খুব সম্প্রতি একটি সরকারি প্রকল্পের কথা কানে এলো – জিসদা খেত,উসদি রেত। কথাগুলো গুরুমুখী ভাষায় বলা হয়েছে তার মানে পঞ্জাব রাজ্য সরকারের ঘোষণা। এর অর্থ হলো জমি যার,রেত বা বালি তাঁর।
পাঞ্জাব – ভারতের অন্যতম কৃষি প্রধান রাজ্য। দেশবিভাগের যন্ত্রণা বুকে বয়ে নিয়েও ভারতের এই রাজ্যটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম হয়েছে। তা বলে সমস্ত সমস্যা দূর হয়েছে এমনটাও কিন্তু মোটেই নয়। গত শতকের ষাটের দশকে ভারতের মাটিতে সবুজ বিপ্লবের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল। পাঞ্জাব ছিল সেই অভিযানের অগ্রপথিক। গোধূমের হাত ধরে তা শুরু হলেও, পরবর্তী সময়ে ধান,ডাল, তৈলবীজ উৎপাদনের ক্ষেত্রেও তার অনিবার্য প্রভাব পড়ে। ভাকরা – নাঙাল প্রকল্পের রূপায়ণের ফলে শুখা মরশুমে পর্যাপ্ত পরিমাণে জলের জোগান সুনিশ্চিত হওয়ায় পাঞ্জাবের কৃষি আর কৃষকদের আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। সবাইকে পেছনে ফেলে পঞ্চ নদীর দেশ পাঞ্জাবের অর্থনীতি এগিয়েছে তরতরিয়ে। কিন্তু চিরদিন তো সকলের সমান যায়না। সময় বদলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হয় কিছু নতুন সমস্যাও। আজকের আলোচনা তেমনই কিছু পাঞ্জাবি কৃষির সমস্যা ও তা থেকে উদ্ধার পাওয়ার সম্ভাব্য উপায় নিয়ে।এই বছর বর্ষার বৃষ্টিতে প্রবল বন্যার কবলে পড়েছিল ভারতের এই অগ্রণী কৃষি রাজ্যটি। ভরা বর্ষায় রাজ্যের ২ লক্ষ হেক্টর কৃষি জমি বন্যাগ্রস্ত হয়, জমিগুলো চলে যায় ভরা প্লাবনের জলের তলায়। জল এখন অনেকটাই নেমে গেছে, তবে ফেলে রেখে গেছে প্লাবনের ক্ষতচিহ্ন। খরিফ মরশুমের ফসলের একটা বড়ো অংশই এখনও জলে গা ভিজিয়ে রয়েছে। রাজ্যের ২৫ টি জেলার সবকটিতেই বন্যার প্রভাব পড়েছিল যা সাম্প্রতিক অতীতের মধ্যে বিরলতম ঘটনা বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
সামনেই এগিয়ে আসছে শীতকাল – রবিখন্দের মরশুম –রাজ্যের প্রধান ফসল গম চাষের সময়। বন্যা পরবর্তী সময়ে মাটির ভৌত রাসায়নিক ও জৈব বৈশিষ্ট্যের ঠিক কেমন পরিবর্তন ঘটেছে তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ ও উৎকন্ঠায় রয়েছেন পাঞ্জাবের কৃষকরা। কৃষির উন্নয়নে মাটির উর্বরতার ভূমিকা অনন্য। বন্যার ফলে সেই ক্ষমতা কতদূর পরিবর্তিত হয়েছে তা নিয়ে চলছে অনুপুঙ্খ অনুসন্ধান ও জল্পনা। বিশেষজ্ঞরা অবশ্য সময়োপযোগী দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। তাঁদের পরামর্শ অনুযায়ী চলছে কাজ। এখন প্রশ্ন হলো বন্যার ফলে মাটির ওপর কী প্রভাব পড়েছে?
এক কথায় এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া অবশ্য বেশ কঠিন। কতগুলো বিষয় এখানে বিচার্য বলে জানিয়েছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা– যেমন বন্যার ধরন, বন্যার স্থায়িত্বকাল, মৃত্তিকার প্রকৃতি ইত্যাদি। তবে সার্বিকভাবে দুই ধরনের প্রভাব লক্ষ করা যায় –প্রথমত – মৃত্তিকার ক্ষয়। বন্যার ফলে মাটির পৃষ্ঠ স্তরের ক্ষতি হয় সবথেকে বেশি। এই স্তরেই ফসলের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি মৌলের সিংহভাগ যেমন নাইট্রোজেন, ফসফরাস ও কার্বন পাওয়া যায়। ফসলের পক্ষে এইসব উপাদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো ধুয়ে গেলে মাটির উৎপাদিকা শক্তির ওপর গভীর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।দ্বিতীয়ত –মাটির ওপর জমা হওয়া পলির প্রকৃতি। বন্যার জলের সঙ্গে বয়ে আসে বিপুল পরিমাণ পলি বা বহিরাগত উপাদান। এগুলো মৃত্তিকার ওপরে জমা হয়ে তাকে সম্পূর্ণভাবে ঢেকে ফেলে। এবারের বন্যায় ঠিক এমনটাই ঘটেছে পাঞ্জাবের কৃষি জমির ক্ষেত্রে। নদীর একদম লাগোয়া এলাকার মাটি যা অত্যন্ত উর্বর প্রকৃতির, ঢাকা পড়েছে বহিরাগত উপাদানের দ্বারা। এই আবরণী যদি পলি হয় তাহলে তা জমির উৎপাদন ক্ষমতাকে বাড়িয়ে দেয়। ফলে
বাড়তি কোনো উর্বরকের সাহায্য ছাড়াই জমিতে গড় ফলনের সম্ভাবনা বেড়ে যায় । অবশ্য পলল সঞ্চয়ের মাত্রা বেশি হলে তা ফসলের শিকড়ের প্রসার রোধ করে এবং এর দরুণ উৎপাদন ব্যাহত হয়। তবে এই মাটিতে খুব ভালো করে লাঙ্গল দিয়ে উল্টে পাল্টে পুরনো চাপা পড়া মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পারলে তা আবার খুব কার্যকর হয়ে উঠবে।
এছাড়া জমিতে অনেক দিন ধরে জল জমে থাকলে মাটির কণাগুলো অনেকটাই সংবদ্ধ হয়ে যায়। এরফলে মাটির ভেতর দিয়ে বাতাস চলাচল করতে পারে না এবং ফসলের জন্য উপযোগী পুষ্টিমৌলের জোগানে টান পড়ে।কৃষিজমির এমন হাল দেখে তৎপর হয়ে উঠেছে পাঞ্জাব রাজ্যের কৃষি দফতর। পাঞ্জাব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহায়তায় তাঁরা নতুন করে মাটির নমুনা সংগ্রহের কাজে নেমেছে। ইতোমধ্যেই বেশ কিছু জেলায় মাটি পরীক্ষা করে গবেষকরা জানিয়েছেন যে,পলি জমার ফলে মাটির উর্বরতার ওপর প্রভাব পড়েছে ঠিকই, তবে তা পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা একেবারে অসম্ভব নয়। সুতরাং সম্পূর্ণভাবে আশাহত হতে হয়তো হবেনা। নিঃসন্দেহে ভালো কথা।
তবে জমিতে দীর্ঘ দিন ধরে জল জমে থাকার কারণে নাইট্রোজেনের মতো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ধুয়ে গিয়ে মাটির গভীরে গিয়ে জমা হয়েছে।এর ফলে মাটির pH মাত্রায় পরিবর্তন ঘটেছে । উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে এই সমস্ত পরিবর্তনের সমস্যাকে কাটিয়ে ওঠার কথা বলেছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা। সকলেই নিবিড় কর্ষণের ওপর জোর দিয়েছেন।জমির স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে সরকারের তরফ থেকে জমি যার , বালি তাঁর প্রকল্পের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। এই প্রকল্পের সুবিধা নিতে অনেক কৃষকই উৎসাহিত হয়েছেন। জমিতে ট্রাক্টর নামিয়ে বালি তুলে তা বিক্রি করতে আগ্রহী হচ্ছেন অনেকেই। মূল উদ্দেশ্য হলো রবি ফসলের জন্য নিজেদের জমিকে সবদিক থেকেই প্রস্তুত করা। রবিখন্দের ফসলের উৎপাদন ঠিকঠাক হলে তা বন্যার ক্ষয়ক্ষতিকে অনেকটাই সহনীয় করে তুলবে। তাই জোরকদমে কাজ চলছে রাজ্য জুড়ে। বন্যার কারণে পাঞ্জাবের কৃষির স্বাভাবিক ছন্দের তাল কেটেছে খানিকটা সন্দেহ নেই , তাই সেখানকার কৃষিজীবী মানুষেরা চাইছেন অতিদ্রুত রাজ্যের কৃষির হারিয়ে যাওয়া সেই সুর লয় তাল আর ছন্দকে ফিরে পেতে ।
তাই কোমর বেঁধেছেন সকলেই।সরকারও চাইছে স্বাভাবিকতা ফিরে আসুক। চাইছি আমরাও। কৃষি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন মূল ফসল গমের আগে কৃষকরা কিছু স্বল্পকালীন ফসলের চাষ করুন যেগুলো চটজলদি বিকিয়ে যাবে বাজারে, পকেট ভরবে সেই অর্থে। লাভবান হবেন কৃষকরা।
বন্যা জনিত পরিস্থিতি নতুন কিছু নয় পাঞ্জাবের কৃষি ব্যবস্থায়। এবার নয়া উত্তরণের কাহিনি লেখা হোক পাঞ্জাবের মাটিতে।
অক্টোবর ১৫. ২০২৫.