ছোটবেলার বন্ধু তিয়াসার জন্য একটা নদী কিনবে ভেবেছে বাবান। বিদেশ থেকে যখনই সে ফোন করে তিয়াসাকে , তিয়াসা অজয় নদের শুকিয়ে যাওয়ার কথা বলে।
তিয়াসা আর বাবান,কাশের ঝাড় আর বুনো আকন্দের ঝোপ পেরিয়ে বালির ওপর দিয়ে সর সর করে নদীর খাদে নেমে পড়ল। গ্রীষ্মের অজয় নদ, জলের ধারা অনেকটা নীচে এবং অতি ক্ষীনকায়।
– ইস, কোথায় রে জল ? এ তো মরুভূমি !
– নারে, আছে তবে অনেক দূরে। চল ছুটতে ছুটতে যাই।
তারপর ওরা বালির ওপরে ছুটতে ছুটতে অনেকটা দূরে গিয়ে কোন রকমে একটু জলে পা ডোবাতে পারল। হাঁফিয়ে হাঁফিয়ে তিয়াসা বলল,- দেখলি তো আমি মিথ্যে বলি না।
– দেখ প্রয়োজনের খাতিরে মিথ্যে বলতে অসুবিধা কোথায়?
– তুই কি মিথ্যে বলতে শিখেছিস ? ধর্ম্মপুত্তুর !
– সে ছিলাম তখন। আমার বস্ কি বলে জানিস,জীবনে দাঁড়াতে গেলে,শিখরে উঠতে গেলে অত বাছবিচার করতে নেই। এই সিলিকন ভ্যালি বড় কঠিন জায়গা।
– বেশ আছি। না ইঁদুর, না বাঁদর। না দৌড়, না লাফানো।
– দেখ, আমি আর সাতদিন থাকব। তুই এখনও আমার প্রশ্নের জবাব দিসনি।
বিকেলের আলো তীর্যক হচ্ছে। সূর্য পশ্চিমে হেলেছে। বালির গর্ত্তে গর্ত্তে অল্প জলে সূর্য্যের লাল রশ্মি প্রতিফলিত হয়ে চিক চিক করছে। পা ডুবিয়ে বসে আছে দুই বন্ধু । কবে তারা এক সাথে পড়ত, তারপর অজয় দিয়ে কত জল বয়ে গেছে। বাবান আই টি-র বড় কোম্পানিতে সিনিয়র রিসার্চার। ক্যালিফোর্নিয়ায় তার চাকরি । তিয়াসা গ্রামের স্কুলের চাকরি পেয়েছিল অনেক কষ্টে। কোন কারণে জয়েন করতে পারেনি। টিউশনি করে। ইদানিং খুব রোগা হয়ে গেছে। মুখটা একেবারে শুকনো,পাংশু।
– তুই যে একা থাকিস, ভয় করে না ?
– কিসের ভয়? এই যে অজয় ,সে আগের মত কি আর আছে? শুধু বালি আর বালি। জল খুঁজে পাই না। সে কি ভয় পায়?
– তোকে বলেছি যে তুই পাসপোর্ট বানাবি, ভিসা করাবি। আমি বাকিটা দেখব।
– আমি পাসপোর্ট অফিসে গেলে, তারা কি বলবে জানিস ?
– তুই বল?
অকারণে তিয়াসা খুব জোরে হাসল, সেই হাসির শব্দ তরঙ্গায়িত হয়ে বুনো পাখির মতো ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে পাড় অবধি গিয়ে আবার ফিরে এল। হাসতে হাসতে তার চোখ জলে চিক চিক করছে । সে কি পাগল হয়ে যাচ্ছে ? তাদের ভগ্নপ্রায় বসত বাড়ির ঝুর ঝুরে পলেস্তারার মত খসে পড়ছে তার মানসিক সুস্থতা । হঠাৎ তার খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে।
পেটের ভিতরটা গুলিয়ে উঠল।
– তুই খুব রোগা হয়ে যাচ্ছিস তিয়াস ।
– এক এক্কে এক,এক দু গুনে দুই
বাবান আমার মিষ্টি ছেলে, গুনের অন্ত নাই।
– তুই ঠাট্টা করছিস তিয়াস ?
– না মনা, তুই মাসে কয়েক হাজার ডলার ইনকাম করিস। তোর নিউ ইয়র্কেও একটা অ্যাপার্টমেন্ট আছে। আমি জানি। আর তোর কোন বান্ধবী এখনও অবধি জোটেনি তাও জানি। মাসিমা মেসোমশাই আমাকে পছন্দ করেন তাও জানি।
-তবুও, তুই ?
– আমি তোকে ভালোবাসতে পারিনা। আগে বাসতাম।
– কিন্তু কেন, কেন ?
– ওঠ, সন্ধ্যা হয়ে এল। শিয়ালরা এখানে জল খেতে আসে। মরা অজয়, তবুও কত লোক কত পশু একে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চায়।
– আমি তোর এই অবান্তর অপটিমিজমের তত্ত্ব জানতে চাই না। তুই বাস্তবে আয় । আমার কথার উত্তর দে।
খিল খিল করে হাসে তিয়াসা । হাসতে হাসতে আবার কুঁকড়ে গেল যন্ত্রণায়। তার শরীরে ঘাম হচ্ছে। অসহ্য যন্ত্রণা তলপেটে। উঠতে গিয়ে পারল না, টলে গেল। বাবান তার হাত ধরে দাঁড় করাল।
– আমরা দুটি ভাই শিবের গাজন গাই
ঠাকমা গেছে গয়া কাশি..।
– চুপ কর পাগলি। বল ডাঃ গাঙ্গুলি যা বলেছে তা কি ঠিক ?
– যে নদী হারায়ে স্রোত.. ।
– বন্ধ কর, বন্ধ কর।
দুজনে নদীর খাদ থেকে উঠে এল। বাবান জানেনা ‘ ওভারিয়ান কার্সিনোমা’ কতটা কঠিন অসুখ ? সে কি বাঁচাতে পারবে তিয়াসাকে?
ঘটনাচক্রে ডক্টর সুবীর গাঙ্গুলী বাবানেরই বন্ধু। তিনি শুনে বাবানকে বলেছেন ‘এই বয়েসের ক্ষেত্রে খুবই রেয়ার টিউমার–কর্কট, তবে বেটার প্রসপেক্ট।
(শেষ)