আমি এক জায়গায় পড়তে যেতাম ক্লাস নাইনে। একটি মেয়ে আসত। সুন্দরী ছিল। এবং একদম পড়া পারত না। খুব মাথামোটা।
তার স্কুলের অন্য কয়েকজন মেয়েও পড়তে আসত৷ তারা ওকে নিয়ে হাসাহাসি করত। বলত, ‘ও তো কাউকে না বলতে পারে না। বোকাসোকা তো৷’ আমি ভাবতাম, অনেক ছেলে ওকে প্রোপোজ করে, বেচারা বোকাসোকা মানুষ হয়ত ‘না’ বলতে পারে না।
তারপর একদিন শুনলাম, ওই না বলতে না পারার অন্য মানে আছে। যখন কেউ ওর শরীরে হাত দেয়, ও বেচারা না বলতে পারে না৷ আরও শুনলাম, অনেকে চেষ্টা করলেও, মূলত একজন পুরুষকেই বোঝানো হচ্ছিল, যে প্রায়শ ওর গায়ে হাত দেয়। সে ওর বাবার বন্ধু। ওকে অঙ্ক করাতে আসে। বন্ধুরা জানে। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার, বাবা-মা জানে না। তের বছরের আমি তের-চোদ্দ বছরের অন্য মেয়েদের থেকে শিখলাম, এরকম কারও সঙ্গে হলে ফিসফিসিয়ে হাসাহাসি করতে হয়। কি আশ্চর্য ভাবে ট্রিভিয়ালাইজ করতে শেখানো হয় আমাদের যৌন নির্যাতনকে! ট্রিভিয়ালাইজ-কে বাংলায় কী বলব? নগণ্যকরণ?
আর একবার এক গুজব উঠল আমাদের ইস্কুলে। ইস্কুলের অন্য কোনো ক্লাসের কোনো মেয়ে নাকি প্রেগনেন্ট হয়ে পড়েছে। এটা আদৌ সত্যি, নাকি মিথ্যা, আমরা কেউই জানতাম না৷ গুজব উড়ছিল বাতাসে৷ শেষ পর্যন্তও জানা যায়নি। কিন্তু সবাই বন্ধুদের বলছিল, ‘কনগ্র্যাটস। তুমি মাসি হতে চলেছ।’ এবং সবাই মুখ টিপে হাসছিল। আমাদের বয়স তখনও ওই রকম— বারো থেকে চোদ্দর মধ্যে। আমরা কেউ ভাবিনি, মেয়েটি, যদি সত্যি এরকম কেউ থাকে, সে কি ধর্ষণের শিকার? সে কি কোনো ছেলে বন্ধুর দ্বারা প্রতারিত? খুব অদ্ভুত লাগে এখন! আমাদের এই সাধারণ শিক্ষাটা ছিল না কেন? কেন আমরা সমব্যথী হতে পারিনি?
কলেজ। এক বান্ধবী বলল, ওর মেসো ওকে ছোটবেলা থেকে যৌন নির্যাতন করত। মা জানে৷ কিন্তু মাসি কষ্ট পাবে, তাই মেসোকে আড়ালে বকেছে। সেই প্রথম জানলাম, বাবা-মামা-মেসোর বন্ধু শুধু নয়, মেসো নিজেও! আর শেষত যা জানা বাকি ছিল, তা হল, বাবা নিজেও এ কাজ করতে পারে। সেই কেসও ক্রমে দেখলাম।
আমার শৈশব এবং কৈশোর যখন ফিরে দেখি, তখন মনে হয়, একটা অন্ধকূপে বাস করতাম। কত ভুল জায়গায় হেসেছি! কত জনের জন্য কত কিছু করতে পারিনি, যা যা আজ নিজের মেয়ে বা তার বন্ধুদের জন্য করতে পারি!
মনে হয় বলেছিলাম, আমাদের মেয়েরা আমাদের গর্বিত করেছে তাদের স্কুলের এক শিক্ষাকর্মীর মেয়েদের গায়ে হাত দেওয়া নিয়ে প্রতিবাদ করে। কিন্তু আমাদের নিজেদেরও পিঠ চাপড়ানো উচিত, আমরা অভিভাবক হিসেবে এব্যাপারে আমাদের আগের প্রজন্মের চেয়ে বেশি সফল। কিন্তু সবাই কি?
লক্ষ্য করে দেখুন, আরজিকরের পর বারবার ঘটছে নাবালিকার ধর্ষণ বা খুন। কুলতলি। যাত্রাগাছি। হাওড়া। কৃষ্ণনগর। শিক্ষক ছাত্রীকে যৌনবস্তু ভাবে, এর চেয়ে লজ্জার কী আছে? আর কৃষ্ণনগরে অভিযুক্ত নিজে সদ্য সাবালক। তাহলে ছেলেদেরই বা আমরা মানুষ করতে পারছি কই?
আজ শিশুদিবস। অনেক কিছু করার আছে শিশুদের জন্য। তার মধ্যে অন্যতম প্রধান হল তাদের লিঙ্গ-ধর্ম-শ্রেণি-জাতি নির্বিশেষে সব মানুষকে প্রাথমিক ভাবে শ্রদ্ধা করতে শেখানো।
(ইয়ে, শ্রেণি রাজনীতির লোকেরা বলবেন, শ্রেণি-ঘৃণা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। ইন ফ্যাক্ট এই অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। শৈশব থেকেই নাকি একটা নির্দিষ্ট শ্রেণিকে ঘৃণা না করলে তারা বিগড়ে যাবে, এমন বার্তা পেয়েছি। অথচ, আমাদের ছোটবেলায় খুব সহজেই আমরা আতিশয্যকে ঘৃণা করতে শিখেছি, বড়লোকিকে ঘৃণা করতে শিখেছি, দুর্নীতিপরায়ণ বড়লোককেও ঘেন্না করতে শিখেছি। কিন্তু বড়লোক দেখলেই ঘেন্না করতে শিখিনি। ঘেন্না প্রাথমিক শিক্ষা হিসেবে শিশুর জন্য খুব ভাল শিক্ষা নয়। যাক গে, অন্য প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছি।)
তাদের নারী ও প্রান্তিক লিঙ্গযৌনতার মানুষদের প্রাথমিকভাবে সহনাগরিক ভাবতে শেখানো দরকার। নিজের শরীরকে চেনানো দরকার। যৌন নির্যাতন সম্পর্কে হ্যা হ্যা হি হি বন্ধ করে সঠিক প্রতিবাদ শেখানো দরকার৷ পক্সো-র খুঁটিনাটি তাদের বোঝানো দরকার।
এসব করতে পারলে, তবে আমরা নিজেদের দায়বদ্ধতা প্রমাণ করতে পারব তাদের প্রতি।
অনেক ধন্যবাদ লেখাটার জন্য। জন্ম থেকে যে কাঁটার বন ফেস করতে হয় মেয়েদের ( ছোট ছেলেদের বা অন্য লিঙ্গকে বাদ দিলে অসম্পূর্ণ হবে কাজ) তাকে ফোর ফ্রন্টে নিয়ে আসা দরকার।