রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের জেল থেকে ঘর ওয়াপসি ঘটলো। জেল থেকেই উনি বেসরকারি ঝাঁ চকচকে নার্সিং হোমে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সেই নার্সিং হোমের দরজা দিয়ে তিনি বের হচ্ছেন…. সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিক, ফটোগ্রাফার সকলের সাংঘাতিক রকমের হুটোপুটি, ফ্ল্যাশের ঝলকানি, নিরাপত্তা রক্ষীদের দৌড়াদৌড়ি…. এক হৈ রৈ রৈ হুলস্থুল কান্ড!
বিভিন্ন নামের চ্যানেল গুলোতে এরপর নিশিদিন ব্যাপী সচিত্র টীকা-টিপ্পনীসহ ধারাবিবরণী ব্যাখ্যা শুরু হয়ে গেলো। এইরকম প্রভাবশালী উচ্চবর্ণের গুণধরের নামে মুহুর্মুহু শ্লোগান, জয়ধ্বনি, পোস্টার এক অভূতপূর্ব আবেগ! অপরূপ চিত্রলিপি!
নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত সকলের ঘরে টেলিভিশন অন….. একেবারে পুঙ্খানুপুঙ্খ রোমহর্ষক বিবরণ…. বাংলা গলাধঃকরণ করছে। আট থেকে আশি, নারী,পুরুষ সকলেই যেন দেখছেন দিগ্বিজয়ী বীরের পরাক্রম!
চ্যানেলের সাংবাদিক, কার বুমে তার কথা সুস্পষ্ট শোনা যাবে, তাই নিয়ে সাংবাদিকদের মধ্যে ভয়ানক প্রতিযোগিতা! তিনি কিভাবে ঘরে ঢুকছেন, দরজার চৌকাঠে কিভাবে অগ্নি-শোধনের মধ্য দিয়ে তাকে প্রবেশ করানো হচ্ছে….. অসাধারণ ছবি। জেলে থাকাকালীন তার উদরদেশের পরিমাণ বাড়লো না কমলো… তারও বিশ্লেষণ চলছে। তিন বছর উপর সময় পার করে তার পোষা সারমেয় প্রভুকে পেয়ে কিরকম আহ্লাদিত, তাও দেখছে বাংলা। ঘর ওয়াপসির পর, তার খাওয়ারের সূচিতে কি কি থাকছে, তার পরনের পোশাক- আশাক কিছুই বাদ নেই! সব কিছুর অনুপুঙ্খ বিবরণ ছবি সহ একেবারে সরাসরি সম্প্রচার!
জেল থেকে ফিরবার পর উনি কাঁদছেন, আবেগতাড়িত গলায় বলছেন, সততার সাথে মন্ত্রীত্ব সামলেছেন। উনি বিপত্নীক, বান্ধবী থাকাটা কি অন্যায়? এই প্রশ্ন সমাজের কাছে ছুঁড়ে দিচ্ছেন। তার নিজের বাড়ি থেকে কিন্তু টাকা পাওয়া যায় নি, বান্ধবীর বাড়ি থেকে টাকা উদ্ধার হলে তার কি করার থাকতে পারে, এই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তিনি তুলে ধরছেন; আর অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে এগুলো আর্কাইভের ছবি, গ্রাফিক্স সহ পর্দায় আসছে। আমরা সকলে অনেক অজানা জিনিস জানতে পারছি।
এই ধরনের কান্ডের পর এগুলোও যে খবর হতে পারে ধারণার বাইরেই ছিলো। সাধারণ নাগরিক সমাজের স্বভাবজাত আগ্ৰহ আছে জন্যই তো এত গুরুত্ব দিয়ে চ্যানেল গুলো সম্প্রচার করছে। তা না হলে তারাই বা এরকম ফলাও করে সম্প্রচার করবেই বা না কেনো?
এই ধরনের ঘটনা কি খুব স্বাভাবিক, নৈমিত্তিক ঘটনা? যে মানুষটির জন্য কত হাজার হাজার মানুষের চোখের জল, মৃত্যু….. তার জন্য সমাজের ভেতর এত আবেগ, ভালোবাসা লুকিয়ে আছে? এটার প্রকৃত ব্যাখ্যা কি? বোঝা সত্যিই দুস্কর! সামাজিক মনস্তত্ত্বের এরকম প্রকাশ কি খুব স্বাভাবিক? না এই ধরনের রূপ একটা বিকৃত পচা-গলা ,পূঁতি গন্ধময় সামাজিক ব্যাবস্থাপনার ইঙ্গিত বাহী? দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত, কিছুদিন কারান্তরালে কাটিয়ে আসা মানুষের জন্য এইরকম সমষ্টিগত অভিব্যাক্তি ও তার এইরকম বহুল প্রচার.. এ কি খুব স্বাভাবিক ঘটনা?
মহামান্য আদালতের রায়ে পার্থ বাবুর কারাগারের ভেতরে ঢোকাটা কি ব্যাপক সংখ্যক মানুষ বিশ্বাস করছেন না? নাহলে কি এইরকম বহিঃপ্রকাশ সম্ভব? আগেও কি এরকম ছিলো? একজন দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত বা দোষী মানুষ কে সমাজের একটা বড় অংশের মানুষ বরণ করে নিচ্ছেন, উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন, তাহলে কি এইরকম দুর্নীতির উপর কি মানুষের সহনশীলতার মাত্রা বেড়ে গেছে? সময়ের বিশিষ্টতা হিসেবে কি মানুষ সবকিছু মেনে নিয়ে এইরকম আচরণ করছেন?
এই বাংলাতে ধারাবাহিক থেকেই তো প্রৌঢ়ত্বে এলাম…… ; বিশ বছর কে যদি একটা যুগ ধরে নেই, তাহলে আড়াই যুগ এই সমাজের ভাঙা- গড়ার সাথেই তো কাটিয়ে এলাম! ব্যাক্তিগত নৈতিক বোধ, বোঝাপড়ার পরিবর্তন হয়েছে ঠিক। কিন্তু এতটাই পরিবর্তন, মেনে নিতে, মানিয়ে নিতে কোথায় জানি বাঁধে!
বাংলা, বাঙালি ও বাংলার অস্মিতার প্রেক্ষিতে ঘটনা গুলো সত্যিই মনে হয় বেমানান! বাঙালির চেতন- মানসে এক ভয়ঙ্কর পরিবর্তন ঘটে গেছে! একসময় এই বাংলাতেই ডান- বাম সব আদর্শের জন্য, নীতি- নিষ্ঠ দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়বার জন্য ছাত্র-যুব- বৃদ্ধ হেলায় নিজের জীবন বাজি রেখে লড়েছে ! এখন স্বপ্ন বলে মনে হয়!
এই প্রসঙ্গে একটু অন্য আবর্তে চলে যাই। চলে আসলাম পরাআধুনিক দার্শনিক মিশেল ফুকো’র কাছে। উনি বলেছেন, প্রতিটি যুগের একটা episteme আছে। এই এপিস্টিম হলো, একটা যুগের নিজস্ব জগৎ ও জীবন বীক্ষা যাকে গড়ে তুলেছে। একটি যুগের এপিস্টিমের সাথে আরেকটি যুগের এপিস্টিমের কোনো সম্পর্ক নেই। ফুকোর মতে, একটি যুগের এপিস্টিম কেমন করে গড়ে ওঠে, তার সৃষ্টি,তার বেড়ে ওঠা কেমন করে হতে থাকে তা বলা যায় না। একটি যুগের এপিস্টিম হঠাৎ করেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
আবার বর্তমান ঘটমানতায় এসে স্বগতোক্তির মতো অস্ফুটে বলে উঠি, দুর্নীতি,ভ্রষ্টাচারের প্রতি সহনশীলতা কি এই যুগের এপিস্টিম? জুরাসিক যুগের অতিকায় ডাইনোসররা, এই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে হঠাৎ করে, তেমন করেই কি এই ভয়ংকর এপিস্টিম গুলো হঠাৎ করেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে? কি জানি, কি হবে?
গ্লোবাল ক্যাপিটালিজম, লুম্পেন- ইকোনমি’র কদর্য রূপ ক্রোনি- ক্যাপিটালিজমের বিশ্বভূমে নৈতিকতার জায়গাটা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে উঠছে! এই বিকৃত লঘুত্বের কালে দুর্নীতি, চুরির দায়ে অভিযুক্ত ব্যাক্তিও বরণীয় হয়ে উঠছেন! এ এক অদ্ভুত অমানিশা! রাজনৈতিক ব্যাবস্থাপনার বদল কি এই সামাজিক অভিঘাতকে একেবারে পাল্টে দিতে পারবে? একসময় এই বাংলায় তো বদল চাই শ্লোগানে সবাই বিশ্বাস করে বদলালো। কি হলো? সামাজিক মনস্তত্ত্ব কোথায় গিয়ে পৌঁছালো? ভাবতে হবে, ভাবা দরকার!










