অদ্য পুষ্যভূতি রাজবংশের নবীন নৃপতি রাজ্যবর্ধনের রাজ্যাভিষেক। সরস্বতী নদীতীরবর্তী সমগ্র স্থানীশ্বর নগরী অপূর্বরূপে সজ্জিত হইয়া স্বর্গের নন্দনকাননতুল্য দর্শনীয় হইয়াছে।
প্রতি গৃহস্থের কুটিরের প্রাঙ্গণে দীপাবলী, গৃহচূড়ে নানা বর্ণের কেতন উড়িতেছে, পথপার্শ্বের বিপণিগুলি আলোকোজ্জ্বল, রসিকা নাগরিকাদের গৃহে নৃত্যগীতাদি চারুকলার অনুপানে উদাত্ত পানভোজনের সমারোহ। চৌষট্টি কলায় পারদর্শিনী নগরনটীরা মহামূল্য আভরণে অনন্যরূপে সজ্জিতা হইয়া ঊর্বশীতুল্য ভঙ্গিমায় উপস্থিত গণ্যমান্য অতিথিদের মনোরঞ্জনে প্রবৃত্ত হইয়াছেন।
সরস্বতীবক্ষে অসংখ্য সুসজ্জিত নৌকা ভাসিতেছে। তাহাদের অভ্যন্তর হইতেও রমণীগণের সুমিষ্ট কলকাকলি এবং ক্বচিৎ তালবাদ্য সহকারে নূপুরনিক্বণের ঝঙ্কার ভাসিয়া আসিতেছে।
পান্থশালাগুলি দূর গ্রামের উৎসাহী কৌতূহলী পথিকে পরিপূর্ণ — সকলেই নূতন রাজার অভিষেক অনুষ্ঠান চাক্ষুষ করিবার ঈপ্সায় দূর দূরান্ত হইতে রাজধানী নগরীতে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে।
ব্যস্ত পান্থপাল পর্যাপ্ত তক্র-মদ্য-মাংসাদি সরবরাহ করিতে গলদঘর্ম হইয়া উঠিতেছে।
রাজ্যবর্ধনের পিতা প্রভাকরবর্ধনের শারীরিক অবস্থার কথঞ্চিৎ উন্নতি হইয়াছে।
কয়মাস পূর্বে তাঁহার কন্যা রাজ্যশ্রীর সহিত মৌখরীরাজ গ্রহবর্মার শুভ পরিণয় সম্পন্ন হইবার পর হইতেই প্রাক্তন মহারাজের স্বাস্থ্যের উন্নতি পরিলক্ষিত হইতেছিল। নিষ্প্রভ চক্ষের জ্যোতি অল্প মাত্রায় ফিরিয়া আসিয়াছিল, গণ্ডদেশের পাণ্ডুরতা খানিক বিলীন হইয়াছিল, শ্বাসকষ্টও পূর্বের ন্যায় ক্লেশকর অনুভূত হইতেছিল না।
ইহাতে রাজ্যবর্ধন আনন্দিত হইলেও রানী যশোমতী আশ্বস্ত হইতে পারেন নাই। বৈদ্যকুলের নিরাশ দৃষ্টি এবং আপন বয়সোচিত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে তিনি বুঝিয়াছিলেন, প্রদীপের তৈল নিঃশেষিত হইয়া আসিতেছে, একেবারে নির্বাপিত হইবার পূর্বে অসহায় শিখাটি জ্বলিয়া উঠিবার প্রাণান্ত চেষ্টা করিতেছে মাত্র।
ভগ্নহৃদয়ে তিনি যথাশীঘ্র সম্ভব রাজ্যবর্ধনের অভিষেকের প্রস্তুতি আরম্ভ করিয়াছিলেন।
আরোগ্যলাভ না করুন, প্রভাকরবর্ধন যেন শান্তিতে ইহলোক ত্যাগ করিতে পারেন, তার জন্য রানী বিশেষভাবে সচেষ্ট হইলেন।
প্রৌঢ় স্বামীর হস্তে তাঁহার ভ্রাতা অনন্যোপায় হইয়া তাঁহাকে সমর্পণ করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু মধুরস্বভাব, বিচক্ষণ, কোমলহৃদয়, ন্যায়পরায়ণ প্রভাকরবর্ধনকে যশোমতী বড় ভালবাসিতেন — তাঁহার সহিত আসন্ন বিচ্ছেদব্যথা তাঁহার অন্তরকে সর্বদা পরিপূর্ণ করিয়া রাখিত।
রাজ্যবর্ধনের অভিষেক উপলক্ষে রাজ্যশ্রী কান্যকুব্জ হইতে সস্বামী আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে।
তাহার মাতা সানন্দে লক্ষ্য করিলেন এই কয়মাসে সেই বেতসলতাতুল্য চতুর্দশী যেন পূর্ণশশীতে রূপান্তরিত হইয়াছে, অর্ধপ্রস্ফুটিত কুসুমকলিটি যেন দল মেলিয়া সম্পূর্ণরূপে বিকশিত হইয়াছে।
অঙ্গে বহুমূল্য দুকূলের রাজকীয়তায়, হীরা ও মুক্তাখচিত অলঙ্কারের দ্যুতিতে এবং সর্বোপরি তাহার আচরণে, প্রতিটি অঙ্গসঞ্চালনে এক দায়িত্বশীলা, স্বাভিমানিনী রাণীর মর্যাদা যেন ঠিকরাইয়া পড়িতেছে — অবলোকন করিয়া রাজ্যশ্রীর মাতার চক্ষু জুড়াইয়া গেল। একটি প্রশ্নও না করিয়া তিনি বুঝিয়া লইলেন, তাঁহার কন্যা কেবল রাজরাজেশ্বরীই হয় নাই, তাহার পরমভট্টারক স্বামীর হৃদয়েশ্বরীও হইয়া উঠিয়াছে।
নূতন রাজার অভিষেক উদযাপনে রাজপ্রাসাদেও আনন্দযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হইতেছিল। সেনানায়ক, মন্ত্রীবর্গ, দণ্ডাধিনায়ক সহ রাজপুরুষেরা তো বটেই, নগরীর অন্যান্য বিশিষ্টজনেরও সপরিবার সাদর আমন্ত্রণ ছিল।
তাঁহাদের মধ্যে অগ্রগণ্য শ্রেষ্ঠী ক্ষেমদত্ত ও তাঁহার কন্যা শকুন্তলা বিশেষভাবে নিমন্ত্রিত ছিলেন।
শ্রেষ্ঠীকন্যা শকুন্তলা অপূর্ব সুন্দরী। যে সৌন্দর্যের দিকে চাহিলে মন স্নিগ্ধ হয়, প্রসন্ন হয়, সেইরূপ সৌন্দর্য নহে — শকুন্তলার রূপ দর্শকের চক্ষু ঝলসাইয়া দেয়, তাহাকে অন্ধ করিয়া দেয়, জগতের অন্য কিছু অবলোকন করিবার শক্তি হরণ করিয়া লয়। তাহার রজতকান্তি বর্ণ, চম্পাকলির ন্যায় অঙ্গুলি, বর্ষাসিঞ্চিত মেঘের ন্যায় কেশরাশি, মৃণালতুল্য বাহুদ্বয়, স্বর্ণলতিকার ন্যায় নমনীয় কটিদেশ, বিদ্যুৎলতার তুল্য বঙ্কিম ভ্রূযুগল, পদ্মকোরকের ন্যায় ফুল্ল ওষ্ঠাধর এবং সর্বোপরি তাহার মৃগনয়নের কটাক্ষ — দৃষ্টিপাত মাত্র দর্শকের চিত্তচকোর সেই অনির্বচনীয় রূপসুধা বারম্বার পান করিবার দুর্নিবার অভিলাষে আকুল হইয়া উঠে।
শকুন্তলার মনে কিন্তু সুখ নাই। সে ভালবাসিয়াছে। সমস্ত জগৎ যাহার রূপের পদতলে লুটাইবার জন্য উন্মুখ হইয়া আছে, সেই নারী এক সাধারণ সৈনিকের প্রেমাসক্ত হইয়াছে। রাজার অশ্বারোহী বাহিনীর এক সামান্য সৈনিক চন্দ্রবর্মাকে শকুন্তলা আপন মনপ্রাণ সমর্পণ করিয়াছে।
চন্দ্রবর্মা পিতৃমাতৃহীন যুবক, তবে অজ্ঞাতকুলশীল নহে। তাহার প্রয়াত পিতা বেত্রবর্মা বহু বৎসর যাবত স্থানীশ্বরের নগরপাল ছিলেন। তাঁহার অল্প কিছু সঞ্চিত ধনসম্পত্তি ছিল, যাহা তাঁহার অবর্তমানে তাঁহার একমাত্র পুত্রে অর্শাইয়াছিল। ধনাঢ্য শ্রেষ্ঠীর রূপসী কন্যার পক্ষে চন্দ্রবর্মা খুব স্বাভাবিক নির্বাচন ছিল না, তাই ক্ষেমদত্ত কন্যার এই হঠকারিতায় উদ্বেলিত হইতে পারেন নাই। তবে গোলযোগ অন্যত্রও বাঁধিয়াছিল।
এক মেঘমেদুর প্রত্যুষে, কার্যোপলক্ষে কোনও রাজপুরুষের গৃহ হইতে প্রত্যাগমনকালে, যুবরাজ রাজ্যবর্ধন সরস্বতী নদীতে সখীসমভিব্যাহারে জলকেলিরত শকুন্তলাকে অবলোকন করিয়াছিলেন। আকাশ তখন জলদধূম্রজালে ছাইয়াছে — তন্মধ্যে বিদ্যুল্লেখার তীব্র আলোকপাতে, গুরু গুরু শব্দে মুহূর্মুহূ অশনিসম্পাতের পটভূমিতে প্রকৃতি যখন নটরাজ নৃত্যে মাতিয়া উঠিবার উপযোগ করিতেছে, সেই মহালগ্নে নদীতীরবর্তী রাজপথে অশ্বারূঢ় রাজ্যবর্ধন শকুন্তলাকে দেখিলেন।
তাঁহার চক্ষে জগৎ অস্পষ্ট হইয়া গেল, সকল শব্দ থামিয়া গেল, সরস্বতী নদী, তার তটসংলগ্ন সমস্ত দৃশ্য মুছিয়া গেল, কেবল একটি যৌবনোচ্ছল অনিন্দ্য নারীমূর্তি তার অপার্থিব সৌন্দর্য লইয়া জাগরূক হইয়া রহিল।
রাজ্যবর্ধন হৃদয় হারাইলেন।
শকুন্তলা নির্বোধ নারী নহে। বিশেষত, পুরুষের মুগ্ধ দৃষ্টিপাতে নিরন্তর স্নাত হইতে সে একান্তই অভ্যস্ত। রাজ্যবর্ধনকে সে অবশ্য চিনিতে পারিল এবং তাঁহার দৃষ্টির অনাবৃত মুগ্ধতা পাঠ করিতে তাহার তিলেক বিলম্ব হইল না।
কিন্তু চন্দ্রবর্মার প্রতি তাহার হৃদয় এমন নিবিড় ও একনিষ্ঠভাবে আকৃষ্ট ছিল, যে যুবরাজের দৃষ্টিপ্রসাদে অভিষিক্ত হইয়াও তাহার অন্তর বিন্দুমাত্র আন্দোলিত হইল না। উপরন্তু মনে ভয় ধরিল যে এ এক নূতন আপদ উপস্থিত হইল। সে নিশ্চিতরূপে উপলব্ধি করিল, অন্যান্য রূপমুগ্ধ চাতকের ন্যায় ইঁহাকে অনায়াসে, তুচ্ছজ্ঞানে বর্জন করা সম্ভব হইবে না।
নিতান্ত অনিচ্ছায় সে পিতার অনুগামিনী হইয়া রাজ অট্টালিকায় নিমন্ত্রণ রক্ষা করিতে আসিয়াছিল। তাহার কণ্ঠে রত্নহার, মণিবন্ধে সুবর্ণচূড়, কটিতে মুক্তাখচিত নীবিবন্ধ, কর্ণে মাণিক্যের কুণ্ডল, পরিধানে সূক্ষ্ম চীনাংশুক — দাসীপরিবৃতা হইয়া সে যখন রাজপুরীর অন্দরমহলে প্রবেশপূর্বক অন্যান্য আমন্ত্রিত বিশিষ্ট রমণীদিগের সহিত শিষ্ট বার্তা বিনিময় করিতেছিল, রাণী যশোমতীর দৃষ্টি তাহার প্রতি আকৃষ্ট হইল। সমবেত অতিথিবৃন্দের প্রায় প্রত্যেকেই তাঁহার পরিচিত — কেহ মন্ত্রীপত্নী, কেহ অমাত্যকন্যা, কেহ বা রাজবয়স্যের জননী অথবা ভগিনী। অন্যান্য রাজকুলোদ্ভবা রমণীদিগের উপবেশনের জন্য সভামধ্যে ভিন্ন স্থান নির্দিষ্ট রহিয়াছে। নিমন্ত্রিতমধ্যে এই অপরিচিতা সুরসুন্দরীকে দেখিয়া যশোমতী কিছু আশ্চর্য হইলেন। পার্শ্বস্থ অনুচরী দাসীকে ইঙ্গিতে এই বরবর্ণিনীর পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলে, সে হ্রস্বস্বরে যশোমতীকে জানাইল — এই নারী নগরীর অন্যতম ধনী শ্রেষ্ঠী ক্ষেমদত্তের একমাত্র কন্যা শকুন্তলা। পরিচয় জানিয়া রাণী নির্বাক হইয়া গেলেন।
রাজ্যবর্ধনের অভিষেকের পূর্বে তাহার বিবাহের চিন্তা যশোমতীকে কিঞ্চিৎ বিচলিত করিয়াছিল। কারণ, প্রতিবেশী নৃপতিকুলের মধ্যে মৈত্রীবন্ধনের উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক বিবাহই প্রচলিত। সেই কারণে পুষ্যভূতি সম্রাজ্ঞীর মনোবাঞ্ছা ছিল যে, দাক্ষিণাত্যের কলচুরীবংশের কোনও অনূঢ়া কন্যাকে বধূ হিসাবে গ্রহণ করিলে চিরশত্রু চালুক্যরাজের চিরন্তন বৈরিতা আর উত্তরপ্রান্তের অশান্ত হূণদিগের উপর্যুপরি আক্রমণের দ্বৈত সমস্যা হইতে মুক্তিলাভের একটি উপায় করা সম্ভবপর হয়।
উপযুক্ত রাজবংশের সহিত মৈত্রীবন্ধন সময়ের দাবি — একদিন এমত অভিলাষ তিনি পুত্রের নিকট আকারে ইঙ্গিতে ব্যক্ত করিলেন। উত্তরে রাজ্যবর্ধন তাঁহার মাতার সমীপে শ্রেষ্ঠীকন্যা শকুন্তলার সহিত তাঁহার অকস্মাৎ সাক্ষাতের অকপট বর্ণনা করিয়াছিলেন।
প্রভাকরবর্ধনের পত্নী তাঁহার প্রত্যেক সন্তানের অন্তরের সহিত আপন কররেখার তুল্য পরিচিত ছিলেন। নিমেষের মধ্যে তিনি বুঝিয়া লইয়াছিলেন, শকুন্তলা নাম্নী এক অনন্যসুন্দর নারী তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্রের হৃদয়হরণ করিয়াছে।
এক্ষণে তাহাকে সম্মুখে দেখিয়া ভাবিলেন, এই-ই তাহলে সেই শ্রেষ্ঠীকন্যা, যে একটি বিলোল কটাক্ষে তাঁহার দৃঢ়চরিত্র, গম্ভীরচিত্ত পুত্রটির হৃদয় এক লহমায় হরণ করিয়া লইয়াছে!
এই সেই শকুন্তলা!
দেবী যশোমতী আহ্লাদিতা হইতে পারিলেন না। তাঁহার কেবলই মনে হইতে লাগিল, এই মোহিনী নারীর দর্পিত রূপের মধ্যে কোথাও এক অসীম অশুভ শক্তি নিহিত রহিয়াছে। ইহার দ্বারা কাহারও মঙ্গল সাধিত হইতে পারে না। এই নারী মূর্তিমান অশিব — ইহাকে তাঁহার পরিবারমধ্যে স্থান দিলে তাঁহার বংশের আরাধ্য দেবতা রুষ্ট হইয়া চিরতরে মুখ ফিরাইয়া লইবেন।
প্রবল বিতৃষ্ণায় রানী যশোমতীর ওষ্ঠাধর বাঁকিয়া গেল।
(ক্রমশ)