কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতা মনে এল প্রথমেই। “জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার”। আমি যখন একটাও হিন্দী সিনেমা দেখিনি, তখন একটা সিনেমা হয়েছিল, “বিশ সাল বাদ”। সেটাও আমার দেখা হয়নি। কি ছিল সে সিনেমার গল্প, আমার জানাও হয়নি। কিন্তু একটা মানুষের জীবনেই মাত্র কুড়ি বছরের মধ্যে কতো নাটকীয় পরিবর্তন হতে পারে, এখন ভাবলেই অবাক লাগে।
আজ আমি আমার জীবনের একটা সামান্য ঘটনার কথা বলি। এটা অবশ্য তেমন নাটকীয় পরিবর্তন নয়। আমি অন্তত ১৯৯৯ সালে বন্ধুদের কাছে পূর্বাভাস দিয়েছিলাম, বছর আট দশের মধ্যে এমন পরিবর্তন হবে যে, আমাদের ছেলে মেয়ে, “কম্পিউটার না জানলে পড়াশুনা করতে পারবে না”।
২০০৯ সালেও অন্তত স্কুলের ছেলে-মেয়েদের কম্পিউটার শিক্ষা শ্বাস বায়ুর মত অপরিহার্য হয়ে যায় নি। আজ, বিশ সাল বাদ সত্যিই সেটা অপরিহার্য হয়ে গেল।
উত্তর বঙ্গের একটা ছোট জেলা শহরের একটা সামান্য ডাক্তারের চেম্বারে কম্পিউটার বসানো হয়েছে, এটা একটা খবর হয়ে গেল। এখন মাত্র কুড়ি বছর আগের কয়েকটা তথ্যই যদি বলি, অনেক লোকের কাছে গাল-গল্প মনে হবে। একটা গবেষণার কাজ শুরু করার জন্য, একটা কম্পিউটার কিনব ঠিক করলাম। কিন্তু কম্পিউটারের চাকা থাকে না এন্টেনা থাকে, তাই জানতাম না। তখন তো মোবাইল ফোনও নেই। এমন কি আমার নিজের বাসায় একটা ল্যান্ড ফোনও নেই।
ভাগ্নের বন্ধু কমপিউটারের কাজ জানে, খবর পেয়ে তার কাছে খোঁজ খবর নিলাম। দু’শো কিলোমিটার দূরের শিলিগুড়ি শহরে পাওয়া যায় খবর পেলাম। পঞ্চাশ হাজার টাকা হলে একটা ডেস্কটপ কম্পিউটার হতে পারে। তাই কিনব ঠিক করলাম।
এবার ঐ সময়ে পঞ্চাশ হাজার টাকার সাথে আজকের পঞ্চাশ হাজারের তুলনাটা দেখা যাক। আমার প্রায় চার মাসের বেতনের সমান ছিল ঐ একটি ডেস্কটপ কম্পিউটার এর দাম। ভাবতে পারছেন? আজকের বাজারে একজন নতুন চাকরীতে ঢোকা ডাক্তারের বেতনের অর্ধেক টাকায় ওরকম একটা জিনিস কেনা যায়। না, ঠিক ওরকম জিনিস বললেও ভুল হচ্ছে। আমার প্রথম কম্পিউটারের যা ক্ষমতা ছিল, সে জিনিস এখন ফুটপাতে পড়ে থাকলেও লোকে কুড়িয়ে নিয়ে যাবে না। বত্রিশ এম বি র্যাম আর পাঁচশ এম বি হার্ড ডিস্ক! আজ আমার হাতের মোবাইল ফোনটার ক্ষমতাও তার একশ গুণ বেশী।
ঐ প্রথম কম্পিউটারের গল্প আর একটু বলি। আমার গবেষণার বিষয় দেখার থেকেও ঐ আশ্চর্য যন্ত্রটি দেখার জনই আমার বেশ কয়েকজন সহকর্মী প্রথম দিন আমার বাসায় এসেছিলেন। ভাগ্নের বন্ধু হিমাদ্রি আর বাপি আমার ঐ গবেষনার জন্য জরুরী সফ্টওয়ারটি তৈরী করেছিল। ওরা দুদিন আগে থেকে গিয়ে আমার বাসায় থেকে, আমার মেশিনে ঐ বিশেষ সফ্টওয়ারটি বসিয়েছিল। উদ্বোধনের দিন ওরা রায়গঞ্জে থেকে, মহার্ঘ যন্ত্রটি চালানোর কাজটি করেছিল। ১৯৯৯ সালের ১৫ ই আগস্ট হিমাদ্রির কাছে কম্পিউটার চালু করা আর বন্ধ করার কায়দা প্রথম শিখেছিলাম। ওরা ঐ দিন রাতে কোলকাতা ফিরে আসে। সে সময় রায়গঞ্জে আমার পরিচিত মাত্র দুজন কম্পিউটার জানা লোক ছিল। আর একটা খবর এখনকার বাচ্চাদেরও হাসির ব্যাপার হবে। তখন যারা কম্পিউটার জানতেন তারা “DOS” বলে একটা খটমট জিনিসই জানতেন। ঠিক ঐ সময়ই আমার মত শিক্ষানবিশদের সুবিধা করে “Windows” অপারেটিং সিস্টেম এসে গেছে। DOS ঠিক মত না জানার জন্য, প্রথম সপ্তাহেই একদিন আমি মেশিন চালু করে আর বন্ধ করতে পারিনি, লোক ডাকতে হয়েছিল।
ঐ দুজন পরিচিত কম্পিউটার জানা লোকের মধ্যে একজন আমার ভ্রাতৃপ্রতিম দাঁতের ডাক্তার। শহর থেকে দূরে একটা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চাকরী করত। শহরে আমার পাড়ায় বাসা ভাড়া করে থাকত। প্রথম কদিন ওকেই ধরলাম, আমাকে একটু আধটু শিখিয়ে দিতে। ও মাঝে মাঝে সন্ধ্যার দিকে আমার বাসায় এসে কম্পিউটার চালু করে এটা ওটা কাজ করে আমাদের শেখানোর চেষ্টা করত। এই “আমাদের” কথাটার মধ্যেই আমার এই নিবন্ধের আসল বক্তব্য আছে।
আমরা কারা? আমার ছেলের তখন আট বছর বয়স। ক্লাশ থ্রি তে পড়ে। ওকে কম্পিউটার শেখানোর চিন্তাও আমার মাথায় আসেনি। আমি যখন বাইরের ঘরে বসে ডাক্তার নিলয়ের কাছে শেখার চেষ্টা করতাম, ছেলেকে ভেতরের ঘরে বসিয়ে ওর মা স্কুলের পড়া মুখস্থ (?) করাত। মাঝে মাঝে ছেলে এসে আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে দেখত আমরা কি করছি। আমি কোন কাজে উঠে গেলে , নিলয় কাকু ছেলেকে কি সব শিখিয়েছে। দিন দশেক পর হঠাৎ করেই একদিন বুঝলাম, আমার থেকে আমার ছেলে অনেক বেশী শিখেছে।
একটা সুন্দর যোগাযোগ হল ঐ সময়। আমার পরিচিত এক দাদার বাড়িতে, জামশেদপুর থেকে একটি মেয়ে বেড়াতে এসেছিল। দাদা বা বৌদির সাথে আমার বাসায় একদিন বেড়াতে এসেছিল। কথায় কথায় জানলাম মেয়েটি কম্পিউটার জানে। শুধু জানেই না, একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শেখায়। ওকেই ধরলাম, যে কদিন রায়গঞ্জে থাকবে, আমাকে কম্পিউটার শেখাতে হবে। বোধহয় দিন পনের- কুড়ি ঐ ম্যাডামের কাছে আমার প্রথাগত কম্পিউটার শিক্ষা। ব্যাস; আর কোনদিন সেভাবে শেখা হয়নি। আমার ছেলের সেই আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে দেখতে দেখতেই শেখা। আজ পর্যন্ত আমি আর যা কিছু শিখেছি, সবই ভুল করতে করতে। ইংরেজীতে যাকে বলে, ট্রায়াল এরর করতে করতে শেখা। তার থেকেও বড় খবর হল, সেই ম্যাডামের কাছে শেখার পর আর যা কিছু শিখেছি, তার সিংহ ভাগ আমার ছেলে আর মেয়ের কাছে।
আমার ছেলে যখন ক্লাশ নাইনে পড়ে তখন ওর চেষ্টায় আমরা সাপের কামড়ের উপর একটা শিক্ষামুলক ভিডিও তৈরী করেছিলাম; সেকথা বিস্তৃত ভাবে লিখেছি অন্য জায়গায়। বিদ্যালয় স্তরে আমার ছেলেমেয়ে সামান্য কম্পিউটার শিখলেও ওদের পড়াশুনার জন্য সেটা অপরিহার্য ছিল না। কিন্তু ছেলের মেডিক্যাল কলেজ আর মেয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের পড়াশুনায় কম্পিউটার জরুরী হয়ে পড়ল। সাপের কামড়ের ভিডিও তৈরীর সময়েই আমার পুরনো মেশিনের ক্ষমতা বাড়াতে হয়েছিল। পরে এদের পড়াশুনার জন্য যখন নতুন মেশিন কিনতে হল, তার ক্ষমতা পুরনো মেশিনের শতগুণ বেশী হয়ে গেল।
আমার নিজের কাজের জন্য ল্যপটপের দরকার হলেও অনেক বছর কেনা হয়নি। কিন্তু ছেলে মেয়ের কাজের জন্য দু জনকেই একটা করে ল্যপটপ কিনতে হল । অর্থাৎ কুড়ি বছর আগে যে বাড়িতে একটা গোদা ডেস্কটপ কম্পিউটার কেনা হলে লোকে দেখতে এসেছিল, সে বাড়িতেই এখন তিনটি মেশিন একেবারে অত্যাবশ্যক হয়ে গেছে। এ হল একেবারেই একটি পারিবারিক ঘটনা।
আমাদের প্রাত্যহিক সমাজ জীবনে প্রায় প্রতিটি জরুরী কাজে কম্পিউটারের ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে গেছে বছর আট দশ আগেই।
অফিস কাচারীতে কম্পিঊটার যাতে ঢুকতে না পারে, তাই নিয়ে রাজনৈতিক আন্দোলন হয়েছিল, আমাদের এই রাজ্যেই, মাত্র ৩৫-৪০ বছর আগে! এ তথ্যটাই বোধহয় আজকের প্রজন্ম জানেই না। বিশেষ করে ব্যাঙ্ক আর রেল- উড়োজাহাজ পরিবহনে কম্পিউটারের ব্যবহার যে বৈপ্লবিক উন্নতি ঘটিয়েছে, দশ বছর আগেও আমরা তা ভাবিনি। মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলগুলিতে এখনও কম্পিউটার শিক্ষা আবশ্যিক হয়নি। কিন্তু এক অতিমারী শিক্ষা ব্যবস্থায় কম্পিউটার ব্যবহার আবশ্যিক করে দিল।
অন লাইন ক্লাশ নামক যে মহা বিপ্লব শিক্ষা ব্যবস্থায় চলছে, এটার কথা তো আমরা এ বছরের প্রথমেও জানতাম না। নয় মাসের উপর স্কুল কলেজ বন্ধ। বেসরকারি স্কুলগুলিতে অনেক আগেই কম্পিউটার শিক্ষা চালু হয়েছে। ওদের ছাত্র ছাত্রীদের তাই অনলাইন ক্লাশে বিশেষ অসুবিধাও হওয়ার কথা নয়। আমি নিজে সাপের কামড় নিয়ে কয়েকটা ক্লাশ নিয়ে দেখছি অসুবিধার থেকে সুবিধাই বেশী। শ্রেণী কক্ষে বসা ছাত্র ছাত্রীদের সঙ্গে সামনা সামনি কথা বলে পড়ানো একরকম আর আমার বাড়িতে ল্যাপটপের সামনে বসে আমি বলে যাচ্ছি, সেটা আর এক রকম। সুবিধা অসুবিধা যাই হোক, গ্রামের স্কুল, বিশেষ করে গ্রামের সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের এই সুযোগটাই নেই।
ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছেন বাঁকুড়া জেলার রাধানগর বোর্ড প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক সৌম্য সেনগুপ্ত। একার হাতে সব দায়িত্ব নিয়ে সৌম্য বাবু যে ছয় মাসের বেশী অনলাইন ক্লাশ চালিয়ে যাচ্ছেন এ খবর কজন জানেন? ওনার স্কুলের প্রায় কোন ছাত্র ছাত্রীদেরই বাড়িতে কমপিউটার বা স্মার্ট ফোন নেই, চাঁদা তুলে টিভিতে ক্লাসগুলো প্রচার করার ব্যবস্থা করেছেন সৌম্য বাবু। তাহলে কি এ রাজ্যের গ্রামগুলি শহরের থেকে এখনো কুড়ি বছর পিছিয়ে আছে?