এই ২৬ হাজার ছেলেমেয়ের চাকরি যাওয়ার জন্য বিরোধীদের দায়ী করছেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রাক্তন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যদের দুষছেন। অবশ্য এছাড়া পিঠ বাঁচানোর অন্য কোনো উপায় নেই।
এই আইন আদালত কিছুরই তো প্রয়োজন হত না যদি মুখ্যমন্ত্রী আগেই সক্রিয় হতেন। হাজার হাজার যোগ্য অথচ বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থী ছেলেমেয়ে বছরের পর বছর শিক্ষাদুর্নীতি নিয়ে চিৎকার করেছে, শিক্ষামন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীকে বস্তা বস্তা স্মারকলিপি দিয়েছে, আমরণ অনশন করেছে, রাস্তায় রাস্তায় মাথাখুঁড়ে মরেছে মুখ্যমন্ত্রী পাত্তাই দেননি। আমি ২০১৯ সে ওদের আমরণ অনশন মঞ্চে গিয়ে দেখেছি ওদের দাবিগুলো। ওরা বারবার আবেদন করেছে যাতে মেধা তালিকা প্রকাশিত হয়। ওরা দেখাচ্ছিল কীভাবে অনেক পেছনের প্রার্থীরা চাকরি পেয়েছে। ওরা মন্ত্রী পরেশ অধিকারীর মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারীর বেআইনি চাকরি পাওয়ার কথা বলছিল, টাকার বিনিময়ে চাকরি বিক্রির কথা বারবার বলছিল। এসব পুরোটাই ওরা জানিয়েছিল মুখ্যমন্ত্রীকে। সংবাদ মাধ্যমেও বারবার প্রকাশিত হয়েছে ওদের দাবিদাওয়া, এইসব দুর্নীতির অভিযোগ। মুখ্যমন্ত্রী পাত্তাই দেননি। উনি যদি তখন তদন্তের করে, সততার সঙ্গে সকল দুর্নীতিপরায়ণদের গ্রেফতারের নির্দেশ দিতেন তাহলে বিষয়টা আদালত পর্যন্ত গড়াতো কি?
২০১৯-এ লোকসভা নির্বাচনের আগে আগে বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের আমরণ অনশন যখন ২৬ দিনে পড়েছিল মুখ্যমন্ত্রী খানিক প্যাঁচে পড়ে গিয়েছিলেন। তাই অনশন তোলার জন্য অনশন মঞ্চে গিয়ে উনি তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী যার বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ, তাকেই একটা কমিটি করে বিষয়টা দেখতে বলেন। অনশন উঠে গেল, নির্বাচন বৈতরণী পার হয়ে গেল ব্যাস। পুরোটাই ধামাচাপা।
এই ছেলেমেয়েগুলো কিন্তু আন্দোলন থামায়নি। আবার সংগঠিত হয়েছে। আবারো রাস্তায় পড়ে থেকেছে। মুখ্যমন্ত্রী খোঁজটুকু নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। শুধু মাঝে মধ্যে আন্দোলন তীব্র হলে পুলিশ দিয়ে একটু পিটিয়ে দিয়েছেন বেয়াদগুলোকে। ওরাতো মুখ্যমন্ত্রীর কাছেই ন্যায়বিচার চেয়েছিল। কিন্তু তাঁর এরূপ আচরনের পর আদালত ছাড়া ওদের কাছে ন্যায় বিচারের কোনো পথ খোলা ছিল কি? আদালত সিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ না দিলে এত বড় দুর্নীতি, এত বড় অপরাধ সামনে আসতো?
মুখ্যমন্ত্রী পেছনের দরজা দিয়ে যারা চাকরি পেয়েছে তাদের খুঁজে বার করার চেষ্টা করেননি উল্টে সিবিআই তদন্তে যখন এরকম সাত হাজার জাল শিক্ষক পাওয়া গেল এবং হাইকোর্টের নির্দেশে তাদের চাকরি বাতিল হল তখন তাদের বাঁচানোর জন্য গোটা মন্ত্রীসভাকে কাজে লাগিয়ে অতিরিক্ত পোস্ট বা সুপার নিউমেরারি পোস্ট বানানোর চেষ্টা করলেন। ভাবলেন না আযোগ্য কিছু লোক যারা সাদা খাতা জমা দিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়ে শিক্ষক হয়েছে তাদের হাতে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের শিক্ষার ভার তুলে দেওয়া কতবড় অপরাধ! হ্যাঁ যে মুখ্যমন্ত্রী আজ কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করে চলেছেন তিনি এসব ঘটিয়েছেন।
হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্ট বারবার এসএসসিকে বলেছেন যোগ্য অযোগ্য পার্থক্য করে দিতে। তারা তা করেনি। একেক সময় একেক তথ্য দিয়ে আদালতকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। দুই কোর্টে এই বিচারপ্রক্রিয়া চলেছে বছরের পর বছর। রাজ্য কিন্তু এতাবৎ এসএসসি যাতে প্রকৃত তথ্য দিয়ে যোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের বাঁচানোর চেষ্টা করে সে ব্যাপারে কোন উদ্যোগ নেয়নি। অথচ গতকাল আশ্চর্য হয়ে দেখলাম মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, তাঁদের নাকি আরও সময় দেওয়া উচিত ছিল! তাহলে তাঁরা স্টাডি করে দেখতেন, আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্যও সময় দিতে হয় ইত্যাদি। কী মজার ব্যাপার তাই না!
আযোগ্যদের বাঁচানোর জন্য সরকার বা এসএসসি কেউই চায়নি যোগ্য অযোগ্য প্রকৃত পৃথকীকরণ। এই বেপরোয়া মনভাবের কারণ সম্ভবত দুটো। প্রথমত এরা বোধহয় ভাবেননি পুরো প্যানেল শেষ পর্যন্ত বাতিল হবে। আর দ্বিতীয়ত বাতিল যদি হয়ও তাহলে বলা যাবে কোর্ট বাতিল করেছে আমরা কী করতে পারি! দায় কোর্টের, দায় বিরোধীদের। যোগ্য চাকরিরতদের চোখের জল তখন অপরাধ আড়ালের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। ঠিক সেটাই এখন শুরু করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
কিন্তু এতগুলো বছর ধরে হাজার হাজার যোগ্য অথচ বঞ্চিত প্রার্থীদের চোখের জলের পাশে দাঁড়ালেন নাতো! তাহলে আজকের এই পরিস্থিতি তৈরিই হতো না। নিজের দলের নেতা মন্ত্রীদের টাকা নিয়ে চাকরি বিক্রিকে নির্লজ্জভাবে আড়াল করে একটা প্রজন্মকে ধ্বংস করে দিলেন! ধংসের কিনারে এনে দিলেন গোটা রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থাকেই।
যোগ্যদের চোখের জল আর বঞ্চিতদের অশ্রুর মাঝে শুধু দ্বীপের মতো জেগে রইল শাসকের নির্লজ্জ চুরি, দুর্নীতি, অসীম লোভ আর অনর্গল মিথ্যভাষণের নির্মম ইতিহাস।









