“চাই এক শোষণ মুক্ত জগৎ। চাই সবার জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, ও শিক্ষা। চাই সবার জন্য স্বাস্থ্য। জানি আমি চাইলেই এসব কিছু হওয়ার নয়। হতে পারে সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে। সেই সংগ্রামের যারা অগ্রণী বাহিনী সেই শ্রমিক শ্রেণী এবং শ্রমিক শ্রেণীর দৃঢ় মিত্র কৃষকদের পাশে থেকে স্বাস্থ্যের কাজ করার চেষ্টা করি।“
ইউনিয়ন কার্বাইড-এর জমিতে ভোপালের গ্যাসপীড়িতদের উদ্যোগে, কলকাতা ও বম্বে থেকে আসা জুনিয়র ডাক্তারদের সহায়তায় শুরু হয় জনস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কাজ। সোডিয়াম থায়োসালফেট ইঞ্জেকশনে গ্যাস পীড়িতদের উপসর্গের উন্নতি হওয়ায় বিষগ্যাস সায়ানাইডের উপস্থিতি প্রমাণিত হয়, ইউনিয়ন কার্বাইডের criminal responsibility অনেক গুণ বেড়ে যায় । বহুজাতিক সংস্থার মিত্র রাষ্ট্রের প্রশাসন সক্রিয় হয়। রাতের অন্ধকারে গ্রেফতার হন চিকিৎসক স্বাস্থ্য কর্মী ও সংগঠকরা। বন্ধ স্বাস্থ্যকেন্দ্র চালু করতে ১৯৮৫ সালে কলকাতা থেকে এক জুনিয়র বন্ধু জ্যোতির্ময় সমাদ্দারের সঙ্গে ভোপাল যান নবীন চিকিৎসক ডক্টর পুণ্যব্রত গুণ – “সেদিন জামিনে ছাড়া পাবেন বন্দীরা- এক টিলার ওপর ভোপাল জেলের পেছনে সূর্য অস্ত যাচ্ছে- আধ ময়লা পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহিত এক দীর্ঘ দেহী পুরুষের স্লোগানে স্লোগান তুলছিল সমবেত জনতা – ‘জেল কা তালা টুটেগা, হামারা সাথী ছুটেগা’ – ছত্তিশ গড় মুক্তি মোর্চার নেতা শঙ্কর গুহ নিয়োগী । তাঁর সঙ্গে পরিচয় হল, জানালাম তাঁর আন্দোলনে আমার কাজ করার স্বপ্নের কথা।হিন্দির টান মেশানো বাংলায় বললেন –‘রাজনাদগাঁও এ আরেকটা হাসপাতাল খোলার কথা ভাবছি, চলে আসুন ..” । এই ভাবেই শুরু হয় গণস্বাস্থ্য আন্দোলনের এক চলমান অধ্যায়ের।
মেডিক্যাল কলেজে ঢোকার পর মেডিক্যাল কলেজ ডেমোক্র্যাটিক স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশান (MCDSA) জীবনের নতুন মানে খুঁজতে শেখায়, ডঃ নরম্যান বেথুন, ডঃ দ্বারকানাথ কোটনিসের মত ডাক্তার হবার স্বপ্ন দেখতে শেখায়। মনস্থির করে নেন পুণ্যব্রত গুণ- পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করবেন না, মানুষের পাশে থেকে, চিকিৎসা করবেন- সমাজ বদলের লড়াইয়ে যোগ দেবেন।
‘পা মিলিয়ে পথ চলা’ সঙ্কলন গ্রন্থের (২০১৮) শুরুতে লিখছেন লেখক “ছোট বেলা থেকেই ডাক্তার হবার শখ। ডাক্তারিতে চান্সও পেলাম, কিন্তু কলেজে গিয়ে পালটে গেল ডাক্তার হওয়ার উদ্দেশ্য। ঠিক করলাম ডাক্তারই হব, অন্য রকমের ডাক্তার। গ্যাস পীড়িত ভোপাল, ছত্তিশগড়ে লোহা খনি শ্রমিকদের হাসপাতাল, পশ্চিমবঙ্গের জুট শ্রমিকদের স্বাস্থ্য কর্মসূচি…। প্রায় সাড়ে তিন দশকের পথ চলেছি বিভিন্ন জনসমুদয়ের সঙ্গে বিভিন্ন জন আন্দোলনে।‘
ভোপাল জনস্বাস্থ্য কেন্দ্রে কাজ ছিল সোম থেকে শনি পর্যন্ত থায়োসালফেট ইঞ্জেকশন লাগানো, তার সঙ্গে রোগীদের উপসর্গ এবং জবানবন্দী লিপিবদ্ধ করা। সঙ্কলন গ্রন্থে ‘আমার ভোপাল’ প্রবন্ধে বিস্তারিত বিবরণ আছে এই পর্বের। নানা কারণে এই পর্ব দীর্ঘ স্থায়ী হয়নি। ১৯৮৫ র নভেম্বেরে কলকাতায় ফিরে আসেন। কিন্তু এই অভিজ্ঞতা স্বাস্থ্যকে ঘিরে গণ আন্দোলন তৈরি করতে শিখিয়েছে। চিকিৎসা, গবেষণা এবং আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার এবং ইউনিয়ন কার্বাইড-এর উপর চাপ সৃষ্টি করা ও ক্ষতিপূরণ বৃদ্ধি করায় অসামান্য ভূমিকা নেয় জনস্বাস্থ্য আন্দোলন।
এই বই-এর পরবর্তী লেখা ‘দল্লী রাজহরার জনস্বাস্থ্য আন্দোলন ও শহীদ হাসপাতাল’ যা পুণ্যব্রত গুণের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়-“ ছাত্রাবস্থায় দল্লী রাজহরার শ্রমিকদের স্বাস্থ্য আন্দোলনের গল্প শুনেছি… শহীদ হাসপাতাল থেকে অনুপ্রেরণা বেলুড়ের ইন্দো–জাপান স্টিলের শ্রমিক রা ১৯৮৩ তে যখন শ্রমজীবী স্বাস্থ্য প্রকল্পের কাজ শুরু করেন, তখন তাঁদের দোসর ছিল আমাদের সমাজসেবা সংগঠন পিপলস হেলথ সার্ভিস এ্যাসোসিয়েশন, সদ্য ডাক্তার আমিও ছিলাম সেই স্বাস্থ্য প্রকল্পের চিকিৎসক দের মধ্যে। শহীদ হাসপাতালে ছিলাম ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৪ আট বছর”।
এই আট বছরের এক অসামান্য দলিল “শঙ্কর গুহ নিয়োগীর সঙ্গে কয়েক বছর : এক সহযোদ্ধার প্রতিবেদন’ (২০১৬)’। শুরু তে এই বই এর সম্পর্কে জানাচ্ছেন লেখক “আজ থেকে ঠিক ২৫ বছর আগে, ১৯৯১ এর ২৮ সেপ্টেম্বর, দল্লী-রাজহরা থেকে ভিলাই চলেছি শহীদ হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সে। সঙ্গে নিয়োগীজীর স্ত্রী আশা। আমরা কিছুক্ষণ আগে খবর পেয়েছি গভীর রাতে ঘাতকের গুলিতে শহীদ হয়েছেন নিয়োগীজী…চুপ করে ভেবে চলেছি আমি, ১৯৮৯ এ সাহিত্য পরিষদ গঠন করে কমরেড শঙ্কর গুহ নিয়োগীর লেখাগুলো প্রকাশ করা শুরু করেছিলাম, আর অনেক লেখা প্রকাশ করা বাকি। বিভিন্ন আন্দোলনের ইতিহাস ঠিকমতো লিপিবদ্ধ হয়নি, লিপিবদ্ধ করতে হবে…।“
ছত্তিশগড় মুক্তি আন্দোলনের দলিল এই বইটির এক একটি অধ্যায় কয়েক দশক আগে ভারতের এক অংশে নিঃশব্দে ঘটে চলা এক বিপ্লবের ইতিহাস রচনা করে। এই ইতিহাস নিরপেক্ষ নির্মোহ নয়। এই ইতিহাস মেহনতী মানুষের পক্ষে। ১১ টি পরিচ্ছেদে আলোচিত হয়েছে ছত্তিশগড় মুক্তিমোর্চা, দল্লী রাজহরার জনস্বাস্থ্য আন্দোলন ও শহীদ হাসপাতাল, দল্লী রাজহরার মেশিনীকরণ বিরোধী আন্দোলন, ছত্তিশগড়ের নারী আন্দোলন শরাব বন্দী আন্দোলন, ভিলাই শহীদ দিবস, নিয়োগী পরবর্তী ছত্তিশগড় আন্দোলনে মতাদর্শগত সংগ্রাম এবং সংঘর্ষ ও নির্মাণের তত্ত্ব। লোহা খনির শ্রমিক সংগ্রামী লেখক- শিল্পী ফাগুরাম যাদব কে নিয়ে একটি স্বতন্ত্র পরিচ্ছেদ – “হর জুল্ম হর অত্যাচার / জুঝেঙ্গে হাম বার বার / মজদুর কিসান মিলকে আজ / উঠায়ে হ্যায় হথিয়ার / শহীদো কে খুন সে হম সব হ্যাঁয় তইয়ার“
সম্পূর্ণ ভাবে শ্রমিকদের অর্থে গড়ে ওঠা শহীদ হাসপাতালে আধুনিক স্বাস্থ্য পরিষেবা, যুক্তিসম্মত বিজ্ঞান সম্মত চিকিৎসা প্রয়োগের লড়াই, শল্য চিকিৎসার কেন্দ্র হিসাবে পরিচিতি,পরীক্ষা নিরীক্ষা ও অ্যাম্বুলেন্স এর ব্যবস্থা, ব্লাড ব্যাঙ্ক নির্মাণ এবং জাতীয় স্বাস্থ্য জনশিক্ষার কর্মসূচিতে সাফল্য নিয়ে গুরুত্ব পূর্ণ আলোচনা আছে এই বইয়ে। এই বই না পড়লে জানা যেত না যে দেশ ‘পোলিও মুক্ত‘ ঘোষণার ৩৫ বছর আগেই দল্লী রাজহরা পোলিও মুক্ত হয়েছিল।
শহীদ হাসপাতাল এবং রোগী এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, ভুল থেকে শেখার গল্প, রণব্রত সেন ও লালগড়ের কাছে কুসুমাশুলি গ্রামে প্রেমসেবা হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকর্মী নিরঞ্জন দেব সিংহ ও দিলীপ মাহাতোর কথা জানতে পারা যায় পা মিলিয়ে পথ চলা বই টি তে।
১৯৯১ এ নিয়োগীর হত্যার পর ১৯৯৫ সালে ছত্তিশগড় মুক্তিমোর্চার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয় লেখকের। কলকাতায় ফিরে আসেন। হাওড়ার ফুলেশ্বরে কানোরিয়া জুট মিলের শ্রমিকদের সংগ্রাম দানা বাঁধছিল। ১৯৯৫ সালে কানোরিয়া জুট সংগ্রামী শ্রমিক ইউনিয়নের স্বাস্থ্য কর্মসূচি শ্রমিক কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্রের পথ চলা শুরু। এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ার কাজে অগ্রণী ভুমিকা নিলেন ডঃ গুণ। শ্রমিক কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্র সংগঠিত রূপ নিলে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে চালানোর জন্য ডঃ পুণ্যব্রত গুণ, ডঃ সুমিত দাশ এবং ডঃ অমিতাভ চক্রবর্তী গড়ে তোলেন চিকিৎসক অচিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের সংগঠন শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ। শ্রমিক ইউনিয়ন বহুধাবিভক্ত হয়ে গেলে এই সংগঠন স্বাস্থ্য কেন্দ্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। মুরগির চালাকে বেড়া দিয়ে ঘিরে শুরু হয়েছিল চেঙ্গাইলে শ্রমিক কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্রের চিকিৎসা পরিষেবা। আজ পশ্চিমবঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের বাইরে বিভিন্ন প্রান্তে ১৩ টি স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ। শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ স্বাস্থ্য পরিষেবা ও চিকিৎসার বিকল্প মডেল তৈরির কাজে, ব্যবসায়ীকরণের বিরুদ্ধে সবার জন্য স্বাস্থ্যের জন্য প্রচার আন্দোলনে এবং সামাজিক ন্যায়ের সংগ্রামে নিরলস বিরামহীন কাজ করে চলেছে।
সকলের জন্য সমপরিষেবা আর সুপারিশহীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, রোগী পরিষেবা উন্নত করার মাধ্যমে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের উন্নত সুরক্ষা, জুট ও কটন মিলের শ্রমিকদের পেশাগত অসুখ শ্বাসকষ্ট নিয়ে গবেষণা, চিকিৎসকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ এবং পেশাগত রোগ নির্ণয় কেন্দ্রের প্রয়োজনীয়তা প্রভৃতি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন লেখক ‘পা মিলিয়ে পথ চলা’ বইটিতে।
২০১২ থেকে চলছে সর্বজনীন স্বাস্থ্যের দাবিতে গণ আন্দোলন গড়ে তোলার নিরলস প্রয়াস। নতুন প্রজন্মকে এই আন্দোলনে শামিল করে এক নিরবচ্ছিন্ন প্রবহমানতার ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন লেখক এই গ্রন্থে – “ব্যাটন তুলে দিয়েছি আমরা পরবর্তী প্রজন্মগুলোর হাতে। জানি আমরা না থাকলেও আন্দোলনের ধারা থেমে থাকবে না”;
কালান্তর পত্রিকায় ১৭ নভেম্বর ২০২৫ প্রকাশিত।












