ্চর্য দিনে, একাধিক বক্তা বলেছেন, মানবমুক্তির স্বপ্নদ্রষ্টা চে গুয়েভারার ৫৯ তম মৃত্যদিনে অনুষ্ঠিত এই কর্মসূচীর অনন্য তাৎপর্যের কথা। ‘ আমি জানি, তুমি আমাকে হত্যা করতে এসেছো, গুলি করো কাপুরুষ, তুমি শুধু একজন মানুষকে হত্যা করবে, তার বিপ্লবী চেতনাকে নয়।’ তাই যতদিন না ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে, অভয়া আর অভয়াদের, যতদিন স্বৈরাচার দুর্নীতি স্যাঙাৎতন্ত্র বাংলার মাটি থেকে উৎপাটিত হবে, ততদিন সংগ্ৰাম চলবে। এই রণধ্বনি দিয়েই অনশন অবস্থান কর্মসূচী সাঙ্গ হয়। অনশন শেষে অনশনকারীদের লেবুর রস খাইয়ে অনশন প্রত্যাহার করা হয়।