টিভি দেখার সুযোগ পাই না। পেলে অনেক কিছু জানা যায়, তা গতকাল আবার বুঝলাম। যেমন ধরুন, নারায়ণ গোস্বামী নামে কোনো একটি নেতা আছেন, সেটাই জানতাম না। তাঁকে প্রথমবার পর্দায় দেখে এবং বক্তব্য শুনে নিশ্চিত হতে পারলাম যে তিনি একজন জেনুইন নেতা, কারণ “রাজনৈতিক নেতা মাত্রেই ঢপবাজ,” এই প্রচলিত ধারণাটির সঙ্গে তিনি মিনিটখানেকের মধ্যে খাপে খাপ হয়ে গেলেন। যেটুকু বক্তব্য শোনা গেল তা প্ল্যাংক এবং আইনস্টাইনের ফোটন সংক্রান্ত আদি কোয়ান্টাম থিওরির মতো… Emitted in lies, travels in lies, absorbed in lies. এই শেষের “absorbed in lies” অংশটা বিপজ্জনক এবং এটাই এই মুহূর্তের মূলধারার রাজনীতির সারাৎসার। সরল মানুষের মনে মিথ্যে গেঁথে দেওয়াই আজকের রাজনীতি। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য এবং আমাদের ব্যর্থতার ফল। এই সংস্কৃতি আটকানোর জন্য কিছু করিনি আমরা।
টিভি খুললে জানা যায় যে প্রাক-নির্বাচনী বক্তৃতায় অভয়াকাণ্ডের বিচারের দাবিতে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন নিয়ে গুল মারতে বাধ্য হচ্ছেন শাসক-দলের নেতা-মন্ত্রীরা। যাঁদের মনে সন্দেহ আছে, আন্দোলন করে লাভ কী হয় (প্রিয় অভিনেতা অনির্বাণ সহ), তাঁরা এটুকু দেখলে বুঝবেন, আন্দোলন শাসককে যথেষ্ট বিব্রত করতে সক্ষম। অতএব সপ্তাহে অন্তত একদিন মিনিট কুড়ি টিভিতে খবরের চ্যানেল দেখুন।
কিন্তু কিন্তু কিন্তু… একটু সাবধানে দেখবেন। ছবির তলায় স্ক্রলে একটা লাইন কেন্নোর মতো বেয়ে যাচ্ছে দেখতে পেলে তার আগামাথা না বুঝে নেচে উঠবেন না। দিন তিন-চার আগে ওরকম কিছু একটা দেখে এক পরিচিত বামপন্থী ভালোমানুষ আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে লিখে পাঠিয়েছিলেন, “আমেরিকায় লাল ঝড়।” ওদেশে ডেমোক্র্যাটরা নীল (চিঙড়ি) এবং রিপাব্লিকানরা লাল (আরশোলা), এটা সম্ভবত তিনি জানতেন না। এদিকে তিনি যে জানেন না, সেটা আমি জানতাম না। ঘাবড়ে গিয়ে খবর খুঁজে বুঝলাম, বিজয়ীর নাম সম্ভবত দুলাল ট্রাম্প। ওটাকেই তিনি দু’বার লাল ধরে নিয়েছেন মন দিয়ে পুরো খবর না দেখার ফলে। ওসব নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করিনি, কারণ চিংড়ি আর তেলাপোকার মধ্যে যেই জিতুক, বাকি পৃথিবীর জন্য আমেরিকা আমেরিকাই থাকবে। তারা কোনো দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া মানে সেই দেশ শেষ। অবশ্য তালিবান প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে তাদের পারদর্শিতা অনস্বীকার্য। আমাদের খুব একটা কিছু যায় আসে না, তবে বাঙলাদেশ বেশ উৎসাহী দেখলাম। আওয়ামী লিগ উল্লসিত এবং “মহান বিপ্লবী” জামাতিরা দুঃখিত দেখলাম। উভয় শিবিরের প্রতিক্রিয়া প্রমাণ করে, বাঙলাদেশের কপাল মন্দ। এবার শরিয়ত বনাম গণতন্ত্রের খেলায় আরও কত প্রাণ যাবে, আর কতজনের ভিটেমাটি চাঁটি হবে, সেটা চুপচাপ দেখা ছাড়া কিছুই করার নেই।
দুটো বিকৃত বিকল্পের মধ্যে একটা বেছে নেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার না থাকলে কী হয় তা খানিকটা আমেরিকাকে দেখে এবং আরও ভালো করে বাঙলাদেশকে দেখে বোঝা যায়। কিন্তু এসব নিয়ে টিপ্পনী করার যোগ্যতা আমাদের নেই। আমাদের দেশের এবং রাজ্যের অবস্থা তার চেয়ে ভালো কিছু নয়। লোকসভা নির্বাচনে আরব্য রজনীর “ডাকাত সর্দার বনাম ছাব্বিশ চোর” গল্পটার নাট্যরূপ আমরা দেখেছি। ২০২১-এর মতো ২০২৬-এও হয়ত অন্য নামে সেরকমই একটা নাটক আমরা দেখতে বাধ্য হব৷ হয় তৃণমূলের অত্যচারে অতিষ্ঠ হয়ে বিজেপি, নয়ত ‘ফ্যাসিস্ট বিজেপি’-র জুজুর ভয়ে আবার তৃণমূল, যেহেতু বিকল্প নেই…. আমাদের প্রসেনিয়ামের মালিক আপাতত এটুকুর মধ্যে আমাদের অ্যাক্টিং জোন সীমাবদ্ধ করে দিয়েছে। বিকল্প কি আছে? বিকল্প কি হতে পারে? আগে থেকে মুখচেনা বিকল্পদের গ্রহণযোগ্যতা খুব ভালো নয় এবং আত্মসমীক্ষা বিষয়ে তাঁদের আপত্তি এখনো কাটেনি। নতুন বিকল্প তৈরি করার চেষ্টা অবশ্যই হবে, আমার ধারণা। কিছু ক্ষমতাধর সংবাদমাধ্যমের পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান দেখে বোঝা যাচ্ছে, পছন্দসই বিকল্প স্পন্সর করার কাজ শুরু হয়ে গেছে। (আবারও টিভি দেখার গুরুত্ব সংক্রান্ত রচনায় ফিরে যেতে হয়।) অভয়াকাণ্ডের প্রতিবাদে আন্দোলনের মুহূর্তে জায়মান সেই বিকল্পে যোগ দিতে কিছু খ্যাতনামা মলেস্টার অ্যাকাডেমিশিয়ান পা বাড়িয়ে আছেন, তাও জানি। (না, এটা টিভিতে দেখায়নি। টিভি কম দেখি কারণ দেখানোর আগেই অনেককিছু জানতে পারি, ওদের মতো একই ‘সূত্র’ থেকে।)
যাইহোক, বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি না বদলাতে পারলে যেকোনো বিকল্পে বেনোজল ঢুকবেই, তা আমরা জানি। বিকল্পটা একদম গোড়া থেকেই বিশুদ্ধ বেনোজল সম্বল করে গড়ে না ওঠে, সেটুকু নিশ্চিত করার চেষ্টা করলে মন্দ হয় না। সীমান্তের পশ্চিমপারে আরেকটা বাঙলাদেশ আমরা চাই না, আরেকটা নতুন তৃণমূলও নয়।
রাজনীতি খুব কম বুঝি, তাই এসব নিয়ে বেশি কথা বলা আমার উচিত নয়। তবু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি র্যাডিকাল কথা বলা মানুষ, কম কাজ করে অনেক বেশি কৃতিত্ব দাবি করা মানুষ, সবাইকে উস্কে দিয়ে চট করে শাসকের সঙ্গে সমঝোতায় যেতে চাওয়া মানুষ, গুরুত্বপূর্ণ কিছুই আদায় করার আগেই “সব দাবি পূরণ হয়ে গেছে, কেমন দিলুম” বলা মানুষ, কারো সঙ্গে আলোচনা না করেই সমবেত সিদ্ধান্তকে জনসমক্ষে সমালোচনা করা মানুষ, হঠাৎ কোনো এক অজানা ‘মহান’ উদ্দেশ্য অদ্ভুত কিছু কাজ করে নিজের লড়াইয়ের সঙ্গীদের হঠাৎ অকারণে বদনাম করা মানুষ…. এরা সাধারণত বিশ্বাসযোগ্য হয় না। আমার মতো বেকুব যাঁরা আছেন, তাঁরা এদের থেকে সাবধান থাকবেন৷ পাশাপাশি রাজনৈতিক বিকল্প শুধু নয়, বিকল্প রাজনীতির সন্ধান জারি রাখুন।