(একটু বুঝি বড় লেখা হয়ে গেলো, পড়ে ফেলেন কষ্টেসৃষ্টে)
রাতদুপুরে যখন বসলাম চেয়ারে, প্রথমেই এলেন একজন পেটব্যথার রোগী। আজ সারাদিনই তার পেট ব্যথা করছে, তবু তিনি নিজস্ব পদ্ধতিতে ওষুধ খেয়ে রাতের কোটার, ওই ইয়ে, মানে খানিক বলবর্ধক “টনিক” খেয়ে শুয়েছিলেন; কিন্তু যন্ত্রণায় ঘুম ভেঙ্গে গেছে, তাই হাসপাতালে। কতটা খেয়েছিলেন, জিজ্ঞেস করায় বললেন, ওই সামান্য, এক পেগ হবে! সঙ্গী বন্ধু আবার হাত দিয়ে সেটাও এত ছোট করে দেখালেন যে “হাফ পেগ”ও মনে হবেনা।
যা হোক, কিছু ইনজেকশন লিখে অবজারভেশন ওয়ার্ডে শুয়ে থাকতে বললাম।
পরের জন, এক তরুণী ব্লেড দিয়ে বাঁ হাত ফালাফালা করেছেন, (বোঝা গেলো ইনি ডানহাতি!) আত্মহত্যার চেষ্টা নাকি নিজে নিজের ক্ষতি করার চেষ্টা, সেই হিসেবনিকেশ শিকেয় তুলে ভর্তি করে দিলাম। ভর্তি হতে চাইছিলেন না, পরশু পরীক্ষা আছে বলে। বললাম.. আজ রাতটুকু থেকে কাল ঠিক কোরো!
একটু বাদে, একজন দেহাতি, (কথাবার্তায় যা মনে হলো, কষ্ট করে ভাঙ্গা হিন্দি বলতে হলো!) পরিবার নিয়ে কোথাও খাওয়া দাওয়া করতে গিয়ে নিজে অতিমাত্রায় মদ্যপান করে ফেলেছেন, এবং সম্ভবত: কিছু অযাচিতভাবে করে ফেলায়, মোটা ডান্ডা জাতীয় কিছু দিয়ে কেউ তার দু হাতে কব্জির উপরে বেজায় বাড়ি মেরেছে, একটি অন্তত: ভেঙেছে বলে মনে হল। এক্স-রে করতে দিয়ে, প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা লিখে ভর্তি করে দিলাম। বাচ্চা দুটোর হাতে তখনও এলুমিনিয়াম ফয়েলে মোড়া রুটির গোছা!
এরপরে, এক ভদ্রমহিলা সপরিবারে এলেন। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত। অনেকদিনের উচ্চ রক্তচাপের রোগী। কিন্তু, নিয়মিত চিকিৎসা হয় না, গ্রামের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বাইরে কোথাও যান না, আর অসুবিধা বাড়লেই সাধারণত: ওষুধ খান! এখন রক্তচাপ রীতিমত বেশী, ঘাড়ে অসহ্য ব্যথা, আধঘন্টা আগে অনেকটা বমিও করেছেন। মাসকয়েক আগেও এমন হয়ে ভর্তি হয়েছিলেন, কিন্তু তারপরেও চিকিৎসা…? বাড়ীর বউরা বোধহয় এরকমই, এখনও চিকিৎসার ক্ষেত্রে অবহেলিতই হন! একথা বললাম আরও এই কারণে, যে ওনাকে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা ও চিকিৎসা লিখে ভর্তি করার পরেই ওনার স্বামী বললেন, আমারও তো এরকম ঘাড় ব্যথা হয়! কেঠো হেসে বললাম, রক্ত চাপ মাপুন, হাড়ের ক্ষয় থেকেও হয়, সবার এক কারণে এক উপসর্গ হয় না।
এরমধ্যে পেট ব্যথার রোগী সুস্থ। তাকে ছেড়ে দিতে বললাম। আবার ব্যথা উঠলে কি করবেন জিজ্ঞাসা করায়, একটা ওষুধ লিখে দিলাম, আর কাল মেডিক্যাল আউটডোরে আসতে বললাম। ভদ্রলোক ও তার জনা-চারেক সঙ্গীর আমাকে কোনো কারণে বেশ ভালো লেগে গিয়েছিল, একজন আমার ব্যক্তিগত চেম্বারের কথা জিজ্ঞেস করায় বললাম, … তার কি দরকার?! আর আমি তো আসলে মানসিক রোগের চিকিৎসা করি!! বেশ আঁতকে উঠে চলে গেলেন।
পরেরজন শ্বাসকষ্ট। বাড়ীর লোক বললো, এরকম ওনার মাঝেমাঝে হয়। Oxygen Saturation কিছুটা কমের দিকে, তাই Oxygen দিতে বলে, ওষুধপত্তর লিখে ওয়ার্ডে পাঠালাম।
এই “রাত জাগা” চলছে, আরেকটু পরে ভোর ভোর dialysis- এর রোগীরা আসবেন, ছয় জন। এদেরকে ছটি মেশিনে তোলা হবে। প্রাথমিক কাগজটুকু শুধু করে দিতে হবে।
……….. এই ভাবেই চলে আমাদের “রাত জাগা” কিংবা “রাত-দখল”, প্রতি রাতে। শয়ে শয়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে, গ্রামীণ হাসপাতালে, মহকুমা বা জেলা হাসপাতালে, মেডিক্যাল কলেজে, বেসরকারী হাসপাতালেও। ইমার্জেন্সিতে অপেক্ষাকৃত অরক্ষিত পরিবেশে শুধু নয়, ওয়ার্ডের সুরক্ষিত আশ্রয়েও!! চলে ৩৬৫দিন, ২৪ ঘণ্টা। কোথাও আপনারা সন্তুষ্ট হন, রোগী সুস্থ হওয়ায়। কোথাও বিরক্ত হন ব্যবহারে বা পরিষেবার ঘাটতিতে, রাগ পুষিয়ে দেন আমাদের উপর, এমনকি চড়াও হয়ে, গালিগালাজ, মারধরও চলে, নিকটাত্মীয় মারা গেলে! কিন্তু, সবকিছু আমাদের হাতে নয়, আর ভুল আমাদেরও হতে পারে, যে কোনো মানুষের মতো, আমরা তো আসলে দিনের শেষে “মানুষ”ই একজন!
বলতে বলতে আরেকজন চলে এলো। কমবয়সী মেয়ে। পেটের একটি নির্দিষ্ট জায়গায় ব্যথা… ভর্তি করলাম। রাতের বেলা আসলে একটু defensive থাকি। অন্যসময় হয়তো ওষুধ লিখে, কিছু পরীক্ষা করে আসতে বলতাম!
…. যা হোক, যেকথা বলছিলাম, আমাদের এই বহুজনের প্রতিদিনের “রাত দখল” অনেকটাই অরক্ষিত পরিবেশে (এখন অবশ্য একটু অবস্থার উন্নতি হয়েছে, আজ তো দুজন ওয়ার্ডবয়, আর দুজন পুলিশ কনস্টেবল আমার সাথে রাত জাগছে!) সবই সেই মেয়েটার দৌলতে, সেই মেয়েটা যে অনেক সুরক্ষিত পরিবেশে ওয়ার্ডের মধ্যে নৃশংসভাবে খুন হয়ে গেল সাত মাস আগে, এই “রাত জাগা”র ডিউটিতে!
কত কলরব হল, কত মিছিল মিটিং, সব স্তিমিত হয়ে গেল, সময়ের অমোঘ নিনাদে! রহস্য তবু ভেদ হল কি? অমীমাংসিত প্রশ্নগুলোর সব উত্তর মিলল কি?? একজনকে বিচারপতি শাস্তি দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তিনিও তদন্তের “অসঙ্গতি” চিহ্নিত করেছেন, আরও বেশ কিছু কি “সাজার” বা “বিচারেরই” আওতার বাইরে থেকে গেল???
প্রতি রাতজাগার দিনে প্রশ্নগুলো আরও ফিরে ফিরে আসে… অসহায় লাগে… আপনারা যারা একসাথে রাস্তায় নেমেছিলেন সেদিন, “we want justice” এর স্লোগানে স্লোগানে রাজপথ ভরিয়ে দিয়েছিলেন, তারা সবাই কি নিজের নিজের জীবনে ফিরে গেছেন, ভুলে গেছেন, সঠিক বিচার অপূর্ণ থাকার সব কষ্ট??!!
রাত জাগা শেষ হয়, ভোরের আলো নামে, কিন্তু মনের এই অন্ধকার তো সবসময়, গুনগুনিয়ে প্রশ্ন তুলে যায় আমার বা আরও অনেকের সচেতন অস্তিত্বের কাছে!!
/\/\/\/\/\/\/\/\/\/\/\/\/\/\/\/\/\/\/\/\/\/\/\/
তবু, রাত জাগি, নিয়ম মেনে, নীরব লজ্জায়!!
_________________________________
(ছবিটি INTERNET থেকে সংগৃহীত, চিত্রকরের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী, না জানিয়ে ব্যবহারের জন্য)









