রফিকদার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ পরিচয় একত্রিশ বছর আগে (১৯৯৪)। ‘বাবরি মসজিদ’ ধ্বংসের পরবর্তী সময়ে কলকাতায় হয়েছিল তিনদিনের এক সেমিনার। ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে। বাংলাদেশ থেকে আসা আঠাশ জনের প্রতিনিধি দলে ছিলেন বিভিন্ন কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রবীন ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক-ও। সেখানে আমার বক্তব্য ছিল, বিশ্বজুড়ে সাম্প্রদায়িক হানাহানি বাড়িয়ে তুলতে সাম্রাজ্যবাদের ভয়ঙ্কর ভূমিকার বিরুদ্ধে। আমার অতো ‘ঝাঁঝালো’ কথায় অনেকেই উসখুস করছিলেন, দেখেছিলাম! কিন্তু বিস্মিত হয়েছিলাম, আমার বক্তব্যের পরে, আমার সঙ্গে করমর্দন করতে গিয়ে এক বৃদ্ধ হাত ধরে ঝাঁকিয়েই যাচ্ছিলেন, ছাড়ছিলেন না দেখে! তিনিই রফিকদা। পরে উনি যে ঘরে ছিলেন, সেই ঘরে গিয়ে নানা কথার পর আমাকে উপহার দিলেন বাংলাদেশ আকাদেমি প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের উপর তাঁর প্রথম গবেষণা গ্রন্থ ‘আরেক কালান্তরে’। লিখে দিলেন, “দীপক পিপলাই, কল্যাণীয়েষু – আহমদ রফিক, ২৭/৮/১৯৯৪”। সেই সম্পর্ক নিবিড় থেকে নিবিড়তর হয়েছে তাঁর জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। কখনও ‘কলকাতা বইমেলা’র মাঠে; কখনও হয়তো কলকাতার কোনও ‘গেস্টহাউসে’, কখনও ঢাকার ‘ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক সরণীতে অবস্থিত তাঁর বাসায়। কখনও হয়তো ঢাকার ‘শহীদ মিনার’আর মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গনে। আবার কখনও সাভারে প্রতিষ্ঠিত ৩০ লক্ষ শহীদের ‘জাতীয় স্মৃতিসৌধ’র চত্ত্বরে। কখনও মোবাইলে। কত রাজনৈতিক আলোচনা, কত ইতিহাস, কত কী যে তাঁর কাছ থেকে ঋদ্ধ হয়েছি, তার কোনও হিসেব নেই। মুমূর্ষু অবস্থাতে নাকে অক্সিজেনের নল লাগানো অবস্থায়ও, প্রচণ্ড জড়ানো কথায় আমাকে ভিডিও-তে বলেছেন, “ভাল না”।
তাঁর মৃত্যু আমাকে আবার অভিভাবকহীন করলো!
১৯৫২-র ঐতিহাসিক ‘ভাষা সংগ্রাম’ এর অন্যতম সংগঠক, কবি, প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক, রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ … সবই ঠিক। কিন্তু আমার বিচারে রফিকদা ছিলেন মূলত মার্কসবাদ ও শ্রেণীসংগ্রামে আস্থাশীল একজন বাঙালি কমিউনিস্ট। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি যাঁকে প্রতিনিয়ত ক্ষতবিক্ষত করেছে। অশীতিপর বয়সে এসেও যিনি প্রায় পাঁচশো পৃষ্ঠার বই প্রকাশ করেন, ‘দেশভাগ : ফিরে দেখা’ (২০১৪) । যেখানে তিনি বলিষ্ঠ উচ্চারণে বলতে পারেন, “ভারতবিভাগের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিতর্ক যেমনই হোক একথা অস্বীকার করা যায় না যে পাকিস্তান ধর্মীয় রাজনীতি-প্রসূত জটিলতার এক যুক্তিহীন সন্তান”। (পৃ: ৪৩২)। দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করতে পারেন, “দেশবিভাগের সূত্রে যা সবচেয়ে বড়ো, স্থায়ী সত্য হয়ে থাকল তা হচ্ছে সাম্প্রদায়িক চেতনার ব্যাধি বা পাপ, যা প্রথম দুই ভূখণ্ডেই নয়, ত্রিধাবিভক্ত উপমহাদেশের জন্যই সামাজিক সত্য।… ভাবছি মৃত্যুঞ্জয় মানুষ এ উপমহাদেশকে এর সর্বপ্রকার ব্যাধি ও পাপ থেকে একদিন মুক্ত করবে বাঞ্ছিত সমাজ পরিবর্তনের মাধ্যমে”। (পৃ: ৪৬৩)।
আমি রফিকদার এই উপলব্ধি ও স্বপ্নের শরিক। “রাজনৈতিক চরিত্র বিচারে দ্বিখণ্ডিত জাতিসত্তার দুই ভূখণ্ড তাই মুসলমান বাংলা ও হিন্দুবঙ্গের প্রতীক হয়ে উঠেছে।”। (পৃ: ৪২২)। আমি তাঁর এই যন্ত্রণাক্লিষ্ট অনুভবেরও অংশীদার। সীমান্তে কাঁটাতারের দুই পারে ঘটে চলা অবাঞ্ছিত ঘটনাবলি এই বেদনাদায়ক সত্যের নিত্যনতুন নজির সৃষ্টি করে চলেছে।
ভাঙা-বাংলার যন্ত্রণা বুকে নিয়ে চলার ঊষালগ্নে, ১৯৪৭-এর নভেম্বরেই তদানিন্তন পূর্ব-পাকিস্তানের মাটিতে ভাষা নিয়ে বিক্ষোভের শুরু। ছাত্ররাই ছিল এই বিক্ষোভ আন্দোলনের প্রধান শক্তি। “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” এই মূল দাবির পরের দাবিটিই ছিল “রাজবন্দীদের মুক্তি চাই।” একথা স্মরণে রাখা জরুরি যে, এই রাজবন্দীরা সকলেই ছিলেন কমিউনিস্ট। কিন্তু শুধু পার্টি-সদস্য ও সমর্থকদের গলায় না, ভাষা-আন্দোলনের শ্লোগান গুলো উঠেছিল দলমতের বেড়া ডিঙিয়ে সম্মিলিত ছাত্রজনতার কন্ঠে। দিনের পর দিন।
আহমদ রফিক তখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র। এই সংগ্রামে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য, প্রথমে প্রার্থী সদস্যপদ এবং ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৮ পূর্ণ সদস্যপদ পেয়েছিলেন তদানিন্তন পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (পূর্বাঞ্চল শাখা)-তে। কিন্তু সর্বক্ষণ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডতাড়িত জগতের তুলনায়, মানসিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী, আজীবন সাংস্কৃতিক ভুবনে সৃষ্টিশীল মুসাফির হওয়াই তাঁর কাছে শ্রেয় মনে হয়। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত, অটুট ছিল রফিকদার সেই পথ চলা। মিটিং, মিছিল, কাঁদানে গ্যাস, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, পলাতক জীবন, রাষ্ট্রের কোপ, ইন্টার্নশিপ করতে না দিয়ে তাঁকে ডাক্তারি থেকে বঞ্চিত করা… কিছুই তাঁর সৃষ্টির স্রোতকে আটকাতে পারে নি। তাঁর ৯৬-তম শেষ জন্মদিনে, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ‘প্রথম আলো’দৈনিক পত্রিকায় লেখা বের হয়, ‘পরিবারহীন, স্বজনহীন, সংজ্ঞাহীন’। লেখক, ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইসমাইল সাদী। এর সঙ্গে যুক্ত হতেই পারে ‘সম্পদহীন’। রফিকদা নিজের সবকিছুই বিলিয়ে দিয়েছেন পরের স্বার্থে। রবীন্দ্র-গবেষণার কাজে এবং বিভিন্ন ট্রাস্ট তৈরি করে। রফিকদার ভাষায়, “তারুণ্যের ও প্রথম যৌবনের দিনগুলো কেড়ে নিয়েছিল রাজনীতি।”(‘নানা আলোয় রবীন্দ্রনাথ’, ১ম খণ্ড, অনিন্দ্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০১১, পৃ: ৯ দ্রষ্টব্য।) কিন্তু পরবর্তীকালে কালে মার্কসবাদী চিন্তার আলোকে “রবীন্দ্র-বিরোধিতা ও জেহাদের বিরুদ্ধে নান্দনিক জবাব দেওয়া”র তাড়নাতেই ভাষাসংগ্রামীর অন্যতম প্রধান চর্চার বিষয় হয়ে ওঠেন বহুমাত্রিক রবীন্দ্রনাথ। তিনি কয়েকবার কলকাতায় এসেছেন; কিন্তু ভারত রাষ্ট্র তাঁর ‘ভিসা’র আবেদন দু’ বার বাতিল করার পর, তীব্র ক্ষোভে ও অভিমানে আর সে চেষ্টা করেননি।
জনপ্রিয়তার সহজিয়া পথকে সচেতনভাবে এড়িয়ে, দশকের পর দশক নিশ্চুপে শুধু তাঁর আদর্শভিত্তিক অমূল্য রচনা ভাণ্ডার সৃষ্টি করে গেছেন অবিরাম।
২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৯ তারিখে প্রকাশিত তাঁর একটি কবিতার বইয়ের শিরোনাম যখন দেখি ‘বিপ্লব ফেরারি, তবু’, তখন লাগাতার সাহিত্য চর্চার সঙ্গে কবির রাজনৈতিক চেতনার উজ্জ্বল উপস্থিতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ২০১১-র ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত ‘মৃত্যুহীন বিপ্লবী চে গুয়েভারা’ বইয়ে রফিকদা লিখেছেন, “স্থানীয় বৈরিতা, ওয়াশিংটনের ষড়যন্ত্র, সামরিক শাসনের নির্মমতার বিরুদ্ধে অসম যুদ্ধে, বিশ্বাসঘাতকতার শিকার চে তার গেরিলা সঙ্গীদের নিয়ে শহীদ হন, … সিআইএ’র এজেন্টের সামনে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয় চে ও তার বিপ্লবী সঙ্গীদের।… চে গুয়েভারার জীবনঘনিষ্ঠ লড়াইয়ের কাহিনী এ বইতে তুলে ধরা হয়েছে যাতে দেশের তরুণ সমাজ তাকে জানতে ও বুঝতে পারে, তার আদর্শ অনুসরণে উদ্ধুদ্ধ হয়।” সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রামে অবিচল আস্থা ছাড়া এই বলিষ্ঠ উচ্চারণ সম্ভব না।
“জীবনের ধন কিছুই যায় না ফেলা” – রবীন্দ্রনাথের এই উপলব্ধি আহমদ রফিকের জীবনে অক্ষরে অক্ষরে সত্য। বাংলাদেশের ‘রাষ্ট্র’ বা কোনও ‘পার্টি’ অথবা কোনও ‘স্বজন’ তাঁর অন্তিম লগ্নে এগিয়ে না এলেও, তাঁর যথাযথ চিকিৎসার ও দেখভালের কোনও ত্রুটি হয় নি। তাঁর সৃষ্টিশীল, আদর্শবাদী ও বিস্ময়কর একাকীত্বের গুণমুগ্ধ ‘আত্মীয়’রাই তাঁর সব দায়িত্ব আন্তরিকভাবে পালন করেছেন। এমনকি এতটুকু সংজ্ঞা থাকা অবস্থায়ও, ভিডিও-তে আপনজনদের দেখিয়ে, কথা বলিয়ে সামান্য স্বস্তিটুকু দেবার চেষ্টা করেছেন তাঁকে। এব্যাপারে তরুণ ছোট-ব্যবসায়ী রাসেল সরদার, নিত্যদিনের সহচর আবুল কালাম, অধ্যাপক ইসমাইল সাদী, প্রবাসী ডা. হুমায়ুন কবির ইত্যাদির নাম অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। অসুস্থ আহমদ রফিকের বাড়িতে দিনের পর দিন যিনি তাঁকে আগলে রাখতেন, সেই চন্দ্র বানুর নামও আজ স্মরণ করা কর্তব্য। রফিকদার চিন্তা-চেতনাকে বহমান রাখার উদ্দেশ্যে ইতিমধ্যেই গড়ে উঠেছে ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিক ফাউণ্ডেশন। তাঁর অমূল্য পুস্তক সংগ্রহ, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তাঁর রচনাবলী, তাঁর প্রাপ্ত অজস্র সম্মান-স্মারক ইত্যাদি রক্ষার মাধ্যমে আহমদ রফিকের উত্তরাধিকারকে জীবন্ত রাখার লক্ষ্যে।
রফিকদা যেদিন (২১ নভেম্বর ২০১২) আমাকে ও চুমকিকে নিয়ে ’৫২-র ভাষা সংগ্রামের পীঠস্থান ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল চত্বর ঘুরিয়ে দেখাতে দেখাতে বলছিলেন, “গুলি খেয়ে বরকত ওইখানে পড়েছি।।”… “রফিকের কপালে গুলিটা লেগেছিল ঠিক মাঝখানে, মাথাটা উড়ে গিয়েছিল। ওর বডিটা এখানে রাখা ছিল।”… “এই জায়গাটাতেই ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে তৈরি হয়েছিল ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’। দু’দিন পরেই পুলিশ তা ভেঙে ফেলে। একটা ইঁটও রাখেনি।”… “ওইদিকে হাফপ্যান্ট পরা পুলিশের দল লাইন দিয়ে দাঁড়িয়েছিল, প্রথমে এইদিকে গুলি চালায়, তার পরে ওইদিকে।”… আমি তখন যেন রক্তাক্ত ‘একুশে’র কোলাহলের অংশিদার! রফিকদার মানসিক যন্ত্রণায় আমিও আহত হয়েছি বারবার।
ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বিষে জর্জরিত এবং সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের শিকার ‘বাঙালি’ জাতির এই দুঃসময়ে রফিকদার প্রয়োজন খুবই বেশি ছিল। বড্ড প্রয়োজনীয় সময়ে চলে গেলেন তিনি! বাঙালি নেতা-নেত্রী অনেক থাকেন, কিন্তু ‘আহমদ রফিক’রা জাতির কাছে চিরকালই দুষ্প্রাপ্য হীরক খণ্ড। আত্মস্বার্থকে অগ্রাহ্য করে, ধর্ম-বর্ণ-জাত নির্বিশেষে, বাঙালি তথা মানবজাতির সার্বিক বিকাশই যাঁদের জীবনের লক্ষ্য। রাষ্ট্রীয় বিরোধিতা কিংবা অবহেলা, রাজনৈতিক উপেক্ষা, কোনও কিছুই যাঁদের ব্রতভ্রষ্ট করতে পারে না। বহু সম্মাননার উজ্জ্বলতায়ও যাঁরা এক মুহূর্তের জন্যেও পথভ্রষ্ট হন না। রফিকদার এই দৃঢ়লক্ষ্য এবং নিভৃতচারী জীবনযাপন আমাদের শিক্ষণীয়।
বাংলাদেশের ‘কথাপ্রকাশ’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে আহমদ রফিকের একটি বই, ‘রাজনীতির বিবিধ প্রসঙ্গ’। রফিকদা যখন আমার হাতে বইটি দিলেন তাঁর বাসার ঘরে বসে (৯. ১. ২০১৮), দেখি উৎসর্গ পৃষ্ঠায় ছাপা রয়েছে, “শুদ্ধ মার্কসবাদী চিন্তার ধারক তরুণ রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবী দীপক পিপলাইকে অশেষ শুভেচ্ছা।” ৭৭-বছর পেরিয়ে যাওয়া ‘তরুণ’ এর জীবনে শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি।
শ্রমজীবী ভাষা পত্রিকায় ১লা নভেম্বর ২০২৫ এ প্রকাশিত।











