যখন মেডিক্যাল কলেজে ইন্টার্ন ছিলাম তখন আমাদের একটা প্রধান কাজ ছিল রুগীদের রক্ত টানা, ব্লাড ব্যাংক থেকে রক্ত আনানোর জন্য ‘ব্লাড রিকুইজিশন’ করা আর আই ভি ক্যানুলা করা। শেষের কাজটাকে আমরা বলতাম চ্যানেল করা। যখন শিশুদের বিভাগে বা হেমাটোলজি বিভাগে কাজ পড়তো তখন থ্যালাসেমিয়া রুগীদের রক্তটানা বা রক্ত দেওয়া আমাদের কাজ ছিল। কাজটা এমন কিছু কঠিন ছিল না, কিন্তু বাচ্চাগুলোর কান্না, মনখারাপ, এই কাজটাকে ভীষণ কঠিন করে দিত। মাঝে মাঝে ওয়ার্ড রাউন্ডে ওদের সাথে লুডো খেলাও আমাদের কাজ ছিল।ওরা যখন রক্ত নিয়ে হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরে যেত তখন মনটা ভার হয়ে যেত, তখন ফিরে এসে গালে হাত বুলিয়ে বলতো, ‘সামনের মাসেই দেখা হবে।’ তখন চোখে স্বপ্ন ছিলো পৃথিবীটা বদলে দেব। এখনও মনে আশা আছে পৃথিবীটা বদলে যাবে। আজ বাবা হয়ে আর একটা জিনিস মনে পড়ে, যেটা তখন চোখে পড়ত না। বাবা মায়ের চোখের জল, রক্ত জোগাড় করতে তাদের হয়রানি।
থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত সমস্যা। এই রোগে মানুষের রক্তের লোহিত কণিকা খুব তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায়। সাধারণত শৈশবেই এই রোগ ধরা পড়ে। শিশুকে বাঁচিয়ে রাখতে মাসে এক বা একাধিকবার রক্ত দিতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ২০-৩০ বছর বয়সের বেশি এই রোগিদের আয়ু থাকে না।
পৃথিবীতে যত থ্যালাসেমিয়া রোগী আছে, তার মধ্যে দশ শতাংশই বাস করে ভারতবর্ষে। ভারতীয়দের মধ্যে প্রতি ৩০ জনের মধ্যে একজন থ্যালাসেমিয়া রোগের বাহক। আর স্বামী স্ত্রী দুজনেই যখন এই রোগের বাহক হন তখন সন্তানের থ্যালাসেমিয়া হওয়ার আশঙ্কা থাকে ২৫ শতাংশ। ঘাবড়াবেন না, বাকি ৭৫ শতাংশ বাচ্চা সুস্থই থাকে। কারা এই রোগের বাহক তা জানা যায় রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমেই। এই কারণেই বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষার কথা বলা হয়। তাই সামান্য একটু সচেতনতা দেখাতে পারলেই থ্যালাসেমিয়ার মতো মারণ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
সেই ছোট ছোট পাখিগুলো উড়ে বেড়াবে, খেলে বেড়াবে, স্বপ্ন দেখবে। ওরা রক্তের টানে বাসায় ফিরবে, রক্ত নেওয়ার টানে নয়।