গত ১০ অক্টোবর দুর্গাপুর আই কিউ সিটি মেডিক্যাল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী কলেজ ক্যাম্পাসের অনতিদূরে গণধর্ষিতা হয়। ২০২৪ এর ৯ অগাস্টের চোদ্দমাস পর আবার মেডিক্যাল কলেজে ধর্ষণ। ক্যাম্পাসের ভিতরে নয় কিন্তু কলেজ সংলগ্ন বিস্তীর্ণ প্রায়ান্ধকার এলাকায় যেখানে কোন পুলিশ প্রহরা বা কলেজের স্বতন্ত্র কোন নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। প্রতিবেশী রাজ্য উড়িষ্যা থেকে পশ্চিমবঙ্গে পড়তে এসেছে এই ছাত্রীটি। উড়িষ্যা আর বাংলার চাপান উতোর চলছে কোন রাজ্য ধর্ষণে কতটা এগিয়ে আর কতটা পিছিয়ে !
সব ধর্ষণের পরেই যেমন নানা রকম হিসেব নিকেশ চলে, চলে নানা কাহিনী উপকাহিনীর নির্মাণ, এই ঘটনাও তার ব্যতিক্রম নয়। মেয়েটি কখন বেরিয়েছিল, কেন বেরিয়েছিল, কার সঙ্গে বেরিয়েছিল, কী খেতে বেরিয়েছিল, কটায় বেরিয়েছিল – আট টা, নটা না বারোটা… এই সব তথ্য গুলিই পুলিশ এবং বিচারবিভাগীয় তদন্তের জন্য খুব জরুরি। কিন্তু এই সব তদন্ত গুলির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল সামাজিক তদন্ত। অভয়া হত্যাকাণ্ডের পর রাজ্যমাতার বিশেষ স্নেহধন্য আর জি কর হাসপাতালের তদানীন্তন অধ্যক্ষ বলেছিলেন “অত রাতে সেমিনার রুমে মেয়ে টি কী করছিল ? “ এই বার বঙ্গজননী বললেন “ রাত বারোটায় মেয়ে টা বাইরে গিয়েছিল কেন ?”
“হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন …”
২০২৪ এর ২৮ শে অক্টোবর গঠিত অভয়া মঞ্চের প্রধান দাবী অভয়ার বিচার, অন্যতম দাবী সব অভয়াদের বিচার আর নারী সুরক্ষা। এই মঞ্চ শহরের নামজাদা হাসপাতালের মেধাবী ডাক্তারি পড়ুয়ার নৃশংস হত্যা আর ধর্ষণের বিচারের দাবিতে যেমন রাস্তার এবং আইনের লড়াই এ আছে বিগত চোদ্দ মাস, এর পাশাপাশি নারী নির্যাতন, ধর্ষণের ঘটনায় ও মঞ্চের প্রতিনিধি দল গেছে ব্যারাকপুর, সোনারপুর, ক্যানিং, হরিদেবপুর, গড়ফা, রামপুরহাট এবং পাঁশকুড়াতে। গত ১১ অক্টোবর কলকাতা এবং স্থানীয় কর্মী সংগঠকদের নিয়ে অভয়া মঞ্চ এবং জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টরস এর অন্যতম আহবায়ক ডক্টর পুণ্যব্রত গুণের নেতৃত্বে প্রায় ৪০ জনের একটি দল দুর্গাপুর যায়। এই প্রতিনিধি দলে ছিলেন অভয়া মঞ্চের আর এক জন আহবায়ক ডক্টর তমোনাশ চৌধুরী, ডক্টর পবিত্র গোস্বামী, ডক্টর উৎপল বন্দ্যোপাধ্যায়, ডক্টর শতাব্দী মিত্র, জুনিয়র ডক্টর দের পক্ষ থেকে ডক্টর পুলস্ত্য আচার্য, ডক্টর সুধানীল, ডক্টর সাগ্নিক, জনচেতনা মঞ্চের আহবায়ক সন্দীপ রায় এবং ইলোরা দেবনাথ, বিশ্বজিৎ মিত্র, সমর চ্যাটার্জি সহ অভয়া মঞ্চের অন্যান্য সদস্যরা।
প্রতিনিধি দল কলকাতা থেকে সকালে রওয়ানা হয়ে দুপুর একটা নাগাদ প্রথমে আই কিউ সিটি হাসপাতালে পৌঁছায়। হাসপাতাল ক্যাম্পাস খোলা থাকলেও এডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিং সহ সমস্ত বিল্ডিং তালা দেওয়া ছিল। স্থানীয় মানুষ, রাজনৈতিক দলের কিছু প্রতিনিধি, সাংবাদিক এবং অভয়া মঞ্চের প্রতিনিধিরা বহুক্ষণ অপেক্ষা করেও কর্তৃপক্ষের দেখা পান নি। এখান থেকে জে পি ডি এবং অভয়া মঞ্চের প্রতিনিধিরা ডিস্ট্রিক্ট কমিশনার অফ পুলিশের অফিস অরবিন্দ থানায় যান। দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টার প্রতীক্ষার পর মাত্র তিন জন প্রতিনিধি- ডক্টর পুণ্যব্রত গুণ, ডক্টর উৎপল বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ডক্টর শতাব্দী মিত্র ভিতরে যাবার অনুমতি পান। তাঁরা একটি মেমোরান্ডাম জমা দেন যেখানে রাজনৈতিক প্রভাবহীন, দ্রুত, নিরপেক্ষ তদন্ত এবং প্রকৃত দোষী দের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানানো হয়। নির্যাতিতা ও তার পরিবারের সুরক্ষা এবং তদন্তের তথ্যসুত্রের যথাযথ সংরক্ষণের দাবি ও জানানো হয় এই মেমোরান্ডামে। কয়েক জন সন্দেহ ভাজন কে দ্রুত গ্রেফতার করে ফেলেই পুলিশ প্রশাসনের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়না এই কথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়ে আসেন প্রতিনিধিরা।
গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করা যায় যে পুলিশ প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদতে একটি রাজনৈতিক দল ভিন রাজ্য থেকে আসা নির্যাতিতার অসহায় বাবার স্বঘোষিত অভিভাবকত্ব গ্রহণ করে তাঁকে কোন ভাবেই অভয়া মঞ্চ ও জে পি ডি র চিকিৎসক প্রতিনিধি দের সঙ্গে দেখা করতে বা কথা বলতে দেয় না। প্রশাসনের মনোভাব অভয়া কাণ্ডের মত দুর্গাপুর কাণ্ডেও শাসক দলের সঙ্গে এই বিশেষ রাজনৈতিক দল টির যোগাযোগের ইঙ্গিত বহন করে।
থানায় ডেপুটেশনের পর প্রতিনিধি দল আবার কলেজ ক্যাম্পাসে ফেরেন ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে দেখা করতে। পুলস্ত্য, সাগ্নিক, সুধানীল, সায়ন্তনী প্রমুখ জুনিয়র চিকিৎসক রা দুপুর থেকেই দফায় দফায় আলোচনায় বসেন ছাত্রছাত্রী দের সঙ্গে। ছাত্র ছাত্রী রা নিজেরা একটি জেনেরাল বডি মিটিং করে। জে পি ডি এবং অভয়া মঞ্চের প্রতিনিধি দল ছাত্রছাত্রী দের সঙ্ঘবদ্ধ হবার পরামর্শ দেন। ডক্টর পুণ্যব্রত গুণ বলেন স্টুডেন্টস ইউনিয়ন বা কাউন্সিল তৈরি করা খুব প্রয়োজন। স্টুডেন্টস ইউনিয়ন মানে শুধু একটা নির্দিষ্ট ঘর আর ঘরে বসে বিনোদন নয়, স্টুডেন্টস ইউনিয়ন এর কাজ হল ছাত্র ছাত্রী দের অন্যান্য দাবির সঙ্গে নিরাপত্তার দাবি কে সামনে নিয়ে আসা। ডক্টর পবিত্র গোস্বামী বলেন আর জি কর হাসপাতালে ২০২৪ এর আগের আন্দোলন গুলি তে ছাত্রছাত্রীরা সঙ্ঘবদ্ধ হতে পারলে হয়ত অভয়া কে নিহত ও ধর্ষিত হতে হত না। প্রতিনিধি দলের সদস্যরা সব রকম ভাবে আই কিউ সিটির ছাত্র ছাত্রী দের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন।
সন্ধ্যা ৬ টা নাগাদ প্রতিনিধি দল স্থানীয় সংগঠক রোহন শর্মার আমন্ত্রণে দুর্গাপুর সিটি সেন্টারের জাংশন মলে একটি প্রতিবাদী সভায় যোগদান করে। স্থানীয় যুবশক্তির উদ্যোগে বেশ কিছু তরুণ প্রতিবাদী পোস্টার ও শ্লোগান সহযোগে শক্তিশালী প্রতিবাদ সংগঠিত করে জাংশন মল চত্বরে। এই সভায় জে পি ডি ও অভয়া মঞ্চের নেতৃত্ব রা বক্তব্য রাখেন এবং এই উদ্যোগ কে কুর্নিশ জানান। স্থানীয় প্রতিবাদী রা অভয়া মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দুর্গাপুরে সহযোগী সংগঠন গড়ে তোলার আগ্রহ দেখান।
কলকাতা থেকে আসা প্রতিনিধি দল এবং রানীগঞ্জ এবং বর্ধমান প্রভৃতি স্থান থেকে থেকে আসা সংগঠনের বিভিন্ন সদস্যরা অনেক প্রতিকূলতা কে অতিক্রম করে এই প্রতিবাদ কর্মসূচি কে বাস্তবায়িত করে তোলেন। আর জি কর, দুর্গাপুর এবং আরো অসংখ্য অঞ্চলের নির্যাতিতাদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত এই লড়াই চলবে। সব মেয়েদের স্থান,কাল, পোশাকের স্বাধীনতা স্বীকৃত না হওয়া পর্যন্ত এই লড়াই থামবে না। ভয় কে জয় করে সন্ত্রাসের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তোলাই অভয়া মঞ্চের অন্যতম ঘোষিত লক্ষ্য –
“মুক্ত কর ভয়
আপনা মাঝে শক্তি ধর নিজেরে কর জয়”
খুবই প্রয়োজনীয় লেখা ।