বছর দুয়েক আগের ঘটনা। পাশের ব্লকের এক সিভিক ভলান্টিয়ার হপ্তা দুয়েকের জ্বর নিয়ে এক সন্ধ্যায় আমার চেম্বারে হাজির। সাথে এক পুলিশ বন্ধু। চোখে মুখে পুলিশোচিত গাম্ভীর্য এক্কেবারেই নেই। বরং দীর্ঘ রোগভোগে রীতিমতো দীর্ন।চোখের তলায় কালশিটে পড়েছে।খুব ভালোভাবে লক্ষ্য করলে শ্যামলা গায়ে লাল লাল র্যাশ হালকা ভাবে বোঝা যাচ্ছে। এই ক’দিনে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া,টাইফয়েড,জন্ডিসের সমস্ত পরীক্ষানিরিক্ষা করা হয়েছে। গ্রামীন চিকিৎসক বলেছেন ওয়াইডাল টেষ্ট যেহেতু স্বল্প মাত্রায় পজিটিভ তাই এ রোগ নির্ঘাৎ টাইফয়েড। সেইমতো প্রথম তিনদিনে তিনটি মুখে খাওয়ার অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করেছেন। ফল না পেয়ে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের চিকিৎসাবিজ্ঞান কে অবজ্ঞা করে অবশেষে বহুল প্রচলিত এক অ্যান্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশন প্রয়োগ করেছেন। তাতেও কাজ না হওয়ায় অবশেষে ভুবনেশ্বরের নামী হাসপাতালে যেতে বলেছেন। ইতোমধ্যে জ্বর পাঁচ দিন পেরিয়ে ষষ্ঠ দিনে পা দিয়েছে। একা জ্বরে রক্ষা নেই, এখন যোগ হয়েছে তীব্র মাথাযন্ত্রনা, গায়ে লাল লাল র্যাশও বেরোতে শুরু হয়েছে। সাথে আবার তীব্র ক্ষুধামান্দ্য। জ্বর গায়ে ভুবনেশ্বর পাড়ি দেওয়ার ঝুঁকি না নিয়ে অবশেষে এক গ্রামীন নার্সিংহোমে ভরতি হয়েছেন তিনি। যেখানে আবার পাশ করা চিকিৎসক নেই। ফলে পূনরায় অ্যান্টিবায়োটিক ও একই টেষ্টের পুনরাবৃত্তি। সাথে শুধু যোগ হয়েছে স্যালাইন। দিন পাঁচেক ভরতি থাকার পরেও জ্বরের কোনো সুরাহা হয়নি। বাড়তি প্রাপ্তি বলতে মস্তিষ্কের সিটি স্ক্যান, পেটের আল্ট্রাসাউন্ড রিপোর্ট, বুকের এক্সরে। সব নরমাল। কিছুতেই কিছু না পেয়ে নার্সিংহোমের মালিক বলেছেন এইচ আই ভি টেষ্ট করাতে।
শেষ কথাটিতে বেঁকে বসেছেন রোগী। রেগে গিয়ে এবার নার্সিংহোম থেকে বেরিয়ে এসেছেন তিনি। ততদিনে শরীরের ওজন কমেছে কিলো পাঁচেক। ভয় পেয়ে অবশেষে কাছের সরকারি গ্রামীণ হাসপাতালে রোগীকে ভরতি করা হলো। ততক্ষণে শুকনো কাশি শুরু হয়েছে। শরীরের যত্রতত্র কয়েকটি লসিকাগ্রন্থি ফুলেছে। র্যাশ বেড়েছে শরীরের মূলতঃ উপরিভাগে। সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক কাশি ও ফুলে ওঠা লসিকাগ্রন্থি দেখে টিউবারকিউলোসিস সন্দেহ করে কফের পরীক্ষা করতে দিলেন। গোপনে এইচ আই ভি টেষ্টও করা হলো। সমস্ত রিপোর্ট নরমাল। এবার অগত্যা তিনি মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজে রেফার করলেন রোগীকে।
মেডিক্যাল কলেজে যাবার পথেই আমার চেম্বার। দিশাহারা বাড়ির লোক আমার কাছে এনেছেন যদি কিছু দিশা দেখাতে পারি, সেই আশায়।চেম্বারে আসা পুলিশ বন্ধুর হাত থেকে সমস্ত রিপোর্ট গুলো খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলাম। লিভার এনজাইম বেড়েছে কিন্তু বিলিরুবিন স্বাভাবিক। অ্যালবুমিন কমেছে। প্লেটলেট কম।লিম্ফোসাইটের পরিমান প্রথমে কমলেও পরের রিপোর্টে তা স্বাভাবিকের থেকে খানিক বেড়েছে। রোগীর হাতের স্যালাইনের নলটিকে সাবধানে সরিয়ে রেখে জামা খুলে দেখলাম র্যাশ গুলো কেন্দ্রমুখী। প্লীহা বেড়েছে। হঠাৎ লিভারে চাপ দিতে গিয়ে দেখতে পেলাম ডান বাহুর নিচ অংশে পিঠের দিকে একটা ফুসকুড়ি, যার মধ্যখানে কালো শক্ত একটা ছোট্ট অংশ থাকলেও চারিপাশ হালকা লাল। জায়গাটায় ব্যথা আছে কিনা জিজ্ঞেস করায় ভদ্রলোক বিরসবদনে বললেন ‘না’।
ফুসকুড়িটা কিভাবে হলো? ভদ্রলোক বললেন- জানিনা। দিন সাতেক আগে খেয়াল করেছেন শুধু।
এবার আবার মাথায় যেন বিদ্যুৎ খেলে গেলো। চকিতে জিজ্ঞেস করলাম- একটু ভেবে বলুন তো, জ্বর আসার আগে কোনো ঝোপঝাড়ে কাজ করেছিলেন কিনা? ভদ্রলোক আমার কথায় খানিক ভ্রুক্ষেপহীন জবাব দিলেন – জ্বর আসার দিন দশেক আগে বাড়ির সামনের সমস্ত ঝোপঝাড় পরিষ্কার করেছিলেন একা হাতেই। এবার আমার দুয়ে দুয়ে চার মেলানোর পালা। গোলগোল চোখে বললাম ‘ স্ক্রাব টাইফাস’।
সাথেসাথে স্ক্রাব টাইফাসের অ্যান্টিবডি টেষ্ট করানো হলো। যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। ঝোপঝাড় থেকে কখন যে লাল রঙের ছোট্ট পোকার কামড়ের মাধ্যমে শরীরে ওরিয়েন্সিয়া সুসুগামুসির আক্রমণ ঘটেছে তা বুঝতেই পারেননি ভদ্রলোক। চিকিৎসা নিতান্তই টেট্রাসাইক্লিন বা অ্যাজিথ্রোমাইসিন গ্রুপের ওষুধ।
ওষুধ প্রয়োগের পরদিনই জ্বর একেবারে ধাঁ। দিন তিনেক পরে আবার এলেন ভদ্রলোক। সাথে থানার মেজোবাবু। বুক চিতিয়ে সম্মান জানালেন। সাথে গুচ্ছের প্রশস্তিবাক্য।
ওঁরা চলে যেতেই মনে পড়লো বছর খানেক আগের কথা। নিলুর স্ত্রীরও সেদিন স্ক্রাব টাইফাস হয়েছিলো। কোনোভাবেই সেদিন রোগনির্ণয় করতে পারিনি। অবশেষে দক্ষিনের এক হাসপাতালে রোগনির্ণয় হয়ে চিকিৎসা হয়েছিলো তার। সেদিনের অপারগতা আজ সুদে আসলে মিটিয়ে নিলাম শুধু।