সোনম ওয়াংচুক ১৯৬৬ সালের ১লা সেপ্টেম্বর লাদাখের আলচি গ্রামের কাছে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর গ্রামে কোনো স্কুল ছিল না, তাই নয় বছর বয়স পর্যন্ত মায়ের কাছেই শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। পরে তাঁকে শ্রীনগরে পাঠানো হয় স্কুলিং এর জন্য, যেখানে ভাষা ও সংস্কৃতিগত পার্থক্যের কারণে শুরুতে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। সোনম ১৯৮৭ সালে শ্রীনগরের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি (তৎকালীন রিজিওনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ) থেকে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ স্নাতক হন। পরবর্তীতে তিনি ফ্রান্সের গ্রেনোব্ল শহরে ক্রাটেরে স্কুল অফ আর্কিটেকচার থেকে Earthen Architecture বিষয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জন করেন।
১৯৮৮ সালে তিনি সহপাঠীদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন SECMOL (Students’ Educational and Cultural Movement of Ladakh)। এই সংগঠনের লক্ষ্য ছিল লাদাখের শিক্ষা ব্যবস্থাকে স্থানীয় চাহিদা ও সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা। পরে তিনি ‘অপারেশন নিউ হোপ’ কর্মসূচি চালু করেন, যা গ্রাম, সরকার ও নাগরিক সমাজের যৌথ উদ্যোগে সরকারি বিদ্যালয়গুলোর সংস্কার আনে।
১৯৯৩ সালের জুন মাস থেকে ২০০৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত সোনম ওয়াংচুক লাদাখের একমাত্র প্রিন্ট ম্যাগাজিন ‘লাদাগস মেলং’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছিলেন। ২০০১ সালে তিনি হিল কাউন্সিল সরকারের শিক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত হন। ২০০২ সালে তিনি অন্যান্য এনজিও প্রধানদের সঙ্গে মিলে লাদাখ ভলান্টারি নেটওয়ার্ক (LVN) প্রতিষ্ঠা করেন এবং ২০০৫ সাল পর্যন্ত এর কার্যনির্বাহী কমিটিতে সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৪ সালে তিনি লাদাখ হিল কাউন্সিল সরকারের ভিশন ডকুমেন্ট ‘Ladakh 2025’-এর খসড়া প্রণয়ন কমিটিতে নিযুক্ত হন এবং সেখানে শিক্ষা ও পর্যটন নীতিমালা প্রণয়নের দায়িত্ব পান। ২০০৫ সালে ভারতের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং আনুষ্ঠানিকভাবে এই নথি প্রকাশ করেন। একই বছরে, ওয়াংচুককে ভারতের মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের অধীনে প্রাথমিক শিক্ষার জন্য গঠিত জাতীয় পর্ষদে সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
২০১৩ সালের শেষের দিকে সোনম ওয়াংচুক “আইস স্তূপা” নামক একটি প্রোটোটাইপ আবিষ্কার ও নির্মাণ করেন। এটি এক ধরনের কৃত্রিম হিমবাহ, যেখানে শীতকালে নষ্ট হয়ে যাওয়া ঝরনার জলকে বিশাল বরফের শঙ্কু বা স্তূপ আকারে সংরক্ষণ করা হয় এবং বসন্তের শেষে ধীরে ধীরে গলতে শুরু করলে সেই জল কৃষকদের জন্য প্রয়োজনীয় সময়ে সেচের কাজে ব্যবহার করা যায়।
২০১৩ সালে তাঁকে জম্মু ও কাশ্মীর স্টেট বোর্ড অফ স্কুল এডুকেশনের সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১৪ সালে তিনি জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের শিক্ষা নীতি ও ভিশন ডকুমেন্ট প্রণয়নের জন্য গঠিত বিশেষজ্ঞ প্যানেলে সদস্য হিসেবে নিযুক্ত হন।
২০১৫ সাল থেকে সোনম ওয়াংচুক হিমালয়ান ইনস্টিটিউট অফ অল্টারনেটিভস প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দেন। তাঁর উদ্বেগ ছিল যে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ করে পাহাড়ি অঞ্চলের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, বাস্তব জীবনের প্রয়োজনের সাথে প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে।
২০১৬ সালে তিনি ‘FarmStays Ladakh’ নামে একটি প্রকল্প শুরু করেন, যার মাধ্যমে পর্যটকরা লাদাখের স্থানীয় পরিবারে থেকে তাদের সংস্কৃতি ও জীবনযাপন অভিজ্ঞতা করতে পারেন। এই প্রকল্পটি মূলত স্থানীয় মায়েদের ও মধ্যবয়সী মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত হয়।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সোনম ওয়াংচুক ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য সৌরশক্তি চালিত তাঁবু তৈরি করেন। প্রতিটি তাঁবুতে প্রায় ১০ জন সেনা থাকতে পারেন। ওয়াংচুকের মতে, তিনি এই উদ্ভাবনের ধারণা পান যখন জানতে পারেন যে প্রায় ৫০,০০০ ভারতীয় সেনা কঠিন আবহাওয়ার পরিস্থিতিতে উচ্চভূমি এলাকায় কর্মরত আছেন। এই আবিষ্কার দিনে সূর্যালোক থেকে তাপশক্তি সঞ্চয় করে এবং সেই শক্তি রাতে ব্যবহার করে তাঁবুকে উষ্ণ রাখে।
তিনি ২০০২ সালে Ashoka Fellowship, ২০১৬ সালে Rolex Awards for Enterprise, ২০১৭ সালে Global Award for Sustainable Architecture, ২০১৮ সালে রামন ম্যাগসেসে পুরস্কারে সম্মানিত হন। তাঁর জীবন ও কাজকে ঘিরেই আংশিক অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি হয় বলিউড চলচ্চিত্র থ্রি ইডিয়টস-এর ‘ফুনসুখ ওয়াংডু’ চরিত্র।
কিন্তু এই পোড়া দেশে তার কপালে একটা পদ্মশ্রীও জোটে না, জাতীয় শিক্ষা নীতি প্রণয়ন কমিটিতেও তার জায়গা হয়না। চাইলে তিনি নিজেরটুকু বুঝে নিয়ে বিদেশের কোনো শহরে আরামের জীবন কাটাতে পারতেন, কিন্তু নিজের লোকেদের জন্য কিছু করার বাসনা যে বড় তীব্র।
বিজেপি ২০২০ সালের লাদাখ অটোনোমাস হিল ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিল, লেহ নির্বাচনের ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে লাদাখকে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। সেই প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতেই তারা ২৬টি আসনের মধ্যে ১৫টি আসন জিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে। কিন্তু দীর্ঘ পাঁচ বছর কেটে গেলেও কোনো প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি।
এই বছরের নির্বাচনের আগে সোনম ওয়াংচুক শুধু একটি সঠিক ও সৎ প্রশ্ন তুলেছিলেন: “কোথায় সেই প্রতিশ্রুতি যা তোমরা দিয়েছিলে?” — সেই প্রশ্ন, যা আমাদের অধিকাংশই সরকারের কাছে করতে ভয় পাই।
আর ফলাফল কী হলো? এক সময় যে মানুষকে নায়ক, সংস্কারক ও আশার প্রতীক হিসেবে দেখা হতো, রাতারাতি তাকেই দেশদ্রোহী, ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’ আখ্যা দেওয়া হলো। ক্ষমতাসীনদের সামনে সত্য বলা কত সহজেই প্রশংসাকে নিন্দায়, শ্রদ্ধাকে অপমানে পরিণত করে দেয়। সোনম আজ জাতীয় সুরক্ষা আইনের আওতায় হেফাজতে। ED, CBI সবই লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে। সরকারের সুরে যতদিন সুর মিলেছে, ততদিন সব ছিল ঠিক। আজ চার বছর আগের হিসেবে তিন লাখ টাকা গড়মিলের অজুহাতে লাইসেন্স বাতিল হচ্ছে। সরকারের লিজে দেওয়া জমি রাতারাতি ফিরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
ক্ষমতা আজীবন থাকবে না। কিন্তু এই দেশ থাকবে। এই দেশের মানুষ থাকবে। মানুষ সব মনে রাখবে।
সংগৃহীত