আমরা স্কুলে পড়ার সময় লজিক বইতে পড়েছিলাম, যেখানে ধোঁয়া আছে, সেখানেই আগুন আছে। অর্থাৎ ধোঁয়া হতে গেলে আগুন লাগবে। আগুন আবিষ্কারকে মনুষ্য সভ্যতার সূচনা বলা হয়। অর্থাৎ আগুনই সভ্যতার মানদণ্ড। সেই আগুন জ্বললে ধোঁয়া হয়। আগুনেরও ক্রমশ উন্নতি হয়েছে। এখন অনেক রকম আগুন এমন ভাবে জ্বলে যে ধোঁয়া বের হয় না। আবার আগুন ছাড়াও ধোঁয়া হতে পারে। তাই ধোঁয়া নিয়ে কোন প্রবন্ধ না লিখে আমার জীবনে দেখা কিছু বিশেষ বিশেষ ধোঁয়া নিয়ে কিছু লিখি।
ধূপ আর ধুনার ধোঁয়া আমরা প্রায় জ্ঞান হওয়া থেকেই দেখেছি। বাড়ীতে প্রায় সব দিনই ধূপ জ্বালা হয়। এই ধূপ নিয়ে কত রকম পরীক্ষানিরীক্ষা হল। সুগন্ধী ধূপ, মশা তাড়ানোর ধূপ, ধুনা ধূপ, কাঠি ছাড়া ধূপ, ইত্যাদি। কিন্তু শ্রী শ্রী ঠাকুরের গলার ক্যনসারের একটা কারণ হতে পারে, বছরের পর বছর ধূপ ধুনার ধোঁয়ার ভেতর থাকা; এটা জানার পর থেকে ঘরের ভেতর ধূপ জ্বেলে রাখা বন্ধ হয়েছে। এখন ঘরের ভেতর একবার ধূপ জ্বেলে ঠাকুরের সিংহাসনের কাছে না রেখে, সেই ধূপ বারান্দায় তুলসীর টবে রেখে দেওয়া হয়। ধুনা জ্বেলে ধোঁয়া করা তো যে কোন পূজার সময় একটা আবশ্যিক কাজ। এছাড়াও মশা তাড়ানোর জন্য সন্ধ্যে বেলা ধুনার ধোঁয়া করা একসময় রোজকার কাজ ছিল। কিন্তু ক্রমশ দেখা গেল, ধুনার ধোঁয়ায়ও মশা যাচ্ছে না। উল্টে জামা কাপড়ে গন্ধকের গন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ধুনা জ্বেলে ধোঁয়া করার জন্য নারকেলের ছোবড়া ব্যবহার করা হত। মেদিনীপুর শহরে গিয়ে দেখলাম, দোকানদাররা একরকম কালো বাতাসার মত জিনিস ব্যবহার করে।
গ্রামে থাকতে ধুনা মানে জানতাম পূজার সময় মাটির ধুনুচিতে নারকেল ছোবড়া জ্বালানো। পরে শহরে গিয়ে জানলাম, ধুনুচি নাচ। দু হাতে দুটি, মুখে একটি মাটির ধুনুচি নিয়ে নাচ; সেও এক বিশাল আলোচনার বিষয়। মশা তাড়ানোর জন্য ধুনার ধোঁয়া যেমন মানুষের থাকার ঘরে দেওয়া হয়, সেরকম গরুর গোয়ালে সন্ধ্যেবেলা ধোঁয়া দেওয়াকে সাঁজাল দেওয়া বলে। এটা বোধহয় এখনো গ্রামাঞ্চলে খুব চালু আছে। গরুর গোয়ালে ধুনার ধোঁয়া দেওয়া হয় না; শুধু একটু ভেজা খড় বা বিচালি জ্বালিয়ে প্রচুর ধোঁয়া করা হয়। গোয়াল ঘর ধোঁয়ায় একেবারে অন্ধকার হয়ে যায়। কিন্তু তাতে মশা কতটা তাড়ানো যায় আমার জানা নেই এই ভেজা খড় বিচালি জ্বালানো বলতে মনে পড়ল, খুব ছোটবেলায় দেখতাম, গ্রামের বাড়িতে গোবর আর নোংরা খড় বিচালি মাঠে একটা জায়গায় জমা করা হতো। ভোররাত্রে ওই বিচালিতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হতো। দূর থেকে আগুন দেখা যেত না; শুধু ধোঁয়া উঠছে দেখতে পেতাম। শীতের প্রথমদিকে এই ধোঁয়া কিছুটা উঠে, মাঠের উপর দিয়ে আড়াআড়ি চলে যেত অনেক দূর পর্যন্ত। একটা ধোঁয়ার স্তর দেখা যেত। এছাড়া গ্রামে আখ মাড়াই কল বসলে আখের রস থেকে গুড় তৈরীর উনান জ্বলত, তার ধোঁয়া অনেক দূর থেকে দেখা যেত। গ্রামে আর একটা জিনিস দেখতাম; ধান কেটে নেওয়ার পরে ধান গাছের গোড়ার অংশ মাঠে পড়ে থাকত, তাকে বলত নাড়া। সেগুলোকে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হতো তার ধোঁয়া অনেক দূর থেকে দেখতে পেতাম।
গ্রামে প্রতিদিনের রান্না, ধান সেদ্ধ, মুড়ি ভাজা এসব কাজের জন্য কাঠের উনানই ব্যবহার করা হয়। কাঠের উনানের থেকেও প্রচুর ধোঁয়া হয়। রান্নার উনানের ধোঁয়া নিয়ে একটা মর্মান্তিক ইতিহাস শুনেছিলাম, স্কুলের শিক্ষক প্রভাকরবাবুর কাছে। মন্যন্তরের সময় কারো বাড়ীতে রান্নার ঊনান জ্বাললে যে ধোঁয়া হত তাই দেখে অনাহারে থাকা মানুষগুলি এসে ফ্যান চাইত। মানবতার এমন নৃশংস ইতিহাস আমাদের দেখতে হয়নি; এজন্য নিজেদের সৌভাগ্যবান মনে করা উচিত।
আমাদের গ্রামের বাড়ীতে আর স্কুলের বোর্ডিং- এর রান্না, কয়লার উনানে হত। কয়লার উনান জ্বালানোর সময় প্রথমে প্রচন্ড ধোঁয়া হত। বাজারের সব চায়ের দোকানে কয়লার উনানই জ্বলত। সকালবেলা সে সব উনানের কয়লায় ধোঁয়া গোটা বাজার এলাকা ঢেকে রাখত। প্রফেসার সান্যাল স্যারের কাছে জানলাম, ঐ কয়লার উনানের ধোঁয়া থেকেও ফুসফুসের ক্যানসারের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ফুসফুসের ক্যানসার বললেই ধূমপানের কথা মাথায় আসে। এ নিয়ে যত কম বলা যায় ততোই ভাল। মহাভারতের যক্ষের প্রশ্ন ছিল, কিমাশ্চর্যম অতঃপরম? উত্তরে যুধীষ্ঠির কি বলেছিলেন, আমরা জানি। আজ যদি ঐ প্রশ্ন করা হয়, মহারাজ যুধিষ্ঠির নিশ্চয়ই বলবেন, “চোখের সামনে বন্ধু বান্ধব, পরিচিত জন ফুসফুসের ক্যানসারে মারা যাচ্ছে দেখেও, শিক্ষিত লোকেরাও ধূমপান চালিয়েই যাচ্ছেন, এটাই সবথেকে আশ্চর্যের। “আমার সবথেকে অবাক লাগে, যারা যত বেশী জানে, তারাই তত বেশী ধূমপান করে। পাশের অ-ধূমপায়ী লোকটাকে সিগারেটের ধোঁয়া খাইয়ে যে কী পৈশাচিক আনন্দ পাওয়া যায় আমি জানি না। রাস্তার গাড়ীর ধোয়া থেকেও ফুসফুসের ক্যনসার হতে পারে; এই বদ যুক্তিটা আবদ্ধ ঘরে বসে সিগারেট খাওয়ার সময় অনেকেই বলে। তবুও সরে গিয়ে সিগারেটটা খেয়ে আসার মত সততা দেখাতে পারেন না।
থাক এ অপ্রিয় প্রসঙ্গ। ধোঁয়া নিয়ে আমার আর কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলি। ছোট বেলায় শীতের সকালে, চাদর মুড়ি দিয়ে রোদ পোয়াতে বসতাম। তখন হাঁ করে মুখ দিয়ে বাতাস ছাড়লে ধোঁয়া বের হত। এও এক রকম আগুন ছাড়া ধোঁয়া। কিছুদিন আগে মাছের বাজারে দেখি, এক কম বয়সি মাছ বিক্রেতা ডেকে বলছে, দেখুন ইলিশ মাছের গা থেকে এখনও ধোঁয়া বেরচ্ছে! সদ্য বরফ থেকে বের করা মাছের গা থেকে ধোঁয়া বেরচ্ছিল। বড় বরফের চাঁই পড়ে থাকলে তার থেকেও ধোঁয়া বেরতে দেখা যায়।
স্কুল কলেজের ল্যাবরেটরিতে দেখেছি, অনেক বিক্রিয়ার সময় টেষ্ট টিউব থেকে ধোঁয়া বেরয়। এখন বাড়ীতে বাথরুম পরিষ্কারের জন্য আসিড ঢাললে ধোঁয়া উঠতে দেখি। বাড়ীর ইলেকট্রিকের তারে ধোঁয়া উঠতে দেখে বিপদের গন্ধ পাওয়া যায়। মেট্রো রেলের চাকায় ধোঁয়া দেখতে পেলে তো চরম বিপদ। ছোট বেলায় আকাশের এ মাথা থেকে ওমাথা একটা ধোঁয়ার লাইন চলে যেতে দেখলে বলতাম, রকেট যাচ্ছে। আসলে ওগুলো ছিল এরোপ্লেনের ধোঁয়া। বিশেষ কোন আবহাওয়ায় ওরকম সাদা একটা সরল রেখা টেনে যেত, আকাশের গায়। কিছু বছর থেকে দেখছি, যুদ্ধ বিমানে তিন রঙের ধোঁয়া দিয়ে আকাশে কৌশল দেখানো হয়। একবার বারাসত থেকে বাসে বারাকপুর আসার সময় দেখেছি, একটা যাত্রিবাহী বিমান অনেকটা নেমে এসেও আবার উপরে উঠে গেল, প্রচুর কালো ধোঁয়া ছেড়ে। বিমান বন্দরে বসে থাকার সময় কাছে থেকে বিমান উঠতে নামতে দেখেছি, কখনো ধোঁয়া বেরতে দেখিনি। জঙ্গলের ভেতরে নিজেদের অবস্থান জানানোর জন্য অভিযাত্রীরা আগুন জ্বেলে ধোঁয়া করে; ঐ ধোঁয়া দেখে আকাশের বিমান ওদের অবস্থান বুঝতে পারে। বিমান থেকে ধোঁয়া দেখার ভয়ঙ্গকরতম দৃশ্য আমরা অনেকে ছবিতে দেখেছি। ওটিই যেন শেষ পারমানবিক বোমার ধোঁয়ার কুন্ডলি হয়, এমন প্রার্থনা গোটা মানব জাতি করে চলেছে। হ্যাঁ, আমি হিরোসিমার আকাশে প্রথম আটম বোমা বিস্ফোরণের কথাই বলছি। কিন্তু আবারও বলছি, ঐ দুটি আটম বোমা যত মানুষকে মেরেছে তার থেকে অনেক বেশী মানুষ মারা গিয়েছে সিগারেটের ধোঁয়ায়।
কয়লায় চলা রেল গাড়ীর ধোঁয়া অপু দুর্গার চোখে যে স্বপ্ন এঁকে দিয়েছিল , সে স্বপ্ন আমরা আজও চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই। কয়লার ইঞ্জিনের ধোঁয়া ইতিহাসে চলে গেছে। কিন্তু আমাদের শৈশবের স্মৃতিতে আজও উজ্জল সেই কালো ধোঁয়া। কারখানার চিমনির ধোঁয়াও ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। এখনও বহু দূর থেকে দেখা যায়, তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উঁচু চিমনির ধোঁয়া।
ধোঁয়ার কথা লিখতে গিয়ে মনে পড়ল স্কুলের এন সি সি ডে-তে আমাদের দেখানো যুদ্ধের মহড়া। স্কুলের ফুটবল মাঠের পাশে, আমাদের একজন, গুঁড়ি মেরে এগিয়ে একটা স্মোক বোম জ্বালিয়ে দিয়েছিল। বিরাট এলাকা মেঘের মত ধোঁয়ায় ছেয়ে গেল। সেই ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে আমরা কজন কাঠের ভারী বন্দুক নিয়ে ছুটে যুদ্ধের অভিনয় করলাম। এন সি সি স্যার প্রচুর সিগারেট খেতেন, কয়েক বছর আগে ফুসফুসের ক্যানসারে মারা গেলেন । মৃত্যুর কথায় মনে পড়ল বছর তিরিশ আগের এক নৃশংস হত্যাকান্ডের কথা। খুন করে মৃতদেহ তন্দুরে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। দূর থেকে ঐ তন্দুরের ধোঁয়া দেখে নাকি এক ট্রাক ড্রাইভারের প্রথম সন্দেহ হয় যে ওখানে মানুষের দেহ পুড়ছে। কয়েক বছর আগে, কোলকাতার এক হাসপাতালে আগুন লেগে বহু মানুষ মারা গেলেন । সরাসরি আগুনে পুড়ে যত লোক মারা যান তার থেকে অনেক বেশী মানুষ মারা যান বিষাক্ত ধোঁয়ায়।
শরৎ বাবু প্রায় একশ বছর আগে লিখে গেছেন, অভাগী খড় পোড়ানো ধোঁয়ায় চড়ে স্বর্গে গেছে। আজও পৃথিবীতে যতো মানুষ বাড়ী গাড়ীর স্বপ্ন দেখে, তার থেকে অনেক বেশী মানুষ স্বপ্ন দেখে প্রতিদিন সকালে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চায়ের, আর দিনান্তে এক থালা ধোঁয়া ওঠা গরম ভাতের।
_________
গতকাল আমার ” ধোঁয়া” লেখাটাতে BSMC -র একটা অভিজ্ঞতা বাদ পড়েছিল। এখানে কারো কারো মনে পড়বে নিশ্চয়ই। ধূমপানের আর একটা অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমি যখন জুনিয়ার ডাক্তার, আমাদের হোষ্টেলের ভেতর দিকে একটা তিন কোনা জায়গায় আমি কিছু ফুলের গাছ লাগিয়ে বাগান করেছিলাম। সবদিন বিকেলে ঘন্টা খানেক ঐ বাগানে নেমে কাজ করতাম। একদিন বিকেলে আমার এক বন্ধু বারান্দার বেরিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল, আমি কোথাও কিছু পোড়াচ্ছি কি না। ও কাপড় পোড়ার গন্ধ পেয়েছে। ঠিক, আমিও একটা কাপড় পোড়া গন্ধ পেলাম। কিন্তু কোথাও আগুন দেখতে পেলাম না। সন্ধের ওয়ার্ড রাউন্ড শেষ করে আমি আমার এক জুনিয়ারের সাথে হোষ্টেলে ফিরে দোতলায় ওঠার ঠিক আগে দেখলাম, বাঁদিকের একটা ঘরের দরজার ওপর থেকে ধোঁয়া বেরচ্ছে। সাথে সাথে আমি আর ঐ ভাই ছুটে পিছন দিকে গিয়ে, ঐ ঘরের জানালা দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। কাঁচের জানালার ফ্রেম ধরে একটা হ্যাচকা টান দিতেই জানালা ভেঙ্গে গেল । দেখলাম ঘরের ভেতরের লোহার খাটের ওপর বিছানাটা জ্বলছে। আমরা দুজনে আগুন আগুন করে চেঁচাতে শুরু করলাম। আমার ভাইটি ছিল তোতলা; ও ছুটে গিয়ে যে যে ঘরে ছেলেরা ছিল তাদের দরজায় কড়া নেড়ে সকলকে ডাকতে থাকল। একজনের কাছে একটা লোহার ডাম্বেল ছিল; তাই নিয়ে ছুটে এসে দু চার ঘা মেরে ঘরের তালা ভেঙ্গে ফেলল। দরজা খুলতেই ঘরের থেকে এত ধোঁয়া বেরতে থাকল যে বারান্দায় থাকা দায়। দুজন এর মধ্যে বাগানে জল দেওয়ার পাইপ বা্থরুমে লাগিয়ে জল এনে ফেলল। আগুন নেভার পর দেখলাম , বিছানা পুড়ে ছাই। আমাদের জল ছেটানোর চোটে বই পত্র সব ভিজে গেছে। ঐ ঘরের ছেলেটির খোঁজ করে জানা গেল, সে দুপুরে বিষ্ণুপুরে, বাড়ী চলে গেছে। পরদিন সে আসার পর নিজেই বলল যে, বেরনোর সময় সিগারেট জ্বেলেছিল।