১৯৯২তে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার পরে রেজাল্ট বেরনোর আগে শুনে ফেললাম সুমন চট্টোপাধ্যায়ের সদ্য প্রকাশিত ক্যাসেট “তোমাকে চাই”। প্রথমবার শোনার পরে আবার, আরেকবার…।
কেন কে জানে, প্রথমবার শোনার পরে যে গানটা আমাকে জড়িয়ে রইলো তা হলো “কখনো সময় আসে, জীবন মুচকি হাসে…”। তখনও জানি না, কয়েক মাসের মধ্যেই তেমন সময় আমার জীবনে আসতে চলেছে!
১৯৯২এর ৫ সেপ্টেম্বর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে অনার্স পড়তে ভর্তি হলাম। প্রথম বছরে তার সঙ্গেই আবশ্যক হিসেবে পড়তে হবে ইংরেজি আর বাংলা সাহিত্য। ইংরেজি বিভাগে আর্মস আন্ড দ্য ম্যান পড়াতেন স্বপন চক্রবর্তী, কবিতা পড়াতেন শীলা লাহিড়ী চৌধুরী আর গদ্য নীলাঞ্জনা গুপ্ত।
বাংলা বিভাগে আমাদের মেঘনাদবধকাব্য পড়াতেন উদয় কুমার চক্রবর্তী। রবীন্দ্রনাথের গদ্যের “সংকলন” আর বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা আমার যাঁদের কাছে পড়ার কথা ছিল তাঁদের কাছে ক’দিন ক্লাস করার পরে আর পড়তে ইচ্ছে করল না।
কারণ তাঁরা বারবার বলতেন, কিভাবে পাশ মার্ক ৩৬ পেতে হবে! আসলে একই সময়ে তিন কি চারটে ভাগে বাংলা ইংরেজি পড়ানো হতো। আমি আর আমার বন্ধু গোপা, ইতিহাস অনার্সের ছাত্রদের জন্য বরাদ্দ ক্লাস না করে ক্লাস করতাম তুলনামূলক সাহিত্যের অনার্সের ছাত্রদের জন্য বরাদ্দ ক্লাস। অর্থাৎ পারসেন্টেজ নিলে দেখা যেত, আমাদের উপস্থিতি প্রায় শূন্য অথচ আমরা কোনও ক্লাসই বাদ দিতাম না। সেই সময়ের যাদবপুর জোর করে ক্লাস করানোয় বিশ্বাস করতো না বলে আমাদের পরীক্ষা দিতে অসুবিধে হয়নি।
নাটকের মানুষ সৌমিত্র বসুর বাংলা ক্লাস আমরা স্বেচ্ছায় করতাম। উনি জানতেনও সেটা (একটু খুশিও কি হতেন না? ক্লাস পালানো শোনা যায় কিন্তু ক্লাস পালিয়ে ক্লাস করা?!)। রবীন্দ্রনাথের “শ্রাবণসন্ধ্যা” পড়াতে গিয়ে সুমনের “মন খারাপ করা বিকেল মানেই মেঘ করেছে”-র অনুষঙ্গ উল্লেখ করলেন সৌমিত্র বসু। মন ছুঁয়ে গেল।
ইতিহাস পড়তাম বটে তবে সাহিত্যের সঙ্গে সখ্য ছিল। বাংলা বিভাগে শঙ্খ ঘোষ নিজের কবিতা পড়বেন, শুনতে চলে গেলাম। জয় গোস্বামীও কি সেই সময়ে একবার কবিতা পড়তে যাদবপুরে এসেছিলেন?
ভারতীয় উপন্যাস নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, গিয়ে হাজির আমি। কিছুই তো জানি না! বক্তা, হরিনারায়ণ আপ্তের নাম বললেন। আমি বলে উঠলাম, “কিন্তু কে খবর রাখে”। বক্তা অবাক। মারাঠি সাহিত্য পড়িনি। তবে ওই নামের বাংলা অনুবাদটা হাতে এসেছিল।
ভাবছেন, এতো আবোলতাবোল কথা লিখে চলেছি, এর মধ্যে প্রতুল মুখোপাধ্যায় কোথায়?
এবার সে কথাই বলি। আসলে এই প্রেক্ষিতটা না বললে প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গানের সঙ্গে আমার পরিচিতির কথাটা বোঝাতে পারব না।
যতদূর মনে পড়ে প্রতুল মুখোপাধ্যায়-এর গান প্রথম শুনেছিলাম কবি অরুণ মিত্রের জন্মদিন উদযাপনের অনুষ্ঠানে, বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের ঢাকুরিয়ার বাড়িতে। সেটা আবার আমার বাবার ছোটমাইমার বাড়ি। বাবার ছোটমাইমা, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নিজের বোন। বাবা আমার যাওয়ার কথা জানতেন না। যাদবপুর থেকে চলে গিয়েছিলাম, ফিরে এসে বলেছিলাম। সেখানেই কি প্রথম শুনলাম প্রতুল মুখোপাধ্যায়কে?
লিখতে গিয়ে একটু ভয় ভয় করছে। তথ্যবিকৃতি ঘটছে কি? আসলে ওখানে কয়েকদিনের মধ্যে দুটো অনুষ্ঠান হয়েছিল, একটা অরুণ মিত্রের জন্য আর একটা বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্য। তার কোনও একটায় বা দুটোতেই প্রতুল মুখোপাধ্যায়কে কবিতার গান গাইতে শুনেছিলাম।
বাবরি মসজিদ ভাঙার পরে, আবার ঠিক পরে পরেই নয়, প্রতুলদাকে গাইতে শুনেছিলাম যাদবপুরে গান্ধী ভবনের সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে। আমরা ওঁকে গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়িয়ে গান শুনেছিলাম।
“এই তো জানু পেতে বসেছি পশ্চিমে… “; কী আশ্চর্য, দু-এক বছর আগে বইমেলা থেকে “বাবরের প্রার্থনা” বইটা কিনেছিলাম। চমকে গিয়েছিলাম প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গলায় এই গান শুনে।
এরপরে যখন “যেতে হবে” ক্যাসেট বের হলো আর বন্ধুরা ক্যাসেটের গান শুনে হৈ হৈ করে উঠল, আমি তখন অবলীলায় বলে উঠলাম, ” তোরা এই শুনলি? আমি তো কবে থেকে শুনছি!”
সম্ভবত ১৯৯৫ বা ১৯৯৬তে, নাকি আরও পরে দূরদর্শন বাংলার নববর্ষের বৈঠকে প্রতুল মুখোপাধ্যায় এলেন। গাইলেন, “আমি বাংলায় গান গাই, আমি বাংলার গান গাই”। এবার আমজনতার কাছে পৌঁছে গেলেন তিনি। তাঁর এই গান শুনলেন সেই সব মানুষ যাঁরা বাম সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে অত পরিচিত নন।
এই গান নিয়ে অনেক গল্প আছে। ওঁর মুখেই শুনেছি উনি এক জায়গায় “আমি বাংলায় গান গাই” গাইছেন, একজন শুনে বললেন, “আপনি গাইলেন ভালই তবে সুরে একটু ভুল আছে”। উনি তাঁকে বলে উঠতে পারলেন না যে এই গানের গীতিকার, সুরকার এবং গায়ক তিনি স্বয়ং।
নিজের জীবনে “প্রতুলদা”র গান আক্ষরিক অর্থে সাহস যুগিয়েছে বারবার। কোনও চাপের সময়ে নিজেকে নিজে সাহস দিয়েছি “ভয় পাস নি ছেলে” গেয়ে। মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে “স্লোগান” গান মনে পড়েছে ; “স্লোগান দিতে গিয়েই আমি চিনছি মানুষজন, স্লোগান দিতে গিয়েই আমি সবার সাথে আমার দাবি প্রকাশ্যে তুললাম।”
“কিসের ভয় সাহসী মন লাল ফৌজের” আর “জন্মিলে মরিতে হবে রে” অন্যভাবে আমার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। যাদবপুরে আমাদের ইতিহাসে এম এ তে চীনের ইতিহাস আবশ্যক ছিল। পড়াতেন চীনের ইতিহাসের অসম্ভব অনুরাগী মাস্টারমশাই অধ্যাপক অমিত ভট্টাচার্য। তিনি লং মার্চ পড়ানোর সময় তাঁকে প্রস্তাব দিলাম, চীনের ইতিহাসের ক্লাসে প্রতুল মুখোপাধ্যায়-এর গান শোনাবেন? তিনি এককথায় রাজি হলেন।
সেই সময়ে আমাদের এক সহপাঠী ছিল যে চোখে দেখতে পেত না। ডিজিটাল-পূর্ব সেই যুগে, সে স্যারের অনুমতি নিয়ে, টেপ রেকর্ডার নিয়ে আসত, ক্লাস লেকচার রেকর্ড করত। সেই টেপ রেকর্ডারে আমরা সারা ক্লাস শুনলাম লং মার্চ-এর গান “কিসের ভয় সাহসী মন লাল ফৌজের” আর নর্মান বেথুনকে মনে রেখে “জন্মিলে মরিতে হবে রে জানে তো সবাই, তবু মরণে মরণে অনেক ফারাক আছে ভাই। সব মরণ নয় সমান।” পরে প্রতুল মুখোপাধ্যায়কে ফোন করে জানিয়েছিলাম এই ক্লাসের কথা। শুনে উনি তো অবাক!
২০১৬তে বাংলাদেশে ছিলাম একুশে ফেব্রুয়ারি। সেখানে “আমি বাংলায় গান গাই” শুনছি নানান জায়গায়। সূর্যাস্তের সময়ে শাহবাগে গিয়েছি জমায়েত। সেখানে জমায়েতে সবার সঙ্গে গলা মেলালাম “ডিঙ্গা ভাসাও সাগরে, সাথীরে” গানের সঙ্গে। সেদিন সত্যিই মনে হয়েছিল, “আমি বাংলাকে ভালোবাসি, আমি বাংলায় ভালোবাসি, আমি তারই হাত ধরে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে আসি…”
খুব সুন্দর লেখা।