কথারম্ভঃ অতীতে আমরা পরিবেশ দূষণ জনিত (Environmental Pollution) পাহাড় ও সমতলে মেঘভাঙ্গা বৃষ্টি (Cloud Burst) ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস (Tidal Waves) বৃদ্ধি; সিকিম ও দার্জিলিং পাহাড়ের মারাত্মক ধ্বস; জল বিদ্যুতের কথা বলে তিস্তা সহ পাহাড়ি নদীগুলির স্বাভাবিক গতিরোধ করার জন্য ভয়ানক হড়পা বান (Flash Flood); উত্তরবঙ্গের প্রবল বন্যা; ফারাক্কা ব্যারেজের সমস্যা সহ মালদা – মুর্শিদাবাদের ভয়ঙ্কর নদীর পাড়ের ভাঙ্গন; নিম্ন গাঙ্গেয় সমভূমিতে বছরে অন্তত দুবার মানবসৃষ্ট ভয়াল বন্যা; সুন্দরবন ও সমুদ্র উপকূল অঞ্চলের সাঙ্ঘাতিক ঘূর্ণিঝড় (Cyclone), জলোচ্ছ্বাস, বাধ ভেঙ্গে বন্যা ও নোনা জলের প্রবেশ; গার্ডেনরিচের ঘটনা সহ অপরিকল্পিত নগরায়ন (Unplanned Urbanization) ও দুর্নীতির কারণে বহুতল ভেঙ্গে পড়া – প্রভৃতি রাজ্যের গভীর অসুখগুলির কারণ, প্রশমন (Mitigation), প্রতিরোধ (Prevention) ও প্রতিকার (Remedy) নিয়ে আলোচনা করেছি।
এবার আমরা আলোচনা করব আমাদের রাজ্যের রাজধানী, মহাশক্তিধর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সর্ববৃহৎ ভারতীয় উপনিবেশের প্রাক্তন রাজধানী, প্রাচ্যের ‘লন্ডন’, ৩৩৫ বছরের প্রাচীন কলকাতা মহানগরীর জলজমার যন্ত্রণা লাঘব ও প্রশমনের বিষয়ে। আম্পানের মত প্রলয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় কিংবা অতিবৃষ্টির কথা ছেড়ে দিন, কিছুক্ষণ বৃষ্টি হলেই অপরিকল্পিত নগরায়নের জঞ্জালের (এগুলি থেকে বিপুল মুনাফা অর্জন করে চলা নেতা – মন্ত্রীদের কথায় উন্নয়নের জোয়ার) বোঝা এবং মুখ থুবড়ে পড়া নিকাশি ব্যবস্থার দৌলতে ‘তিলোত্তমা’ কলকাতা যেভাবে ‘নরকতমা’ য় পরিণত হয়েছে তা বোধহয় কাউকে বুঝিয়ে বলতে হবেনা। জুনে বর্ষার শুরু থেকে অক্টোবর পর্যন্ত টানা পাঁচ মাস ধরে এবং অন্য সময়ে মাঝেমাঝে বঙ্গোপসাগরে নিম্ন চাপ (Depression) সৃষ্টি হয়ে বারবার এই ঘটনা ঘটে গিয়ে কলকাতাবাসীকে ধারাবাহিক দুর্বিপাকে ফেলে দিচ্ছে। আবার এই জল জমাকেই কেন্দ্র করে জন্ম নিচ্ছে শিশুর ডুবে মৃত্যু, পথ দুর্ঘটনা ও বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যু সহ নানাবিধ প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা এবং নানারকম আন্ত্রিক রোগ, জণ্ডিস, ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, লেপটোস্পাইরেসিস, চামড়ার রোগ ইত্যাদি। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, উৎপাদন, পরিবহন সহ নাগরিক পরিষেবা প্রচন্ডভাবে ব্যহত হচ্ছে। রাজ্য সরকার এবং নাগরিকদের কষ্টার্জিত স্থায়ী সম্পদগুলিও নষ্ট হচ্ছে। অথচ সারা বছর মিথ্যাভাষণ, তোলাবাজি, লুঠ, উৎসব, মোচ্ছব, মন্দির, হজ, ডোল, ভোট ইত্যাদিতে মেতে থাকা এবং দুর্বল ও নিষ্ক্রিয় বিরোধীদের উপস্থিতি এবং নানাবিধ মিথোজীবী সেটিং এর কল্যাণে পঞ্চায়েত থেকে সাংসদ নির্বাচনে অনায়াসে জয়লাভ করে শাসন ক্ষমতা নিরঙ্কুশ রাখা শাসকরা এই গুরুতর সমস্যাটি নিয়ে ভ্রূক্ষেপই করছেন না।
কিছু পুরনো কথাঃ মেডিকেল ছাত্র থাকাকালীন ১৯৮২ তে সুষ্ঠ স্বাস্থ্য পরিষেবার দাবিতে ‘অল বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টর ফেডারেশন (ABJDF)’ এর নেতৃত্বে আলোড়নকারী জুনিয়র চিকিৎসকদের আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ি। সেইসময় ‘ ক্যালকাটা ন্যাশনাল ওয়েলফেয়ার অর্গানাইজেশন (CNWO)’ নামক একটি সংগঠনের মাধ্যমে শহরের বস্তী ও প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়া এবং স্বাস্থ্য সমীক্ষার কাজ চলত। এছাড়াও বন্যা সহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে টিম পাঠানো হত। মধ্যপ্রদেশের ভোপালের গ্যাস লিক এবং অসমের নেলি দাঙ্গায় টিম পাঠানো হয়েছিল। CNWO এর তরফ থেকে ‘পিপলস হেলথ’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করা হত। এই পত্রিকার কাজে একদিন ABJDF নেতা ডাঃ পাঠকের সঙ্গে আন্দোলনকারী ইঞ্জিনিয়ার দের সংগঠন ‘ফেটো’ র নেতা বিশিষ্ট স্থপতি ও টাউন প্ল্যানার চিররঞ্জন দত্তের গৃহে উপস্থিত হয়েছিলাম। চিরদা বলেছিলেন ভূমির ঢাল অনুযায়ী কলকাতাটা হওয়া উচিত ছিল গঙ্গা বা হুগলী নদীর পশ্চিম পাড়ে। হয়েছে ঠিক উল্টো টা। বিশিষ্ট পরিবেশরক্ষক ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ, কলকাতাকে বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রে যার অবদান অসামান্য, আমৃত্যু চেষ্টা করে গেছেন কলকাতার পরিবেশ বাঁচাতে কলকাতার ফুস্ফুস ও বৃক্ক (Kidneys) পূর্ব কলকাতার জলাভূমিকে (East Kolkata Wetlands, A Ramsar Site) স্থানীয় কৃষি ও মৎস্যজীবীদের সঙ্গে নিয়ে রক্ষা করার। বিজ্ঞান ও পরিবেশ আন্দলনের অক্লান্ত যোদ্ধা নবতিপর ডঃ সমর বাগচী আমৃত্যু দূষণ নিয়ন্ত্রণ ও পরিবেশ রক্ষা নিয়ে সর্বত্র ছুটে বেরিয়েছেন। ‘নাগরিক মঞ্চে’র কর্ণধার বর্ষীয়ান নব দত্ত অন্যদের নিয়ে ‘সবুজ মঞ্চ’ গড়ে পরিবেশ বাঁচাতে জান কবুল করেছেন। পরিবেশ বাঁচাতে সুভাষ দত্ত প্রমুখ পরিবেশপ্রেমী বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আইনী লড়াই চালিয়েছেন, তৃণমূল নেতা তপন দত্ত প্রমুখ প্রাণ দিয়েছেন। এরকম আরও অনেকেই চেষ্টা করে চলেছেন।
কিন্তু যাদের মাধ্যমে এগুলি বাস্তবে করা সম্ভব সেই সরকার এবং তার বিভিন্ন দফতর ও মন্ত্রী – আমলা –আধিকারিক, প্রভাবশালী নেতা ও জনপ্রতিনিধি, কলকাতা হাওড়া বিধান নগর ও চন্দননগর পুর নিগম, বাদবাকি পুরসভাগুলি, দূষণ নিয়ন্ত্রণ পরিষদ প্রমুখ রা আর্থিক, রাজনীতিক, দলীয়, নির্বাচনী বা ব্যক্তি স্বার্থে ধারাবাহিকভাবে পরিবেশ দূষণ ও ধ্বংসে মদত দিয়ে কিংবা দেখেও না দেখার ভান করে চলেছেন। এদেরই অনেকের কুপরামর্শ ও কুপরিকল্পনায় স্যাঙ্গাৎ মাফিয়া ও অসাধু প্রমোটর চক্র স্থানীয় থানার সঙ্গে যোগসাজস করে শহরের বিভিন্ন জায়গায় নানা কায়দায় অবশিষ্ট সামান্য গাছপালা, জলাভূমি, নর্দমা, খাল, ফাঁকা জায়গা যেটুকু আছে মেরে, কেটে, ভরাট করে, দখল করে, গায়ে গা লাগানো বহুতল কংক্রিটের জঞ্জাল বানিয়ে চলেছে। যেগুলির বেশিরভাগই বেআইনি , ভূ পরীক্ষা না করে (কলকাতা Severe এবং Moderate Intensity –র Borderline এ Seismic Zone III ও IV এর মধ্যে অবস্থিত) , অগ্নি ও অন্যান্য বিধি না মেনে, এলাকার দুষ্কৃতীদের সিণ্ডিকেটগুলির সরবরাহ করা নিম্ন মানের সামগ্রী দিয়ে তৈরি।
আরও কিছু দরকারি পুরনো কথাঃ দক্ষিণ বঙ্গে দক্ষিণ প্রবাহিনী ভাগীরথী (গঙ্গা) র সঙ্গে পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রবাহিনী যমুনার সঙ্গম ছিল ত্রিবেণী (হুগলী) – কল্যাণী (নদীয়া) অঞ্চলে। সেখান থেকে মূল ধারাটি দক্ষিণ – পশ্চিমে সরস্বতী নামে প্রবাহিত হয়ে হাওড়ার সাঁকরাইল ও তারপর বজবজ – বাউরিয়া র কাছে বাঁক নিয়ে আরও দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে মেশে। অন্য একটি ধারা হুগলী নামে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে বর্তমান কলকাতার ওয়াটগঞ্জ (খিদিরপুর) এর দইঘাট হয়ে কালীঘাট, চেতলা, বারুইপুর, জয়নগর, মজিল্পুর হয়ে আরও দক্ষিণে ঠাকুরান, সপ্তমুখীর সঙ্গে মিলে বঙ্গোপসাগরে মিশেছিল। দইঘাট পরবর্তী অংশটিকে আদিগঙ্গা বলা হত। এই যমুনা নদী অবধি অর্থাৎ আজকের কাঁচরাপাড়া – কল্যাণী অবধি সুন্দরবন বিস্তৃত ছিল। ব্রিটিশ কর্তৃক বাধ দিয়ে রেল লাইন নির্মাণ সহ বিবিধ কারণে ক্রমশ যমুনা, সরস্বতী ও আদিগঙ্গা দুর্বল ও শীর্ণকায়া হয়ে পড়ে। যেরকম পূর্ব বাংলা থেকে বিপুল পরিমাণে মহার্ঘ পাট, বালাম চাল ইত্যাদি দ্রুত ও বেশি পরিমাণে নিয়ে আসার জন্য ব্রিটিশরা রেললাইন করার সময় বড় নদী ইছামতীর মাথাটা বুজিয়ে মাথাভাঙার মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। সেইসময় ভারত ছিল বিশ্বের মধ্যে সবচাইতে সম্পদশালী ধনী দেশ, আর উর্বর সোনার বাংলা ছিল তার সেরা প্রদেশ। এই বাংলার রেশম, কার্পাস বস্ত্র সহ মহার্ঘ্য দ্রব্যগুলি নিয়ে বাণিজ্য ও পরবর্তীতে লুঠ করতে আর্মেনিয়ান, পর্তুগিজ, দিনেমার, ডাচ, ফরাসি, ব্রিটিশ বণিক ও বাণিজ্য সংস্থাগুলি দূর দেশ থেকে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে নবাব আলিবর্দির সময় ডাচরা তাদের নৌবাণিজ্য পথ সুগম করতে দইঘাট থেকে সাঁকরাইল অবধি নদীখাত কেটে হুগলীর সঙ্গে সরস্বতীকে মিলিয়ে দেয়। এটিকে বলা হত কাটি গঙ্গা। কালক্রমে এটি ই হুগলী (গঙ্গা) নদীর মূল ধারা হয়ে যায়। ব্রিটিশরা এর দক্ষিণ পাড়ে দুটি খাল কেটে লগ গেট বানিয়ে ‘ক্যালকাটা পোর্ট কমিশনারস’ এর অধীনে ১৮৭০ সালে তৈরি করে ভারতের প্রথম ও বৃহত্তম আধুনিক নদী বন্দর ও ডকিং সিস্টেম।
প্রেমেন্দ্র মিত্রর বিখ্যাত ‘মহানগর’ গল্পে আমরা দেখতে পাই বালক রতন তার হারিয়ে যাওয়া দিদির খোঁজে নড়াল থেকে নৌকোয় করে নদীপথে উল্টোডিঙ্গি (আজকের উল্টোডাঙ্গা) চলে এসেছিল। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের লেখায় আমরা কর্মব্যস্ত চেতলা বন্দরের ছবি পাই। গঙ্গা, বিদ্যাধরীর বিভিন্ন শাখাপ্রশাখা কলকাতা নগরীকে ঘিরে ছিল। বাংলার বাণিজ্যের সিংহভাগ দখল করতে তখন মরীয়া ব্রিটিশ বাণিজ্য সংস্থা। কোম্পানির চিফ এজেন্ট জোব চারনকের নেতৃত্বে উত্তরের পাটনা ও কাশিমবাজারের কুঠিতে নবাবী নজরদারি থেকে দূরে আবার দক্ষিণে পর্তুগিজ বোম্বেটে দের নাগালের বাইরে প্রথমে হিজলি ও তারপর উলুবেড়িয়া তে তারা ডেরা বাঁধল। পরে ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে হুগলী নদীর পূর্ব পাড়ে সুতানুটি, গোবিন্দপুর ও কলকাতা তিনটি গ্রামের পত্তনি নিয়ে কলকাতা নগরী ও বাণিজ্য সদর তৈরি হয়। সেটির রক্ষায় ১৭০২ এর মধ্যে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়। ১৭৫৭ তে কৌশলে পলাশীর যুদ্ধে রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে জিতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রা কার্যত বাংলা তথা ভারতের অধীশ্বর হয়ে যায়। তাদের বৃহৎ ভারতীয় উপনিবেশের প্রধান বাণিজ্যিক, প্রশাসনিক ও সামরিক কেন্দ্র হয়ে উঠে কলকাতার গুরুত্ব বেড়ে যায়। আড়ে বহরে কলকাতার আয়তন বাড়তে থাকে, আরও বাড়তে থাকে এর জনসংখ্যা। ১৮৭২ এর প্রথম জনগণনায় কলকাতার জনসংখ্যা দাঁড়ায় ৬,৩৩,০০৯, যা ২০১১ এর শেষ জনগণনায় পৌঁছয় ১,৪০.৩৫,৯৫৯ তে। ১৭৭৭ এ বর্গী হানা রুখতে তদানীন্তন কলকাতাকে ঘিরে মারাঠা ডিচ খনন করা হয়, এখন যার উপর সার্কুলার রোড (এজেসি ও এপিসি রোড) তৈরি হয়েছে।
হুগলী ও বিদ্যাধরী নদী সহ কলকাতার চার পাশ ও মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা বেশ কিছু নদী, খাল, খাঁড়ি; কলকাতার মধ্যে ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে অবস্থিত অসংখ্য বিল, দিঘি, পুকুর, ডোবা, জলাভূমি নিয়ে প্রাকৃতিক জল নিকাশি ব্যবস্থার বাইরে ব্রিটিশরা পরিকল্পিত ইটের দেওয়াল দিয়ে নির্মিত নর্দমা সম্বলিত রাস্তার নিচ দিয়ে জল ও তরল বর্জ্য নিকাশির ব্যবস্থা (Overground and Underground Drainage and Sewerage System) গড়ে তোলে ১৮৭৫ নাগাদ উইলিয়াম ক্লার্কের তত্ত্বাবধানে। এছাড়াও কিছু খাল কেটে কলকাতার বৃষ্টি ও নর্দমার জল পশ্চিমে গঙ্গা এবং পূবে বিদ্যাধরী, কুলটি ও নোনা গাঙে এবং বর্তমান সল্ট লেক থেকে গড়িয়া পর্যন্ত বিসতৃত জলাভূমিতে ফেলার ব্যবস্থা করা হয়। ১৮৭৭ নাগাদ মেজর টলি দইঘাট থেকে শামুকপোঁতা পর্যন্ত ২৭.২ কিমি আদিগঙ্গার খাত খনন করেন। তাঁর নামে এটির নাম হয় টলির নালা। একে একে শহরের উত্তর, পূব ও দক্ষিণ দিকে বাগবাজার, কেষ্টপুর , বাগজোলা, ভাঙ্গর, সার্কুলার, বেগোর, মণি, চরিয়াল প্রভৃতি খাল কাটা হয়। চিৎপুরে লক বসে। ১৯২৮ এ ‘কুলটি আউটফল স্কিম’ করে বানতলা থেকে ২৭ কিমি দূরে কুলটি নদীতে জল নিকাশির ব্যবস্থা হয়।
তাহলে এখন এমন বিপর্যয় কেন? এটি ঠিকই বিশ্বজুড়ে ব্যাপক হারে পরিবেশ দূষণের (Environmental Pollution) কারণে (যার প্রধান দুই অংশীদার চিন ও ভারত) বিশ্ব উষ্ণায়ন ( Global Warming) ঘটায় একদিকে হিমালয়ের হিমবাহর গলন বৃদ্ধি, হড়পা বান, ধ্বস, বন্য্যা; অন্যদিকে সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস বৃদ্ধি, সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধি, উপকূলীয় অঞ্চল গুলি ডুবে যাওয়া, ঘনঘন নিম্ন চাপ সৃষ্টি, সাইক্লোন, সুনামি, অতিবৃষ্টি , মেঘভাঙ্গা বৃষ্টি , অতিরিক্ত বজ্রপাত প্রভৃতি ঘটে চলেছে। এই সমূহ বিপদকে উপেক্ষা করে পরিবেশের আরও ক্ষতি করে চলেছে মানুষের সীমাহীন লোভ ও ভোগ; বেপরোয়া ক্ষতিকর মনোভাব, আচরণ ও কাজকর্ম এবং বৃহৎ পুঁজি, কর্পোরেট ও মাফিয়াদের প্রভাবে সরকারগুলির অপরিকল্পিত, অবৈজ্ঞানিক, ক্ষতিকর নির্মাণ যজ্ঞ।
নদীর গতিরোধ করে যত্রতত্র বাঁধ, ব্যারেজ ও ব্রিজ নির্মাণ; চিনের সঙ্গে সীমান্ত সামরিক পরিকাঠামোয় পাল্লা দিতে কিংবা ধর্মীয় পর্যটনে মুনাফা কুড়োতে অথবা বৃহৎ পুঁজির উৎপাদনগুলি দ্রুত বাজারে পৌঁছে দিতে ঘন অরণ্য ও তার অনবদ্য বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস করে, নবীন ভঙ্গুর হিমালয় সহ পাহাড়গুলি ফাটিয়ে, নদী বুজিয়ে রাজপথ ও রেল লাইন নির্মাণ; যত্রতত্র ওপেন কাস্ট মাইনিং ও তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, স্পঞ্জ আয়রন ইত্যাদি দূষণকারী খনন ও কারখানা নির্মাণ; অপ্রয়োজনীয় বড় বড় বাঁধ ও জলাধার নির্মাণ করে বন্যার সৃষ্টি ও বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চল – কৃষি ক্ষেতের সলিল সমাধি; সুন্দরবন সহ উপকূলের ম্যানগ্রোভ ধ্বংস; গঙ্গা সহ নদী গুলি থেকে খাল কেটে জল টেনে নেওয়া, অবৈধ বালি খনন, ব্রিজ – ব্যারেজ নির্মাণ; কোনরকম শুদ্ধিকরণ (Treatment) না করে গঙ্গা সহ নদীগুলিতে ও সমুদ্রে শিল্প ও পুর বর্জ্য উৎক্ষেপণ; সমুদ্রে আগ্রাসী মাছ ধরার মাধ্যমে জল দূষণ ও বাস্তু তন্ত্র ধ্বংস; উন্নয়নের নামে শহরগুলিতে অবৈধ কুৎসিত নির্মাণের জঙ্গল বানিয়ে সুস্থ শ্বাস – প্রশ্বাস থেকে যাতায়াত – নিকাশির বারোটা বাজিয়ে দেওয়া; পরিবেশ বান্ধব দ্রুতগামী গণপরিবহনের ব্যবস্থা না গড়ে অটোমোবাইল ও পেট্রো লবির স্বার্থে নিয়ন্ত্রণহীন গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি ও ফসিল ফুয়েল পোড়ান; নদী – খাল – বিল – পুকুর বুজিয়ে বর্ষার মূল্যবান মিষ্টি জলকে (Fresh Water) ধরে রাখতে না পেরে বন্যার সৃষ্টি, অন্যদিকে শুখা মরশুমে নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে চাষ, বহুতলে উত্তোলন, বিনোদন, কোল্ড ড্রিঙ্কস তৈরি প্রভৃতি কারণে দুষ্প্রাপ্য ভূগর্ভস্থ জল (Ground Water) উত্তোলন প্রভৃতি সরকার ও নাগরিকদের যৌথ কর্মসূচি আমাদের সকল দেশের সেরা এই দেশ ও রাজ্য টিকে ক্রমশ বসবাসের অনুপযুক্ত করে তুলছে।
বর্তমানে বৃহত্তর কলকাতার জলজমার কারণগুলি কি কি? (১) পশ্চিমে হুগলী (গঙ্গা) নদীতে পলি পড়ে নাব্যতা (Navigability), জল ধারণ ও জল বহন ক্ষমতা আনেকখানি কমে যাওয়া ; (২) গঙ্গায় যাবতীয় বর্জ্যের উৎক্ষেপণ; (৩) ফারাক্কা ব্যরেজের দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়া; গঙ্গার ভাগীরথী – হুগলী অংশে দীর্ঘদিন কোন ড্রেজিং না হওয়া; (৪) পুব দিকে বিদ্যাধরী, নোনা, কুলটি গাঙ গুলি মজে যাওয়া এবং তাদের গতিরোধ করে যত্রতত্র মাছের ভেড়ি, ইট ভাটা, রাস্তা, ব্রিজ, ঘরবাড়ি , দোকান ইত্যাদি নির্মাণ; (৬) কলকাতার নিকাশি খালগুলি মজে যাওয়া এবং রাজনৈতিক মদতে নেতা – মাফিয়া দের উৎকোচ প্রদান করে সেগুলি দখল করে ঘরবাড়ি, দোকান – বাজার, ছোট ছোট কারখানা – গুমটি ইত্যাদি নির্মাণ; (৭) কলকাতার ফুসফুস ও বৃক্ক সল্ট লেক থেকে গড়িয়া অবধি বিস্তৃত পূর্ব কলকাতা জলাভূমি সরকারি ও রাজনৈতিক মদতে গ্রাস করে একের পর এক বহুতল সহ বিবিধ নির্মাণ; (৮) একইভাবে বৃহত্তর কলকাতার মধ্যে ছড়িয়ে থাকা অজস্র খাল, বিল, দিঘি, পুকুর, ডোবা বুজিয়ে বহুতল নির্মাণ; (৯) জল পারাপারের ব্যবস্থা না রেখে ‘ ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাস’ সহ বিভিন্ন রাজপথ নির্মাণ; (১০) টালিগঞ্জ থেকে নিউ গড়িয়া মেট্রো সম্প্রসারণের সময় টলি নালাকে বুজিয়ে ফেলা; (১১) সরকারের তরফ থেকে প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করতে না পারা এবং নাগরিকদের তরফ থেকে প্লাস্টিক বর্জন করতে না পারা; (১২) কলকাতার যত্রতত্র ও সর্বত্র বাজার, খাবার দোকান, হোটেল, গ্যারেজ সহ বিভিন্ন দোকানের উপস্থিতি এবং যত্রতত্র ও সর্বত্র বর্জ্য উৎক্ষেপণ; (১৩) এবং অবশ্যই রাজনৈতিক নেতা – প্রোমোটার – পুলিশ – সমাজবিরোধীদের তৈরি সিণ্ডিকেট গুলি কর্তৃক শহরের সর্বত্র সমস্ত জমি গ্রাস করে কংক্রিটের জঞ্জাল নির্মাণ।
এর পাশাপাশি ১৮৭৫ এ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রা যে নিকাশি ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল জনসংখ্যা ২৫ গুনের বেশি বাড়লেও বাদামি সাহেবরা সেগুলি সেভাবে সংস্কার, পুনর্গঠন ও সম্প্রসারণ করে উঠতে পারেননি । সেগুলিও অনেকাংশে পলি, আবর্জনা ও প্লাস্টিক জমে কিংবা ক্ষয়ে গিয়ে অকার্যকর হয়ে গিয়েছে। ১৯৭০ এ কংগ্রেস সরকার সি এম ডি এ – র মাধ্যমে কলকাতার নিকাশি ব্যবস্থার সংস্কার করে। কিন্তু ৩৪ বছরের বাম ও ১৪ বছরের তৃণমূল জমানায় বারবার বিশ্ব ব্যাঙ্ক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক প্রভৃতির অর্থ সাহায্যে ‘কলকাতা এনভায়রনমেনটাল ইম্প্রুভমেন্ট প্রোগ্রাম (KEIIP)’ প্রমুখ এবং তাদের Trench I, Trench II ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের গালভরা প্রচার শোনা গেলেও কাজের অগ্রগতি প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য এবং সমগ্র বিষয়টি ধোঁয়াশা পূর্ণ। এই দুই জমানার জনপ্রিয় শব্দ ‘ঘাপলা’ এই ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যার উপর ভিত্তি করে কিছু নেতা কোটি কোটি পতি হয়ে দেশবিদেশে বিপুল সম্পত্তি করে ফেলেছেন। তাই কিছুক্ষণ বৃষ্টি হলে বাটির মত কলকাতা জলমগ্ন হয়ে কলকাতাবাসীকে অশেষ যন্ত্রণা দিতে থাকে। জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। যানবাহন চলাচল বিঘ্নিত হয়। কষ্টার্জিত সরকারি ও ব্যাক্তিগত মুল্যবান সম্পদ নষ্ট হয়। রোগব্যাধি বাড়ে। হুকিং করা খোলা তারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে অমূল্য প্রাণ চলে যায়। নিচু জায়গাগুলি থেকে তিন চার দিনেও জল নামে না। নেতা – মন্ত্রীরা নিজেরা নিরাপদে থেকে অন্যদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নির্বিকারে গণ মাধ্যমে বক্তব্য পেশ করে দায় সারেন এবং রাস্তা বন্ধ করে জনজীবন বিপর্যস্ত করে থিম পুজো এবং বিসর্জন পরবর্তী সরকারি আয়োজনে কার্নিভালে মত্ত হয়ে ওঠেন। পুরসভা নানারকম অজুহাত দিয়ে পাম্প চালিয়ে ভি আই পি ও ধনী এলাকা থেকে জমা জল দরিদ্র, নিম্নবিত্ত, বস্তি, কলোনি, ঝুপড়ি এলাকায় পাঠিয়ে দায় সারে। এভাবেই চলে আসছে দশকের পর দশক।
তাহলে কিছুই কি করার নেই? অনেক কিছুই করার আছে। সবচাইতে প্রথমে দরকার শাসকদের রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং নাগরিকদের প্রকৃত সচেতনতা। এর সঙ্গে সরকারি উদ্যোগ, সঠিক সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা, পরিবেশ বান্ধব টেকসই (Sustainable) উপযোগী পদ্ধতি, আধুনিক প্রযুক্তি, কেন্দ্র – রাজ্য – পুরসভা – অসরকারি সংগঠন সকলের সম্মিলিত প্রয়াস, নাগরিক অংশগ্রহণ এবং সময়সীমা ধরে সঠিক রূপায়ণ, পর্যালোচনা ও ব্যবস্থাপনা।
(১) সরকারি বাজেটে মেলা, উৎসব, উপহার, পুরস্কার, মোচ্ছব, মন্দির নির্মাণ, প্রসাদ বিতরণ, হজ যাত্রা , ক্লাব ও দুর্গা পুজো কমিটি গুলিকে অনুদান, কার্নিভাল ইত্যাদি অপচয় বন্ধ করে ব্যারেজ, জলাধার, নদী ও জলাভূমি সংস্কার, বন্যা ও ধ্বস নিয়ন্ত্রণ, বন সৃজন, নদী ও সামুদ্রিক বাঁধ মেরামতি, উপকূল জুড়ে ম্যানগ্রোভ রোপণ, রাস্তা সারাই প্রভৃতি প্রয়োজনীয় বিষয়ে এবং বৃহত্তর কলকাতার নিকাশি ব্যবস্থা সংস্কার ও পুনর্গঠনে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ। মালদার ‘ভুতনি’, হুগলীর ‘আরামবাগ‘, হাওড়ার ‘আমতা’, পূর্ব মেদিনীপুর এর ‘ঘাটাল’, ‘সবং’, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ‘ঘোড়ামারা’ প্রভৃতি বন্যা কবলিত অঞ্চলগুলির জন্য বিশেষ পরিকল্পনা এবং তার রূপায়ণ।
(২) উপযুক্ত বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে কলকাতার নিকাশি ব্যবস্থার সম্প্রসারণ ও ঢেলে সাজানো। ঠিকাদার – নেতাদের স্বার্থে বর্ষায় কাজ নয়, অক্টোবর থেকে মে পর্যন্ত রাত দিন ধরে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজটি সম্পাদন। প্রতিটি পাড়ায় নাগরিক কমিটি করে কাজটির তত্ত্বাবধান।
(৩) কেন্দ্র সরকারের সহযোগিতায় ফারাক্কা, দুর্গাপুর, গজলডোবা সহ ব্যারেজগুলির সংস্কার এবং ব্যারেজগুলির উজান ও ভাটি এলাকার পলি ড্রেজিং করে সরিয়ে দেওয়া। এর সঙ্গে মাসাঞ্জর, মাইথন, পাঞ্চেত, মুকুটমণিপুর, গজলডোবা প্রভৃতি জলাধারগুলির সংস্কার।
(৪) মুর্শিদাবাদের নিমতিতায় বুজে যাওয়া ভাগীরথীর মুখ কে কেটে পরিস্কার করে দেওয়া এবং সমগ্র ভগীরথী ও হুগলী নদীতে নিয়মিত ড্রেজিং করে নদীর গভীরতা ও নাব্যতা বাড়ানো। তিস্তা, তোরষা, জলঢাকা, মহানন্দা, আত্রেয়ী, ব্রাহ্মণী, দ্বারকা, ময়ূরাক্ষী, অজয়, দামোদর, দ্বারকেশ্বর, মুন্ডেশ্বরী, কংসাবতী, শিলাবতী, কেলেঘাই, সুবর্ণরেখা, ভৈরব, জলঙ্গী, চূর্ণি, ইছামতী, বিদ্যাধরী প্রভৃতি অন্যান্য সমতলের নদীগুলিরও শুখা মরশুমে ড্রেজিং করে গভীরতা ও নাব্যতা বাড়ানো।
(৫) এর সঙ্গে রাজ্যের সমস্ত ছোট নদী, খাল, বিল, দিঘি, জলাভূমির প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়া। এগুলিকে পুরসভা ও পঞ্চায়েতের কর্মসূচিতে এবং ১০০ দিন কাজের প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করা। স্বেচ্ছ্বা শ্রমদান আহ্বান করা এবং এই কাজটিকে রাজ্যজুড়ে গণ আন্দোলনে পর্যবসিত করা।
(৬) কলকাতার সমস্ত নিকাশি খালের সংরক্ষণ, প্রয়োজনীয় সম্প্রসারণ, নিয়মিত সংস্কার এবং নৌ পরিবহনের সূচনা। মেট্রো পরিষেবা অক্ষুণ্ণ রেখে টলি নালার পুনর্জীবন এবং ই এম বাইপাস সহ রাজপথ গুলিতে কাল্ভারট ও আন্ডারগ্রাউন্ড ড্রেনের মাধ্যমে জল পারাপারের ব্যবস্থা।
(৭) পূর্ব কলকাতার জলাভূমি সহ কলকাতার সমস্ত জলাভূমি রক্ষা এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার । প্লাস্টিক আবর্জনা, কচুরি পানা ইত্যাদি সরিয়ে ফেলা। এলাকাবাসীর সাঁতার , বোটিং, মৎস্যচাষ প্রভৃতির মাধ্যমে সেগুলিকে সচল এবং সেগুলির জল পরিষ্কার রাখা।
(৮) সমস্ত বেআইনি ও বিপজ্জনক নির্মাণ পর্যায়ক্রমে ভেঙ্গে ফেলা। কেবলমাত্র পরিবেশবান্ধব এবং অগ্নি নির্বাপণ সহ সমস্ত আইন ও নিয়ম মেনে চলা নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া। পুরসভার তরফ থেকে নির্মাণ ও পরবর্তী পর্যায়ে নজরদারি রাখা।
(৯) প্লাস্টিকের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা। প্রতিবেশী সিকিম, হিমাচল প্রদেশ বহু আগে করতে পারলেও পশ্চিমবঙ্গ কেন পারবে না?
(১০) সঠিক বর্জ্য সংস্থাপন (Waste Management) ব্যবস্থা কঠোরভাবে প্রবর্তন ও রূপায়ণ। নিয়মমত শুদ্ধিকরণ না করে পুরসভা ও শিল্পগুলির তরফ থেকে কোন বর্জ্য নদী, খাল বা জলাভূমিতে ফেলা যাবেনা । ধাপার কঠিন বর্জ্য সংস্থাপন ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে।
(১১) হুকিং করলেই ধরে কড়া শাস্তি দিতে হবে। সি ই এস সি – র অত্যধিক বিদ্যুৎ মাশুল কমাতে হবে। রাস্তায় ও গণ পরিসরে সমস্ত ইলেকট্রিক ডিস্ট্রিবিউশন বক্স, ট্রান্সফরমার ইত্যাদি নিরাপদ অবস্থায় রাখতে এবং সমস্ত বিদ্যুৎ প্রবাহিত তার (Live Wire) অপরিবাহী কোটিং সহ মাটির নিচেই হোক বা উপরে উঁচুতে হোক নিরাপদ দূরত্বে রাখতে হবে যাতে জলমগ্ন অবস্থাতেও পথচারীদের সংস্পর্শে না আসে। এগুলির প্রতি নজরদারি রাখতে হবে। যে পুরনো বাড়ি গুলি মিটার বক্স সহ জলমগ্ন হয়ে পড়ে সেগুলির ক্ষেত্রে মিটার ঘর বাড়ির বাইরে নিরাপদ উচ্চতায় করার ব্যবস্থা করতে হবে।
(১২) জল বিটুমিনের ঘোষিত শত্রু। প্রতিবার ভরা বর্ষায় পুজোর মরশুমের আগে ঠিকাদার – নেতা বান্ধব কোনরকম পিচ দিয়ে মেরামতির (Patchwork) বদলে শুখা মরশুমে দিনরাত কাজ করে রাস্তাগুলি তে সঠিক জল ও মানুষ পারাপারের ব্যবস্থা, রেলিং দেওয়া ফুটপাথ , সাইকেল লেন, সাইনেজ এর ব্যবস্থা রেখে, সঠিক ঢাল বজায় রেখে, অনেক ওজন বহন সক্ষম, শক্তপোক্ত ও ঢালাই করে করতে হবে। সরকারি গাড়ি সহ সমস্ত দূষিত পুরনো গাড়ি বাতিল করতে হবে। সাইকেল, ট্রাম, কেবল বাস, ব্যাটারি গাড়ি, ব্যাটারি বোট, মেট্রো ও সার্কুলার রেল প্রভৃতি গণ পরিবহনের উপর জোর দিতে হবে। সিঙ্গাপুর ইত্যাদি উন্নত শহরের মত শহরের রাস্তার পরিমাপ ইত্যাদি অনুযায়ী গাড়ি, বাইক, অটো, টোটো, ই রিকশা ইত্যাদির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ধর্মতলা, বাবুঘাট ও করুনাময়ীর দূরগামী বাস স্ট্যান্ড তিনটিকে সাঁতরাগাছি, ডানকুনি ও নিউ টাউনে সরিয়ে ফেলতে হবে।
(১৩) শহরের বিভিন্ন জায়গায় সরকারের তরফ থেকে গৃহহীন, ভবঘুরে, ভিখারি, ফুটপাথ বাসীদের জন্য পরিচ্ছন্ন বহুতল শেল্টার গড়ে তুলতে এবং সেখানে পানীয় জল ও শৌচাগারের ব্যবস্থা রাখতে হবে। পরিচালনায় এদের যুক্ত করতে হবে। এর বাইরে শহরে কোথাও এরা বাস করতে পারবেন না। শহরে খেলার মাঠ, পার্ক, ফাঁকা জায়গা এবং গাছের সংখ্যা বাড়াতে হবে। প্রতিটি ব্যস্ত রাস্তার মোড়, বাস টার্মিনাল, রেল স্টেশন, বাজার প্রভৃতি স্থানে নারী, পুরুষ সকলের জন্য পর্যাপ্ত ও পরিচ্ছন্ন সুলভ শৌচাগারের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
আরও অনেক কিছু করার আছে আর করাও যায়। সরকার এবং নাগরিকদের সত্যিসত্যিই যদি ইচ্ছা আর প্রচেষ্টা থাকে তাহলে এই জলজমার নরক যন্ত্রণা থেকে অনেকটাই উদ্ধার পাওয়া সম্ভব।
০২.১০.২০২৫