যেহেতু নতুন বোতলে পুরনো মদ, তাই আমিও ফের একটা প্রাগৈতিহাসিক গল্প দিয়ে শুরু করি এই লেখা।
সে বার বিক্রমাদিত্যের রাজসভায় প্রশ্ন উঠেছে – ডাক্তার বেশি না রোগী বেশি! স্বভাবতই সব ভোট রোগীর দিকে! কিন্ত কালিদাস, দাদার বাপি বাড়ি যা র মতো সপাটে মারলো ছয়! বললো – ডাক্তার বেশি!
যেই না বলা, অমনি কালিদাস সমবেত বাকি সবার কাছে নির্বোধ বলে প্রমাণিত এবং পুরোপুরি মিডল স্ট্যাম্পে বোল্ড!
রাজা বিক্রমাদিত্য এমন উত্তরে রেগেমেগে বললেন- কালিদাস, ইউ গেট আউট!
কালিদাস, বেচারা প্যাড খুলে রেখে প্যাভিলিয়নে তথা গৃহে বন্দী হয়ে গেল! কালিদাসহীন রাজসভায় রইলো পড়ে বাকি সব- খালি দাস!
এদিকে গণ্ডগোল বাঁধলো কয়েকদিন পর।
প্রিয় কালিদাস রাজসভায় নেই, বিক্রমাদিত্যের মুখে এ খবর শোনামাত্রই গৃহমন্ত্রী হুকুম জারি করলেন, যে করেই হোক কালিদাসকে রাজসভায় ফিরিয়ে আনতে হবে!
এ যেন সেই একজন ব্যাটসম্যান আউট হবার পর দর্শকদের চাপে আম্পায়ারের আউট বাতিলের গল্প!
রাজা হোক গজা হোক, গৃহমন্ত্রীর কাছে সবদিন নিরূপায়! পেয়াদা গেল কালিদাস কে আনতে।
কালির দাস যে, তাঁর মাথা তো আর খালি হয় না!
অতএব, সেও একখান জবরদস্ত বল পেয়ে অফসাইডে কভার ড্রাইভ মেরে দিল- যেতে পারছি না, পেটে ব্যথা!! সময় হলে কাল যাবো!
সেদিন কালিদাস এলো না।
পরদিন সবাইকে বিলো দ্যা বেল্ট মারার উদ্দেশ্য নিয়ে তলপেটে দুই হাত চেপে ধরে কালিদাস রাজসভায় হাজির হলো।
সবাই শশব্যস্ত হয়ে পড়লো। কি হলো? কি হলো?
কালিদাস মুখ গম্ভীর করে বললো- পেটে ব্যথা।
তারপর যা হয়, সবাই এক এক করে এটা ওটা দাওয়াই বলে যেতে লাগলো। কালিদাস তলপেটে হাত রেখেই গুনতে লাগলো – এক, দুই, তিন…!
সবার বলা শেষ হলে রাজাকে বললো- মহারাজ! এই সভায় আমি এই মুহূর্তে প্রমাণ করে দিলাম যে, আমি একলা রোগীর চেয়ে ডাক্তারের সংখ্যা বেশি!!
তারপর কি হয়েছিল, দরকার নেই বলে জানিও না।
যে গল্প বলতে এই গল্পের অবতারণা, এবার সেটিতে আসি।
একজন কমেন্ট করেছেন- দাদির (সৌরভ গাঙ্গুলির) অম্বল হয়েছে, হালকা বুকে ব্যথা!
অতএব, “মাইল্ড কার্ডিয়াক অ্যাটাক” (এটি কি ধরনের টার্ম সেটি ও অবশ্য ডাক্তার হিসেবে আমার জানার সুযোগ হয়নি! Acute myocardial infarction পড়ে আসা আমাদের জানার কথাও নয়!) বলে প্যানিক করছে অন্য কেউ।
ব্যাপারটা যেন এমনই, অম্বল হয়েছে তো কি, কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড় না।
যদিও এক্ষেত্রে সৌরভ গাঙ্গুলি কম্বল টেনে শুয়ে পড়েননি। যদ্দুর জানি, গোল্ডেন আওয়ারেই আসল বদ্যির শরণ নিয়েছেন! এবং শেষ অব্দি, স্টেন্ট বসিয়ে এখন ভালো আছেন।
দাদাকে যাঁরা কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকতে বলেছিলেন, তেমন একজনের বক্তব্য সঙ্গে দিলাম।অবশ্য সেটা না করলেও, তাঁর মতো ভিভিআইপির চিকিৎসা যে টপ লেভেলেই হতো, বলাই বাহুল্য।
অত সহজে আমরা ভিভিআইপিদের মরতে দিই না। আর দাদাকে নিয়ে তো কোন কথাই নেই!বাঙালির জান কবুল।
যাইহোক, দাদার কথা ছেড়ে এবার আসি হাঁদার কথায়!
এই হাঁদা কে বা কারা? না, তাঁরা কিন্ত কেউই দাদার মতো শিক্ষিত স্পোর্টস ম্যান ভিভিআইপি নয়। তাঁরা আপনার আমার মতো হরিদাস পাল।চিরকালের বঞ্চিত ** ।
অথচ, কি অবাক কাণ্ড! দাদার জন্য যখন দেশের সেরা কয়েকজন মাত্তর চিকিৎসক, দেবী শেট্টিকে অব্দি উড়ে আসতে হচ্ছে, আমাদের জন্য কিন্ত মোটেই তা নয়!!
হঠাৎ করে অদ্ভুত শুনতে লাগলেও,আমাদের মতো হরিদাস পালদের জন্য
চিকিৎসকের কিন্ত কোন অভাব নেই !!!
এটা শুনেই পাছা তুলে আমাকে খিস্তি মারার আগে ভালো করে ভেবে দেখুন , এই রকম এট্টুসখানি গ্যাসের অবৈধপথে প্রবাহ বা অম্বলের জন্য সামান্য ব্যাথায় তেঁতো মুখ হলেই ,
গ্যাস অম্বলের অগুণতি ডাক্তার ডাক্তারি জ্ঞানের সিলিন্ডার নিয়ে আশেপাশে গিজগিজ করে আমাদের !!
বাকি সব অসুখে তো পঙ্গপালের মতো করে ডাক্তার আসে !!
রাস্তাঘাটে বাজারে স্কুল কলেজে শপিং মলে – সব ডাক্তার !!
ভালো করে ভেবে দেখুন , তখন অগা বগা জগা , রাম শ্যাম যদু মধু , সকল সহমর্মী ই এক একজন ডাক্তার হয়ে ওঠেন ।
আপনি ভাবছেন, এতে আবার নতুন কি আছে !
আপনি ভাবছেন, এতে আবার খারাপ কি আছে !
আপনি ভাবছেন, এতো রোগীর ভালোর জন্যই !
আপনি ভাবছেন , আমি ডাক্তার বলেই এইসব ডাক্তার দেখে আমার একটুখানি ব্যাথা লাগছে প্রাকটিস কমার ভয়ে !!
হ কত্তা । থামেন এইবার ।
ব্যাথা এট্টুসখানি লাগছে, এটা সত্যি ।
তবে প্রাকটিস কমার ভয়ে নয় !
আশ্বস্ত থাকুন এটা জেনে যে ,
ওটি সামলানোর মতো যথেষ্ট সময়, অন্যান্য আধুনিক চিকিৎসকদের মতোই আমার হাতে আর নেই এখন !
এ ব্যাথা কি যে ব্যাথা , এ ব্যাথা যে কোথায় লাগছে প্রতিদিন , সে সব সবিস্তারে একটু বলি । ধৈর্য ধরে শুনুন থুড়ি পড়ুন !
এই যে আপনি টুক করে ‘বেশি ডাক্তারদের’ মধ্যে অমুকের কথায় অমুক ওষুধ পথ্য ইত্যাদি ইত্যাদি ট্রাই করলেন , তমুক ডাক্তারের কাছে ছুটলেন , তমুক ডাক্তারের ওষুধ সময় নিয়ে অসুখের গোড়া উপড়ে দেবে ভাবলেন , সাইড এফেক্ট নেই বলে এফেক্ট ও পেলেন না ,
সামান্য গ্যাসের ব্যাথা বলে হার্ট অ্যাটাক মিস করে গেলেন ,
আরো কতকিছু মিস করে গেলেন , তার কয়েকটি জলজ্যান্ত উদাহরণ হাজির করি।
( রোগীর নাম ধাম প্রকাশ করা যায় না , লিগ্যাল কারণেই , অতএব এড়িয়ে গেলাম !)
ভদ্রমহিলা সাড়ে সাত বছর ধরে পিত্তথলিতে একগাদা পাথর নিয়ে ঘুরছেন । জলপড়া তেলপড়া তাবিজ কবচ মাদুলি আদার রস লেবুর জল – কিছুই বাদ দেননি ।
শেষ তিন বছর ভরসা ছিল চিনির দানা আর রেগুলার ইন্টাভ্যালে ইউএসজি করানো ।
জানি না কোন ওষুধের সুফল – শেষবার গতসপ্তাহে যখন এলেন , পিত্তথলিতে পচন ধরেছে , পাথর থলির ভেতর থেকে বেরিয়ে পেটে !
ভেতর থেকে চিকিৎসা !!
ঠিক এমনি আরেকজন – শেষ অব্দি পিত্তথলিতে ক্যান্সার যখন বলে দিলাম , পাথরের সাইজ দেখে দেখে দেড় বছর শুধু জলের ফোঁটা দিয়ে চিকিৎসা করা ডাক্তার বগল ফাঁকা করে হাত উপরে তুললেন। কে যেন রোগীকে ও ক’দিন পরে উপরে তুলে নিল !
এরপর আসুন কিডনির গল্পে । আমার মতো অখ্যাত ডাক্তারের কাছে ও কাজের দিনে জনা তিরিশেক রোগী আসেন শুধু পাথরের সাইজ মাপাতে !!
তাঁরা সবাই বছরের পর বছর ওষুধ খেতে থাকেন আর ইউএসজি করাতে থাকেন ।
কি কেলেঙ্কারি কাণ্ড !
সবার দেখি – হয় পাথরের সাইজ বেড়েই চলে না হয় পাথর নিচের দিকে নেমে কোথাও আটকে যায় !!
মাইরি বলছি , পাথর কে এভাড়ে ভেতর থেকে নাড়িয়ে চলনশীল করে তোলা আধুনিক চিকিৎসকের দ্বারা সম্ভব নয় !!
শেষ অব্দি আধুনিক চিকিৎসকের দেয়া ওষুধ ও অপারেশন ছাড়া কিছুতেই পাথর দূর হয় না!!
আসুন আরেকজনের কথায়। ভদ্রমহিলা শিক্ষিকা ।
দেড় বছর আগে যখন বুকে একটু শক্ত শক্ত ভাব অনুভব করলেন , গোপনে গোপনে অনেককে বললেন। জলপড়া তেলপড়া মালিশ চললো । তারপর একজন বললেন – ওই ডাক্তারের ওষুধ ভেতর থেকে সারিয়ে তোলে !
ব্যস ! আর যায় কোথায়।
গত সপ্তাহে ডায়াগনসিস করলাম – ব্রেস্ট ক্যান্সার ভেতরে বুকের ওয়ালে তো ঢুকেছেই , ভেতর থেকে সারিয়ে (!) উপরের চামড়া অব্দি ধরে নিয়েছে। ছড়িয়েছে শরীরের অন্য জায়গাতেও !
আসুন আরেকজনের কথায়। হারিস বা অর্শ ভেবে বিনা পরীক্ষা নিরীক্ষা র ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন এই রোগী । রক্তপাত বন্ধ হয় না কিছুতেই।
শেষে পায়খানা বন্ধ , শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যাথা , পেটে মারাত্মক ব্যাথা ।
যাকগে ! রেকটাল ক্যান্সার ডায়াগনসিস করার পর সাত দিন বেঁচে ছিলেন।
অম্বল হয়েছে বলে কম্বল চাপা দেয়া ডাক্তারের তো অভাব নেই ।
এরকমই দু’জন রোগী এসেছিলেন কয়েকদিন আগে। বহু ঘাটের জল খেয়ে।
একজনের পাকস্থলীর ক্যান্সার নিয়ে এখন টাটা ক্যান্সার সেন্টারে (ফিরলে হয়তো অধমের সঙ্গে দেখাও হবে !) , আরেকজনের আয়ু ছিল দেড় ঘন্টা । মেডিকেল কলেজে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি । দাদার মতোই হার্ট অ্যাটাক !! তবে রিপিটেড !
আর দেখা হয়নি!
একজনের হচ্ছিল খিঁচুনি । সাথে জ্বর । নানান মুনির নানান মত। এটা ওটা ভর করেছে , পেটের গ্যাস উপরে উঠছে ( কি কি ফুটো করে যে গ্যাস উপরে ওঠে , জানি না!) ইত্যাদি র নিদান সহ ডাক্তার জুটে গেল ।
কার বুদ্ধিতে , কেন যে আমার কপালে এসে পড়েছিল জানি না। সিটি স্ক্যান দেখে বললাম , এটা এক ধরনের এনকেফালাইটিস । ইমিডিয়েট চিকিৎসা চাই। না হলে বাঁচানো কঠিন হবে।
সবার বুকে বড্ড ব্যাথা দিয়ে , সে রোগী চিনির দানা আর মদের জল খেয়ে পটল তুলেছেন পরের দিন।
হাজার হাজার গল্পের থেকে আরেকখানা বলে শেষ করবো।
রোগী স্কুল শিক্ষক। বেশ কিছুদিন ধরেই পায়খানার সমস্যা ছিল ।
সাথে বমি , মাঝে মাঝেই পেটে ব্যাথা । প্রথমে যথারীতি গ্যাস আর অম্বল ভাবা । অতঃপর এর ওর কাছে শুনে গেলেন
জনৈক ডাক্তার এর কাছে। বললেন , অগ্ন্যাশয় নোংরা হয়েছে । পরিষ্কার করতে হবে। অতএব, চিনির দানা ই ভরসা !
শেষমেশ , যখন এক পরিচিত দাদা তাঁর অত্যান্ত প্রিয় স্যারকে ইউএসজি করানোর অছিলায় আমার কাছে ধরে আনলেন ,
আমার মতো নিতান্তই তুচ্ছ ডাক্তারের তেমন কিছু করার ছিল না।
দাঁতে দাঁত চেপে দাদার মতো, ঠিক বাপি বাড়ি যা স্টাইলে মারলাম ছক্কা !!
বললাম – একটা নয় , দুই ধরনের ক্যান্সার একই শরীরে !
আর রোগীর আয়ু নিয়ে কিছু বলা উচিত নয়।
এহেন কথা শুনে ‘রোগীর চেয়ে ডাক্তার বেশি’ সমাজে ছিঃ ছিঃ পড়ে গেল । আমার মাথা মায়ের ভোগে মানত করে, শিক্ষকের স্ত্রী খানিক ভয় পেয়েই বোধহয় গেলেন টাটা মুম্বাইয়ে ।
পঁচিশ দিনের মাথায় , দু’খানা ক্যান্সার নিয়ে মারা যাওয়া শিক্ষক আমার মাথাটা এ যাত্রায় বাঁচিয়ে দিয়ে গেলেন !!!
এ যাবৎ বলে , একটাই কথা বলবো । এই ব্যক্তি না হয় দাদার প্রতি অন্ধ , কিন্ত এর মতো অন্ধ মানুষ আমাদের সমাজে , আশেপাশে অভাব নেই !!
বলি কি , এরকম ডাক্তার সাজাটা বন্ধ রাখুন।
সময় থাকতে আধুনিক চিকিৎসকের পরামর্শ নিন । অন্যকে ও উৎসাহ দিন । দেখবেন – তুলনামূলক কম খরচে জেনে যাবেন কি কি অসুখ আছে , বেঁচে যাবেন হঠাৎ করে এরকম অম্বলের অ্যাটাক বলে চালানো হার্ট অ্যাটাকের হাত থেকে । অথবা আরো অনেক ধরনের অসুখ থেকে। অকাল মৃত্যু থেকে !
শুধু একটা অসুখ নয় , কোন রকম শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে রেডিমেড ডাক্তারের পরামর্শ এড়িয়ে চলুন।
সে যদি নিজের একান্ত আপনজন ও হয় , ডাক্তার না হলে তাঁর পরামর্শ নেয়া বন্ধ করুন !!
আর হ্যাঁ , সাথে এড়িয়ে চলুন সেইসব ডাক্তারদের , যাঁরা বাইরে থেকে বা ভেতর থেকে কোন কিছু ছাড়াই রোগ সারিয়ে তোলে !!!
বিজ্ঞানের সাফল্য যেমন সব মানুষের জন্য , তেমনি অবিজ্ঞান অপবিজ্ঞান এর পাপের দায় কিন্ত আপনার আমার ও !!!
একজন প্রিয়জন হারানোর ব্যাথা আপনাদের হয়তো গায়ে লাগে না , কিন্ত কি জানেন , চোর ডাকাত বলে যাদের উঠতে বসতে গালি দেন , শেষ অব্দি তাঁদের কাছেই পৌঁছে যান ,
সেই আধুনিক চিকিৎসকদের বেশ খানিকটা ব্যাথা লাগে এসবে !!
হ্যাঁ , এই আজকের দিনে ও !!
এ ব্যাথা কি যে ব্যাথা …..